সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শুক্রবার (২৭ এপ্রিল) পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের অর্থায়নে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি সই হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দল চীন গেছে বুধবার (২৫ এপ্রিল)। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব জাহিদুল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরীও রয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার এবং চায়না এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষের মধ্যে চুক্তি হওয়ার বিষয়টি ইআরডি সূত্রে জানা গেছে।

জানা গেছে, সরকারের মেগা প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতু চালু হওয়ার দিন থেকে সেতুর ওপর দিয়ে রেল যোগাযোগ চালুর নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলপথ মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে এ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন নিয়ে এতদিন অনিশ্চয়তা থাকলেও তা কেটে গেছে।

জানা গেছে, মোট ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পে চীন সরকারের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়ার কথা রয়েছে ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেওয়া হবে ১০ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। চীন সরকারের পক্ষে এই টাকা দেওয়ার কথা রয়েছে চায়না এক্সিম ব্যাংকের।

রেল মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চায়না এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে এই প্রকল্পের অর্থ ছাড় তো দূরের কথা, এতদিন চুক্তি পর্যন্ত হয়নি। সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী যেখানে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হয়েছে ৪১ শতাংশ, সেখানে জমি অধিগ্রহণ ছাড়া পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরুই হয়নি। জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে সরকারের নিজস্ব টাকায়। ফলে পদ্মা বহুমুখী সেতু চালুর দিন থেকে রেল সংযোগ চালু করার বিষয়টি অনেকটাই অনিশ্চিত ছিল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

রেল মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এটি পদ্মা সেতু প্রকল্পের তুলনায় বড় প্রকল্প। এরপরও প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারেনি রেল মন্ত্রণালয়। এই প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে চায়না এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে কয়েকবার প্রকল্প পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল চায়না সফর করেছে।

প্রতিনিধিদলে ইআরডি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিনিধি সংযুক্ত ছিলেন। চায়না এক্সিম ব্যাংকের প্রতিনিধিদলও বাংলাদেশে ইআরডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে গেছেন। কিন্তু দফায় দফায় চায়না এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে আলাপ আলোচনা ও বৈঠক করেও অর্থপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনও অগ্রগতি হয়নি। ইআরডির পক্ষ থেকে এ বছরের ১৫ জুনের মধ্যে অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে চুক্তি সইয়ের জন্য অনুরোধ করা হলেও চায়না এক্সিম ব্যাংক তাতে সাড়া দেয়নি।

রেল মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রথমদিকে এ প্রকল্পে শতভাগ অর্থায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল চায়না এক্সিম ব্যাংক। কিন্তু পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারকে ১৫ শতাংশ অর্থায়নের শর্ত দেওয়া হয়। চায়না এক্সিম ব্যাংকের এই শর্তে সম্মত জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে চিঠি লিখে জানালেও চায়না এক্সিম ব্যাংক টাকা দেওয়ার বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত দেয়নি।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে এ প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪ কোটি ১০২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ অর্থ ব্যয় করতে না পারায় তা ফেরত দিতে হয়েছে। যার কারণে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়নের অগ্রগতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে এই প্রকল্পে নতুন করে আরও ৭ হাজার ৯০৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, চায়না এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের সহায়তার অর্থপ্রাপ্তির বিষয়ে কাজ করছে সরকার। চুক্তিটি সম্পাদিত হয়ে যাচ্ছে। অবিলম্বে প্রকল্পের নির্মাণ কাজও শুরু হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘নির্ধারিত সময়েই পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি। আমরা সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছি।’

উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃদেশীয় রেলযোগাযোগ উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের ৮ মেগা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প চালু হলে মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলা নতুন করে রেল লাইনের অন্তর্ভুক্ত হবে। এই রুটে কন্টেইনার চলাচলের ক্ষেত্রে কোনও স্পিড ও লোড বিধিনিষেধ না থাকায় জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফ্রেইড ও ব্রড গেজ কন্টেইনার চালু করা যাবে। রেলের যাত্রীসেবার মান বাড়বে এবং একইসঙ্গে ভবিষ্যতে বরিশাল ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে রেল সংযোগের সঙ্গে যুক্ত করতে এই রুটে দ্বিতীয় লাইন নির্মাণ করা সম্ভব হবে বলেও জানায় রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র।

সূত্র আরও জানায়, শুধু দক্ষিণ এশিয়াই নয়, এ প্রকল্প ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপন করবে। ঢাকা-যশোর করিডোরে অপারেশনাল সুবিধাদিসহ সংক্ষিপ্ত রুটে বিকল্প রেল যোগাযোগ স্থাপন করবে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু সংযোগ প্রকল্পটির প্রধম পর্যায়ের কাজের বিবরণে জানা গেছে, পদ্মা সেতু রেল লাইনটি বিদ্যমান ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে শুরু হয়ে গেন্ডারিয়া-মাওয়া হয়ে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ভাঙ্গা জংশন স্টেশন পর্যন্ত যুক্ত করবে। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ভাঙ্গা জংশন হয়ে বিদ্যমান কাশিয়ানি জংশন স্টেশন হয়ে পদ্মবিলা জংশন হয়ে ওয়াই (ণ) কানেকশনের মাধ্যমে বিদ্যমান রূপদিয়া এবং সিঙ্গিয়া স্টেশনে যুক্ত করবে। ঢাকা - গেন্ডারিয়া সেকসনে ৩ কিলোমিটার ডাবল লাইনসহ প্রকল্পের আওতায় মোট ১৭২ কিলোমিটার নতুন মেইন লাইন নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।

উল্লেখ্য, ঢাকা - যশোরের মধ্যে একটি রেল সংযোগ লাইন বিদ্যমান থাকলেও তা ঘুরপথে হওয়ায় দৈর্ঘ্য বেশি। এ ছাড়া এক্সেল লোড বহন ক্ষমতা, গতি ও সেকসনাল ক্যাপাসিটি বিবেচনায় পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর ব্রডগেজ রেল সংযোগ নির্মাণ বাংলাদেশ পরিবহন অবকাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে যাচ্ছে।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ নির্মাণের জন্য মোট ৪টি সেকসনে বিভক্ত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে সেকসন-১ ঢাকা-গেন্ডারিয়া, সেকসন-২ গেন্ডারিয়া-মাওয়া, সেকসন-৩ মাওয়া-ভাঙ্গা জংশন-মাওয়া এবং সেকসন-৪ ভাঙ্গা জংশন-যশোর।

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ১৪টি নতুন স্টেশন নির্মাণ ও ৬টি বিদ্যমান স্টেশন উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মান করা হবে। নতুন ১৪টি স্টেশন হচ্ছে কেরানিগঞ্জ, নিমতলা, শ্রীনগর, মাওয়া, জাজিরা, শিবচর, ভাঙ্গা জংশন, নগরকান্দা, মুকসুদপুর, মহেশপুর, লোহাগড়া, নড়াইল, জামদিয়া ও পদ্মবিল। এ ছাড়া ঢাকা, গেন্ডারিয়া, ভাঙ্গা, কাশিয়ানী, রূপদিয়া ও সিঙ্গিয়া ৬টি বিদ্যমান স্টেশনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হবে।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের মধ্যে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আরেকটি উপ-রুট স্থাপন করবে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায় আন্তর্জাতিক পরামর্শক দিয়ে এ প্রকল্পের সমীক্ষা ও বিস্তারিত ডিজাইন ও দরপত্র সম্পন্ন করা হয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৪ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় রেল খাতে চীন সরকারের বিনিয়োগের বিষয়টি দুদেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি সাধন হবে। একইসঙ্গে পায়রা সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে রেলসংযোগ স্থাপনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। এ ছাড়াও ঢাকা-যশোর, ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা-দর্শনার দূরত্ব কমবে যথাক্রমে ১৮৪ দশমিক ৭২ কিলোমিটার, ২১২ দশমিক ৫ কিলোমিটার এবং ৪৪ দশমিক ২৪ কিলোমিটার। একইসঙ্গে সময়ও বাঁচবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) আনুমানিক এক-তৃতীয়াংশ অবদান রাখবে।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারের অগ্রাধিকারের ৮ মেগা প্রকল্পের সঙ্গে এটিও প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের তালিকাভুক্ত প্রকল্প। সারাদেশের রেল যোগাযোগের সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে সংযুক্ত করতেই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে জিডিপিতে বড় ভূমিকা পালন করবে। আশা করছি প্রকল্পটি যথানিয়মেই এগিয়ে যাবে।’

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ প্রকল্পের জন্য ১০০টি ব্রডগেজ যাত্রীবাহী গাড়ি সংগ্রহ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ১ হাজার ৯৬৮ দশমিক ৪৮ একর জমির মধ্যে ব্যক্তি মালালিকানার ১৭শ একর, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ২শ দশমিক ৪৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। একইসঙ্গে পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষের ৬৮ একর জমি এ প্রকল্পে স্থানান্তর করা হয়েছে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews