সালমান এফ রহমানের ছেলে ও ভাতিজার পর এবার যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের সম্পদ দেশটির ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) জব্দ করেছে বলে খবর দিয়েছে আল জাজিরা।
বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের আবেদনের পর জাবেদের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের গুরুতর ও সংগঠিত অপরাধ দমন বিষয়ক সংস্থাটি।
বুধবার কাতারভিত্তিক টেলিভিশন স্টেশনটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার রাতে এনসিএর মুখপাত্র আল-জাজিরার অনুসন্ধানী শাখা আই-ইউনিটকে পাঠানো বিবৃতিতে যুক্তরাজ্যে থাকা জাবেদের সম্পদ জব্দের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এ খবর এমন এক সময় সামনে এল যখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস চার দিনের সরকারি সফরে লন্ডনে রয়েছেন। তিনি ক্ষমতা হারানো শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও ঘণিষ্ঠদের পাচার করা অর্থ যুক্তরাজ্য থেকে ফেরাতে দেশটির প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন।
জাবেদের আগে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের আরেক ঘণিষ্ঠ ব্যবসায়ী নেতা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা সালমান রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান এফ রহমান এবং তার বড় ভাইয়ের ছেলে আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের যুক্তরাজ্যে থাকা সম্পত্তি জব্দের আদেশ দিয়েছিল এনসিএ। তাদের ৯ কোটি পাউন্ড বা ১৪৭৬ কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল সম্পত্তি জব্দে তখন নয়টি আদেশ দিয়েছিল সংস্থাটি।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে আসার পর সালমান রহমান ও জাবেদের মত আওয়ামী লীগের ঘণিষ্ঠ ব্যবসায়ী এবং আরও অনেক মন্ত্রী ও নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অর্থপাচারের অভিযোগ এনে তদন্ত করছে এবং মামলা করেছে।
আল জাজিরা বলেছে, ‘ব্রিটেনের এফবিআই’ হিসেবে পরিচিত গুরুতর ও সংগঠিত অপরাধ দমন বিষয়ক সংস্থাটি বিবৃতিতে আই-ইউনিটকে বলেছে, “চলমান দেওয়ানি অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে এনসিএ বেশ কয়েকটি সম্পদ জব্দের আদেশ পেয়েছে বলে আমরা নিশ্চিত করছি।’
তবে জাবেদের কতগুলো সম্পদ জব্দের আদেশ এসেছে তা বলেনি সংস্থাটি। এর আগে ২০২৪ সালে আল জাজিরার এক প্রামান্য চিত্রে ব্যবসায়ী এবং সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য জাবেদের যুক্তরাজ্যে বাড়ি ও ফ্ল্যাটসহ সাড়ে তিনশরও বেশি সম্পদ থাকার তথ্য উঠে এসেছিল।
এনসিএর সম্পত্তি জব্দের আদেশের ফলে আওয়ামী লীগের মিত্র ও সাবেক মন্ত্রী জাবেদ এসব সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারবেন না। তবে সংস্থাটি লন্ডনসহ যুক্তরাজ্যে থাকা তার কতগুলোর বাড়ি, ফ্ল্যাট বা সম্পদ জব্দ করতে বলেছে তা বিবৃতিতে বলেনি।
তবে লন্ডনের সেন্ট জন’স উডে অবস্থিত জাবেদের প্রায় দেড় কোটি ডলারে কেনা বিলাসবহুল বাড়িটি জব্দের তালিকায় থাকার তথ্য আল জাজিজার আই-ইউনিট জানতে পেরেছে।
আই-ইউনিটের প্রামাণ্য চিত্রে গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা এ বাড়ির দৃশ্যও দেখানো হয়েছিল। ছদ্ম পরিচয়ে এ ইউনিটের সাংবাদিকরা শেখ হাসিনার সরকারের আগের মেয়াদে জাবেদের মন্ত্রী থাকাকালীন বৃট্রেনে তার সম্পদের বিষয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
‘দ্য মিনিস্টার’স মিলিয়নস’ শিরোনামে ২০২৪ সালের অক্টোবরে প্রচারিত ওই প্রতিবেদনে জাবেদ বিভিন্ন দেশে থাকা তার সম্পদের বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনি তার দামি স্যুট ও জুতার কথাও তুলে ধরেন।
সেসময় এক প্রশ্নে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে বলেছিলেন, “আমি আসলে তার ছেলের মত। আমার এখানে ব্যবসা আছে সেটা তিন জানেন।”
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগীরা যুক্তরাজ্যে বিলাসবহুল সম্পত্তি কেনার পেছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছেন বলে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়।
গার্ডিয়ান লিখেছে, সেখানকার প্রায় ৩৫০টি সম্পত্তির মধ্যে ছোট ফ্ল্যাট থেকে বৃহৎ অট্টালিকা পর্যন্ত আছে, যেগুলো কিনেছে যুক্তরাজ্য ও বাইরে নিবন্ধিত অফশোর কয়েকটি কোম্পানি। এসব কোম্পানি বাংলাদেশি কয়েকজন প্রভাবশালী ধনী ব্যবসায়ী ও হাসিনা সরকারের সাবেক দুজন মন্ত্রীর মালিকানাধীন।
দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম অবজারভার অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছে, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা বাংলাদেশি ‘প্রভাবশালী খেলোয়াড়দের’ যুক্তরাজ্যের আবাসন খাতে প্রায় ৪০ কোটি পাউন্ড বা ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা বা তারও বেশি বিনিয়োগ আছে।
এর আগে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ডামাডোলের আগে ২৬ ডিসেম্বর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে “সরকারের মন্ত্রিসভার অন্তত একজন সদস্যের নিজ নামে বিদেশে একাধিক কোম্পানি থাকার প্রমাণ রয়েছে, যার প্রতিফলন হলফনামায় নেই। মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি এখনও বিদেশে সক্রিয়ভাবে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পরিচালনা করছেন। যে সকল কোম্পানির মোট সম্পদ মূল্য প্রায় ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা।”
সরকার জানতে চাইলে তার নাম এবং এ বিষয়ক সব তথ্য ও তথ্যসূত্র দেওয়া হবে বলে জানালেও পরে ইফতেখারুজ্জামান বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে সেই ‘মন্ত্রীর’ নাম জানান। তিনি হলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ।
ওই নির্বাচনে জয়ের তিন মাস পর চট্টগ্রাম-১৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাবেদ ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে যুক্তরাজ্যে সম্পদ ও ব্যবসা থাকার বিষয়ে যে তথ্য দিয়েছে সেটি স্বীকার করে নেন।
তবে সেই সম্পদ ও ব্যবসা বাংলাদেশ থেকে পাঠানো টাকায় করা হয়নি দাবি করে বলেছেন, তার বাবা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর ৫০ বছরেরও বেশি সময় আগে বিদেশে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি সেই ব্যবসার উত্তরাধিকারী। আর যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার সময়ও তিনি ব্যবসা করেছেন। যুক্তরাজ্যে তার আয়কর নথিও আছে।
করোনাভাইরাস মহামারীর সময় যুক্তরাজ্যে সম্পদ ও ব্যাংক ঋণের সুদহার কমে যাওয়ার পর ঝুঁকি নিয়ে লাভবান হয়েছেন, এমন একটি কথাও বলেছেন এই আওয়ামী লীগ নেতা।
যুক্তরাজ্যে হাসিনার মিত্রদের ৬ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির খবর
যুক্তরাজ্যে সালমানের ছেলে-ভাতিজার দেড় হাজার কোটি টাকার সম্পদ জব্দ
সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সিআইডির তদন্ত শুরু
দেশ-বিদেশে সাইফুজ্জামানের সম্পদ জব্দের আদেশ
বিদেশে ব্যবসা নিয়ে সব প্রশ্নের জবাব দিলেন সাইফুজ্জামান
লন্ডনে সালমানপুত্র শায়ানের দুই অ্যাপার্টমেন্ট অবরুদ্ধের আদেশ