এক দশক আগেও ফ্রিজ ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। দেশি ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিগুলোর বদান্যতায় সেই বিলাসী ফ্রিজ এখন ঘরে ঘরে। আর্থসামাজিক উন্নয়নের কারণে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও এখন ফ্রিজের শোরুম পৌঁছে গেছে। দামে কম, মানে ভালো হওয়ায় দেশি ফ্রিজে মানুষের আস্থা ক্রমেই বাড়ছে। তাই ফ্রিজ এখন সব শ্রেণি-পেশার মানুষের নিত্যব্যবহার্য ইলেকট্রনিক্স পণ্য এবং দৈনন্দিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।
প্রতিবছর কত ফ্রিজ বিক্রি হয়, সরকারি সংস্থাগুলোর কাছে এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে দেশি ইলেকট্রনিক্স নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাবে, বর্তমানে বছরে কমবেশি প্রায় ৩০ লাখ ফ্রিজ বিক্রি হয়। এ বাজার প্রতিবছর ১০-১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি ফ্রিজ বিক্রি হয় কুরবানির ঈদে, প্রায় ৬৫-৭০ শতাংশ। ২০২১ সালের মার্চে মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশ (এমডব্লিউবি) নামের একটি সংস্থার গবেষণার তথ্যমতে, ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশের ফ্রিজের বাজার বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। বর্তমানে দেশের ফ্রিজের বাজারের আকার প্রায় ৬৮ কোটি ডলার। এ বাজার হিস্যার ৭৭ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করছে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো।
বর্তমানে ১৩টির মতো দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান দেশে ফ্রিজ বানাচ্ছে। এর মধ্যে যমুনা ইলেকট্রনিক্স, ওয়ালটন, মিনিস্টার, কনকা ও সিঙ্গার ফ্রিজের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। কারণ, দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় এসব কোম্পানির শোরুম ও সার্ভিস সেন্টার রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ক্রেতার সুবিধার্থে মাসিক কিস্তি, ব্যাংক ঋণ এবং ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ফ্রিজ বিক্রি করে থাকে। তাছাড়া উৎসব-পার্বণে নানা ছাড় দিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো।
প্রান্তিক পর্যায়ে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছে যাওয়ার কারণে এখন শহরের চেয়ে গ্রামে ফ্রিজের চাহিদা বাড়ছে দ্রুত। ফলে এখন বছরে মোট যে পরিমাণ বিক্রি হয়, এর ৭০ শতাংশই যায় গ্রামে। গ্রামাঞ্চলে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার ফ্রিজের চাহিদা বেশি। সাধারণত সর্বনিম্ন ১৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা দামের ফ্রিজ রয়েছে। বর্তমানে বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত ফ্রিজের বাজারের আকার ১১ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা। জার্মানভিত্তিক বাজার গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার পূর্বাভাস হচ্ছে, ২০২৯ সাল নাগাদ ফ্রিজের দেশীয় বাজার হতে পারে ৩৬ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।
মূলত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ফলে দেশে ফ্রিজ শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। সাশ্রয়ী মূল্যে ভোক্তাদের কাছে ফ্রিজ পৌঁছে দিতে সরকার ২০১০ সালে রেফ্রিজারেটর উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়। এ সুযোগ নিয়ে বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ফ্রিজ উৎপাদনে শিল্প গড়ে তোলে। বাহারি ডিজাইন, সাশ্রয়ী দাম, স্থায়িত্ব, বিদ্যুৎ সাশ্রয়, কম্প্রেসার ও বিক্রয়পরবর্তী সেবা দিয়ে বাজিমাত করেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, সরকারের নীতি সহায়তার কারণে দেশ আজ ফ্রিজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশীয় কোম্পানিগুলো স্থানীয় চাহিদা মেটাতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। কিন্তু বাজেটে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে এ শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করবে। আবারও দেশ আমদানিনির্ভর হয়ে পড়তে পারে। সরকারের যেখানে উচিত, আমদানিকৃত ফ্রিজের শুল্ক বাড়িয়ে দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া, প্রণোদনা বহাল রাখার মাধ্যমে রপ্তানির নতুন পণ্য হিসাবে ফ্রিজকে প্রমোট করা; উলটো সেখানে ভ্যাটের বোঝা চাপানোর প্রক্রিয়া চলছে। এ সিদ্ধান্ত স্থানীয় শিল্পবিরোধী।
যমুনা ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড অটোমোবাইলস লিমিটেডের পরিচালক (মার্কেটিং) সেলিম উল্যা সেলিম যুগান্তরকে বলেন, কালের পরিক্রমায় বিদেশি ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দেশি ব্র্যান্ডের রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার ক্রেতাদের কাছে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। অত্যন্ত আশার এবং সফলতার কথা হচ্ছে ২০১০ সালে যেখানে বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ মার্কেট শেয়ার ছিল বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর দখলে, এখন চিত্র পুরোপুরি উলটো। মাত্র ২০ শতাংশ শেয়ার বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর আর ৮০ শতাংশ মার্কেট শেয়ার দেশি ব্র্যান্ডগুলোর। সাশ্রয়ী মূল্য, গুণগত মান বজায় রাখার ফলে শহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিনদিন গ্রাম বা মফস্বলেও রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজারের ব্যবহার বাড়ছে।
ইলেক্ট্রো মার্ট গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আফছার বলেন, বর্তমানে দেশে দেশি ব্র্যান্ডের ফ্রিজের প্রতি মানুষের আস্থা সবচেয়ে বেশি। কারণ, আমাদের দেশের মানুষ সব সময় চিন্তা করে সাধ্যের মধ্যে একটি ভালো মানের রেফ্রিজারেটর কেনার। একমাত্র বাংলাদেশে তৈরি রেফ্রিজারেটরের মাধ্যমেই এই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। বিদেশি ব্র্যান্ডের দাম বেশির ভাগ মানুষের নাগালের বাইরে। দেশি ব্র্যান্ডের রেফ্রিজারেটরে একদিকে যেমন বিদেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে টেকনোলজিক্যাল আপগ্রেড করা হচ্ছে, তেমনই দামও সাধ্যের মধ্যে রয়েছে। যে কারণে দেশি ব্র্যান্ডের রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজারের প্রতি মানুষের আস্থা সবচেয়ে বেশি। ওয়ালটন রেফ্রিজারেটরের চিফ বিজনেস অফিসার তাহসিনুল হক বলেন, সব শ্রেণি-পেশা ও আয়ের মানুষের জন্য ওয়ালটনের রয়েছে শত শত ডিজাইন ও মডেলের রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার। এসব ফ্রিজ ১৫ হাজার থেকে শুরু করে ২ লাখ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে, আছে জিরো ইন্টারেস্টে ৬ মাসের সহজ কিস্তিসহ সর্বোচ্চ ৩৬ মাসের কিস্তি সুবিধা।