বাংলাদেশের অর্থনীতির হালহকিকত লইয়া অন্দর মহলের নানান আলোচনা এখন প্রকাশ্যে আসিয়াছে। কেহ কেহ অর্থনীতিকে ফোকলা বলিয়াই মন্তব্য করিতেছেন। ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদসহ বিশ্লেষকদের অনেকেই বলিতেছেন সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক। খোদ পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলিয়াছেন, ‘বর্তমানে দেশে চকচকে অর্থনীতি আছে। কিন্তু গভীরতা কম। সামান্য ধুলো-বাতাসে এটা কেঁপে ওঠে।’ ইহার মানে মন্ত্রী অর্থনীতির গভীরতা বাড়াইবার কথাই বলিয়াছেন। টিকসই অর্থনীতির জন্য ইহা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতির গভীরতা বাড়াইবার মতন পদক্ষেপগুলি কি আমাদের সামনে রহিয়াছে? গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট ক্রমেই তীব্র হইতে তীব্রতর হইতেছে। কলকারখানার চাকা ঘুরাইবার মতন জ্বালানি সরবরাহ নাই। উদ্যোক্তারা অধিক মূল্যে গ্যাস-বিদ্যুৎ কিনিতে সম্মত থাকিলেও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করা সম্ভব হয় নাই। বিষয়টি নিয়ে বারংবার ইঙ্গিত করা হইলেও সেই দিকে ভ্রুক্ষেপ না করায় আজিকার এই অবস্থা, বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার খেলা। ইহার সঙ্গে যোগ হইয়াছে ডলারের উচ্চমূল্য। সম্প্রতি ডলারের মূল্যমান এতই বাড়িয়াছে যে, ইহার প্রভাবে শিল্পের কাঁচামালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতেও ব্যাঘাত ঘটিয়াছে। কোনো কোনো ব্যাংক কৃত্রিমভাবে ডলার-সংকট সৃষ্টি করিয়াছে। আবার ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে আমদানিকৃত পণ্যমূল্যও বাড়িয়াছে। আশঙ্কা করা হইতেছে যে, এই পরিস্থিতি চলমান থাকিলে উদ্যোক্তারা ব্যাংকের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করিতে সক্ষম হইবেন না। কারখানার চাকা না ঘুরিলে, পণ্য উৎপাদন ও বিপণন না করিলে আয় হইবে না—ইহাই স্বাভাবিক। পরিস্থিতিতে বাধ্য হওয়া এই সকল শিল্প-উদ্যোক্তার নাম উঠিবে ঋণখেলাপির তালিকায়। শুধু তাহাই নহে, কারখানা না চলিলে কর্মসংস্থান হারাইবে হাজার হাজার লোক। যাহা সমাজে নতুন এক অস্থিরতার জন্ম দিবে।
এই দিকে ডলারের মূল্য বাড়িয়া যাওয়ার কারণে পণ্য আমদানিতে উদ্যোক্তাদের বাড়তি ব্যয় করিতে হইয়াছে। সুযোগ বুঝিয়া অনেক ব্যাংক আবার নিজেরাই ডলার অধিক মূল্যে বিক্রি করিয়াছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলিয়াছেন, ব্যাংকগুলো ডলারের বিনিময় হারের নামে লুটপাট চালাইতেছে। তিনি ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়াইবার বিপক্ষেও বলিয়াছেন। শুনা যাইতেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে ৯ শতাংশে বেঁধে দেওয়া ঋণের সুদের হার বাড়াইতে যাইতেছে সরকার। ইতিমধ্যে দুই-এক ক্যাটাগরিতে সুদের হার বাড়ানো হইয়াছে। যদিও বলা হইতেছে—সুদের হার বাড়াইলে ঋণ সরবরাহ কমিয়া আসিবে এবং মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা যাইবে। বস্তুত, ইহা বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে কতটা সংগত হইবে, তাহা বেশ প্রশ্নসাপেক্ষ।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের উচ্চমূল্য আর জ্বালানিসংকট—এই তিনের সমন্বয়ে অর্থনীতিতে যে জটিলতা তৈরি হইয়াছে, তাহার জুতসই সমাধানই এই মুহূর্তে মুখ্য। কিন্তু তাহা কীভাবে হইবে? একেক অর্থনীতিবিদের দৃষ্টিভঙ্গি একেক রকম হইলেও সংকট যে রহিয়াছে, তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। সংকটের সমাধান কোন পথে হইবে—সেই দিক খোঁজাই এখন জরুরি। কারণ, বিগত বছরগুলিতে অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন সাধিত হইয়াছে, গ্রামে-গঞ্জে ফ্রিজ, এসি আর বিউটি পার্লারের যে বিস্তৃতি আমরা দেখিতেছি, তাহা আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতিরই প্রমাণ। ইহার ধারাবাহিকতা রক্ষা করিতে হইলে উপরিউক্ত তিন সংকটের সমাধান যত দ্রুত করা যাইবে, ততই উন্নয়ন ব্যয়ের যৌক্তিকতা ও অর্থনৈতিক গভীরতা বাড়িবে। আমরা চাই না অগ্রসরমাণ অর্থনীতি পশ্চাৎপদ হউক।