বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা, স্থান, খাবার, পোশাক প্রভৃতি কারণে অনেক আগে থেকেই ঢাকা শহরের পরিচিতি ও খ্যাতি আছে। কয়েক দশক আগেও ঢাকার বিভিন্ন জায়গা ছিল নিরিবিলি। বাতাস ছিল অনেকটাই বিশুদ্ধ। ঢাকার পথে বের হলে গন্তব্যে সঠিক সময়ে পৌঁছানো যাবে কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তা হতো না। কিন্তু ঢাকা এখন পরিচিত হয়ে উঠেছে যানজটের শহর হিসেবে। সেই সঙ্গে রাজধানীতে বসবাসকারী নাগরিকদের প্রতিনিয়ত পীড়িত করছে উচ্চমাত্রার শব্দ, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ঢাকার যানজট আর শব্দদূষণ নিয়ে কথা বলা হয়েছে অনেক। সংবাদপত্রে, সেমিনারে, বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যাগুলো টিকেই আছে। তা দূর হয়নি ও কমেনি। বরং একেকটি নতুন বছর আসে, আর মনে হয় ঢাকার যানজট আর শব্দদূষণ হয়ে উঠছে আরও দুঃসহ, আরও বীভৎস। প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা প্রয়োগের মাধ্যমে ঢাকার যানজট আর শব্দদূষণ বন্ধ করা কি সম্ভব নয়? অত্যন্ত পীড়াদায়ক ও ক্ষতিকর এমন দুটি সমস্যা কী করে দিন দিন বেড়েই চলেছে এই শহরে?

ঢাকার পথে ২০০৬ সালে কোনো যানবাহন ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারত। পরবর্তী বছরগুলোতে ঢাকায় যানজট কেবল বেড়েছে। ২০১৮ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি কমে হয়েছে ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার। এখন অবস্থা এমনই দঁাঁড়িয়েছে, যানবাহন ব্যবহার না করে হাঁটলেই বেশি তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। আমার বাসা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকালে ক্লাস নিতে যাওয়ার সময় আমি বিভিন্ন দিন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে বা মিন্টো রোডে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে ১০ মিনিটের মধ্যে কলাভবনে পৌঁছেছি। গাড়ি নিয়ে আমার ড্রাইভারের কলাভবনে আসতে আরও দেরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় দিনের অন্যান্য সময়ও। সন্ধ্যাবেলা হয়তো ডাক্তার দেখানোর জন্য বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে হবে। গাড়িতে বসে দীর্ঘ সময় দেখতে হয় সব দিকে যানবাহন নিশ্চল হয়ে আছে। সারাদিন কাজের পর সন্ধ্যায় প্রিয় মানুষদের সঙ্গে কোথাও বসে অতীতে যত সহজে গল্প করে মন হালকা করা যেত, এখন সন্ধ্যার পর যানজটের কারণে কোথাও যাওয়া ক্লান্তিকর ও কঠিন। ফলে মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ কমে যাচ্ছে, যা মনের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। শুক্রবার বা কোনো সরকারি ছুটির দিন সকালে গাড়িতে করে যে গন্তব্যে পৌঁছাতে ২০ মিনিট লাগে, অন্য দিনগুলোতে একই গন্তব্যে গাড়িতে করে যেতে প্রায়ই লেগে যায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময়। যানজটের এমন পরিস্থিতি বহু মানুষের মনে তৈরি করছে অস্থিরতা, বিরক্তি আর উদ্বেগ। মানসিক চাপ থেকে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা। প্রতিদিন দীর্ঘ সময় পথে আটকে থাকার বিরক্তির কারণে মানুষ হয়ে উঠছে বদমেজাজি আর খিটখিটে। মানুষের ভোগান্তি বেড়েই চলেছে অথচ যানজট সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।

শুধু মানসিক অস্থিরতা বাড়ার সমস্যাই নয়; জানা গেছে যানজটের কারণে ঢাকায় প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। গবেষণায় এসেছে, যানজটের জন্য বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। ঢাকায় মেট্রোরেল তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ফ্লাইওভার ঢাকায় যানজট কমাতে পারেনি। মেট্রোরেল চালু হলেই কি ঢাকার যানজট কমবে, যদি ঢাকার পথে ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরবাইকের সংখ্যা এবং ঢাকায় বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা না কমে? পথে নামলে বোঝা যায় ঢাকায় বেড়েই চলেছে ব্যক্তিগত গাড়ি। একই পরিবারে যদি একাধিক গাড়ি ব্যবহার করা হয়, তাহলে পথে যানজট বাড়বেই। উবার, পাঠাও প্রভৃতি সেবা প্রদানের কারণে পথে দীর্ঘ সময় থাকা যানবাহনের সংখ্যাও এখন আগের চেয়ে বেশি। ছোট, মাঝারি শহর এবং গ্রামে বিভিন্ন সুবিধা না পাওয়ার কারণে বহু মানুষ ঢাকায় আসছে। এত মানুষের উপস্থিতি রাজধানীর ওপর অনেক চাপ তৈরি করছে, তা বোঝা খুব সহজ। ঢাকায় যদি মানুষ আসতেই থাকে, তাহলে মেট্রোরেল করেই কি যানজট থামানো যাবে? বিকেন্দ্রীকরণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে বহু মানুষের ভিড়ে এই শহর অচল হয়ে যাবে। বিকেন্দ্রীকরণের কথাও নতুন কোনো পরামর্শ নয়। কিন্তু ঢাকায় মানুষের থাকার প্রয়োজন এবং প্রবণতা কমানোর কার্যকর ব্যবস্থা কি নেওয়া হচ্ছে?

কয়েক মাস আগেই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যখন নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন করছিল, তখন কয়েকদিন ঢাকার পথে যানজট ছিল না। তারা অ্যাম্বুলেন্সের জন্য আলাদা পথ করে দিয়েছিল। সব গাড়ি কয়েকদিন নিয়ম মেনে এমনভাবে চলেছে যে, পথে কোনো যানজট তৈরি হয়নি। সেই আন্দোলন থেমে যাওয়ার কয়েকদিন পরই আবার ঢাকায় যানজট ফিরে এসেছে। কিন্তু স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা দেখিয়ে দিয়েছিল আন্তরিক চেষ্টা থাকলে এই যানজট দূর করা অসম্ভব কিছু নয়। ঢাকার পথে প্রায়ই দেখি বাস পথের মাঝে থেমে যাত্রী তুলছে বা নামাচ্ছে, রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করার কারণে চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে, সোজা পথে যাওয়ার গাড়ি বাম দিকে যাওয়ার পথ বন্ধ করে রেখেছে, লম্বা সময় ধরে ট্রাফিক সিগন্যালে সব যানবাহন আটকে রাখা হয়েছে, ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার না করে ঠিক তার নিচেই পথচারীরা বহু যানবাহনের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। এই সমস্যাগুলো কি ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালনরত পুলিশ সদস্যদের পক্ষে দূর করা কঠিন? পুলিশ সদস্যরা পথে দায়িত্ব পালনের পরও এমন সমস্যা কেন টিকে থাকছে? যদি সবার ক্ষেত্রেই কঠোরভাবে ট্রাফিক আইন প্রয়োগ করা হয় এবং কোনো যানবাহন বা পথচারী যেন রাস্তায় নিয়ম না ভাঙে সতর্কভাবে তা খেয়াল করা হয়, তাহলে যানজট কমে আসবে অনেকটাই।

যানজটের সঙ্গে শব্দদূষণও হয়ে উঠেছে ঢাকার একটি গুরুতর সমস্যা। শহরের রাস্তায় প্রতিনিয়ত বিকট শব্দে হর্ন বাজাচ্ছে বিভিন্ন যানবাহন। বাসের আর অন্য গাড়ির হর্ন, উচ্চশব্দে বাজানো মাইক তো হরহামেশা পীড়িত করছে পথচারীদের। সেই সঙ্গে নাগরিকদের যন্ত্রণা দিচ্ছে শহরের মধ্য দিয়ে যাওয়া ট্রেনের অতি উচ্চমাত্রার হর্ন। আমি যে আবাসিক এলাকায় থাকি তার কাছেই এয়ারপোর্ট রোডের পাশে রেলপথ দিয়ে চলাচলকারী রেলগাড়িগুলো দিনে, গভীর রাতে, ভোরে অতি উচ্চশব্দে হর্ন বাজায়। সেই বিকট শব্দ জানালা-দরজা বন্ধ করে রাখার পরও ঘরে প্রবেশ করে বিপর্যস্ত করে তোলে আমাদের। কখনও ট্রেনচালকরা বেশ কয়েক সেকেন্ড ধরে একটানা বাজিয়ে যান অতি উচ্চমাত্রার হর্ন। প্রয়োজন হলে হর্ন ব্যবহার করা যেতেই পারে। কিন্তু এই প্রশ্ন করা জরুরি হয়ে ওঠে যে, রেলগাড়ি কেন অসহনীয় মাত্রার হর্ন ব্যবহার করবে? অতি উচ্চমাত্রার অসহনীয় হর্ন সৃষ্টি করে তীব্র শব্দদূষণ, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, বিশেষ করে যাদের উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদযন্ত্রের সমস্যা আছে তাদের জন্য। আমরা দেখতে পাই, রেলপথের খুবই কাছে তৈরি করা হয়েছে ঝুপড়ি। সেখানে থাকছে মানুষ। আবার কখনও রেলপথের খুব কাছে বসে বাজার। ধারণা করি, রেললাইনের ওপর থেকে মানুষ যেন সরে যায়, সেই কারণে রেলগাড়িগুলো এমন অতি উচ্চমাত্রার হর্ন বাজায়। কিন্তু এমন অসহনীয় হর্ন তো ক্ষতি করে বহু মানুষের। যা দরকার তা হলো, রেললাইন ঘেঁষে যেন মানুষের থাকার জায়গা না থাকে বা বাজার না বসে, তা নিশ্চিত করা। তাহলেই তো রেললাইনের কাছে মানুষের আনাগোনা বন্ধ হবে আর মানুষকে সরানোর জন্য রেলগাড়ির অতি উচ্চশব্দের হর্ন ব্যবহার করতে হবে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ৬০ ডেসিবেলের বেশি যে কোনো শব্দ মানুষকে সাময়িকভাবে বধির করে তুলতে পারে। আর ১০০ ডেসিবেলের বেশি শব্দের পরিবেশে নিয়মিতভাবে থাকা মানুষের শ্রবণশক্তির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক। ২০০৬ সালের শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধি অনুসারে ঢাকার আবাসিক এলাকার পাশে দিনের বেলা ৫০ ডেসিবেলের বেশি এবং রাতে ৪৫ ডেসিবেলের বেশি আওয়াজ করা যাবে না। আবাসিক এলাকার কাছে রাতে সব ধরনের যানবাহনের হর্ন বাজানোর ব্যাপারে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা আছে। হাসপাতালের পাশ দিয়ে চলার সময়ও হর্ন বাজানো আদালত নিষিদ্ধ করেছেন। অথচ ঢাকায় আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল প্রভৃতি স্থানের পাশে প্রতিনিয়ত গাড়ি, বাস, রেলগাড়ি দিনে এবং রাতে উচ্চশব্দে হর্ন বাজিয়ে চলেছে। গাড়ি, বাস, রেলগাড়ি প্রভৃতি যানবাহনে যেন অপ্রয়োজনে এবং অসহনীয় মাত্রার হর্ন বাজিয়ে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করা না হয়, সে জন্য শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। একই সঙ্গে যারা শব্দদূষণ করে তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া দরকার, যেন শাস্তির ভয়ে তারা শব্দদূষণ করা থেকে বিরত থাকে।

আমাদের সমাজে অর্থনৈতিক উন্নতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ঢাকায় যানজটে আটকে থেকে আর বিকট শব্দদূষণের কারণে নাগরিকদের যে প্রতিনিয়ত মানসিক এবং শারীরিক ক্ষতিসাধন ঘটছে, তাতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুফল তারা উপভোগ করতে পারবেন কি? মানুষের মনের শান্তি ও শরীরের সুস্থতা যেন কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয়, তা নিশ্চিত করা সবচেয়ে জরুরি। যানজট ও শব্দদূষণ গুরুতর দুটি সমস্যা, যা প্রতিদিন মানুষের মনে চাপ তৈরি করছে, তাদের শরীরের ক্ষতি করছে। এমন সমস্যা সম্পর্কে তাই নির্লিপ্ত বা নির্বিকার থাকার কোনো সুযোগ নেই। নতুন বছর, নতুন সময়ে এই শহরে টিকে থাকা দুর্বিষহ- এই দুটি সমস্যা দূর করার জন্য দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হলেই নাগরিকরা স্বস্তি পাবেন।

অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews