হযরত আদম আ. থেকে শেষ নবি মুহাম্মদ সা. পর্যন্ত সব নবি-রাসুলের ফিলিস্তিন ভূখ-ের সাথে সম্পৃক্ততা রয়েছে। কারো ভ্রমণের সাথে, কারো জন্মের সাথে, কারো পারিবারিক সূত্রে, কারো দীনি দাওয়াতের সাথে, কারো নবুয়তের সাথে। ফিলিস্তিনে অসংখ্য নবি-রাসুলের কবর আছে। ফিলিস্তিনের আবহাওয়া, জমি, পাহাড়-পর্বত, গাছপালা সবই বরকতময়। এখানকার জলবায়ু ও জমি ভালো ফসল উৎপন্নে সহায়ক। এই উর্বর জমি ইহুদিদের চাই। গত শতকের ত্রিশ দশকে পোল্যান্ড থেকে কয়েকজন ইহুদি এসে সর্বপ্রথম ফিলিস্তিনের কিবুটস এলাকায় কৃষি কাজ শুরু করে। দিন দিন ইহুদির সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আজ ইহুদিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, মুসলমানরা সংখ্যালঘু। তারা মাতৃভূমিতে উম্মুক্ত কারাগারে বন্দি।
আফ্রিকা, ইউরোপের সাথে এশিয়া মহাদেশের বাণিজ্যিক রুট ফিলিস্তিনি অঞ্চল। সে সুবাদে ফিলিস্তিন বিশ^ বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। ভৌগোলিক এ সুবিধার কারণে, বিশে^র জনগণনের উপর তারা চালাত সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক ক্ষমতার দাপট। তাদের হেদায়াতের জন্য আগমন করে অসংখ্য নবি-রাসুল। কুরআনে মুহাম্মদ সা. ব্যতীত ২৪ জন নবির নাম এসেছে, তারা সবাই বনি ইসরাইল বংশের। এ জন্য ইহুদিরা নিজেদের বিশে^র প্রাচীন সভ্য শিক্ষিত জাতি মনে করে।
ইউসুফ আ. এর ইন্তেকালের পর মিশরে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হারায়। দিন দিন তাদের অপরাধ বেড়ে যায়। মিশরের ফেরাউন তাদের দাসে পরিণত করে। ফেরাউন তাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা এবং মেয়ে সন্তানদের জীবিত রাখার নীতি গ্রহণ করে, যাতে তাদের বংশ ধ্বংস হয়। দীর্ঘ ৪০০ বছর পর মুসা আ. তাদের ফেরাউনের দাসত্ব থেকে মুক্তি করেন। তারা ফিলিস্তিনে এসে বসবাস শুরু করে। মুসা আ. এর মৃত্যুর পর তারা ওল্ড টেস্টামেন্ট বা তাওরাতের বিধান পরিবর্তন করে বিভিন্ন পাপে ডুবে যায়। তারা বায়তুল মুকাদ্দাসে মূর্তি রেখে পূজা ও ব্যবসা শুরু করে। তারা বাণিজ্যকাফেলা লুণ্ঠন করে। বিশে^র মানুষকে আফ্রিকা-ইউরোপে যেতে হলে তাদের কর দিয়ে যেতে হয়। তাদের অত্যাচার এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছে যে, আল্লাহপাক তাদেরকে কাফির বাদশা বখতে নসর দ্বারা শাস্তি দেন। বখতে নসর অসংখ্য ইহুদিকে হত্যা করে, কাউকে পঙ্গু করে, কাউকে বিতাড়িত করে। আর সত্তর হাজার ইহুদিকে বন্দি করে ইরাকের বাবেল নগরীতে নিয়ে আসে। তারা দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ হয়। তারা চরম দুর্ভোগে পড়ে। এটা ছিল ইহুদি জাতির প্রতি প্রথম রাষ্ট্রীয় শাস্তি। দু’শ বছর পর দাউদ আ. এর মাধ্যমে তারা বন্দিদশা থেকে মুক্তি পায়। তারা ফিরে পায় ফিলিস্তিনের শাসনক্ষমতা। সুলায়মান আ. এর নির্দেশে জেরুজালেমে ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ পুনঃনির্মাণ হলে ফিলিস্তিনের গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে ইহুদি জাতি ও তাদের শাসকগণের অত্যাচার, অবাধ্যতা ও নবি হত্যার অপরাধের পাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এজন্য কুরআনে তাদেরকে নিকৃষ্ট জাতি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তারা পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট।
বনি ইসরাইল বংশে সবশেষ রাসুল হিসাবে আগমন করেন ঈসা আ.। জেরুজালেমের ভূমিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে খৃস্টধর্ম। রোমের খৃস্টানশাসক জেরুজালেমকে দখল করেন। জেরুজালেমে ইহুদিরা হয় সংখ্যালঘু। প্রায় পাঁচশ বছর ধরে চলে খৃস্টান শাসন। এ জন্য খৃস্টানরা জেরুজালেমকে নিজেদের পবিত্রভূমি হিসাবে জ্ঞান করে। বায়তুল মুকাদ্দাসে তাদের পৃথক ইবাদত গৃহ আছে। যেমনটি আছে মুসলমান ও ইহুদিদের জন্য পৃথক পৃথক ইবাদতের স্থান। আর এ তিনটি ইবাদতের স্থান এখন ইহুদিদের হাতে। ইচ্ছা হলে ইবাদত করার জন্য মসজিদ বা গীর্জার দরজা খুলে দেয়, ইচ্ছা না হলে তালা ঝুলায়।
ইসলামের দ্বিতীয় খরিফা ওমর রা. এর হাতে জেরুজালেমের পতন হয়। জেরুজালেমের নেতৃত্ব আসে মুসলমানদের হাতে। বৃদ্ধি পেতে থাকে মুসলমানের সংখ্যা। বায়তুল মুকাদ্দাসকে প্রথম কেবলা ও পরে তৃতীয় পবিত্র মসজিদ হিসেবে ইসলামে স্বীকৃতি লাভ করে। ফিলিস্তিনের ভূখ-জুড়ে বসবাস করে মুসলমানরা। ইহুদিরা ছড়িয়ে পড়ে বিশে^র নানা প্রান্তে। তাদের কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল না। তারা বিভিন্ন দেশে কৃষি ও যাযাবর জীবনযাপন করতো।
ইহুদিরা খৃস্টান ধর্মকে বিপদগামী করার জন্য খৃস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দির প্রথমার্ধে সিয়োন (যা জায়ন বা জেরুজালেম নগরীকে নির্দেশ করে) নামে গোপন সংগঠন তৈরি করে, যার উদ্দেশ্য হলো ফিলিস্তিন ভূখ-কে কেন্দ্র করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। সে সময় ফিলিস্তিন শাসন করতো খৃস্টান। এ জায়ন সংগঠনটি খৃস্টধর্মালম্বীকে বিপদগামী করার জন্য খৃস্টধর্মকে বারো দলে বিভক্ত করে। জায়নিস্টদের চক্রান্তে খৃস্টধর্মে অন্তর্ঘাত শুরু হয়। আর ইহুদিরা ভোগ করতে থাকে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা।
তারা মুহাম্মদ সা. কে হত্যা করার জন্য বিষ প্রয়োগসহ নানা ষড়যন্ত্র করে। মুসলমানদের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করে। আবু বকর রা. এর খেলাফতের সময় ইসলাম ধর্মত্যাগী ভ- নবিদের উদ্ভব জায়নিস্টদেরই সৃষ্টি। তাদের মধ্যে একজন হলেন সাবাই ইহুদি। আবু বকর, ওমর, ওসমান ও আলী রা. এর শহীদ হওয়ার পিছনে এ সাবাই জায়নিস্টরা দায়ী। সাবাইরা শিয়া-খারেজী মতবাদ সৃষ্টি করে। আজ ইসলামে কাদিয়ানীসহ শতশত ভ- দলমত চলমান। ধর্মনিরপেক্ষতা, নাস্তিকতা, বিবর্তনবাদ বিশে^ ছড়িয়ে দেয় ইহুদিরা। এখন মুসলিম সমাজে তাদের মতবাদে বিশ^াসীর সংখ্যা অনেক। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ সৃষ্টির পিছনে যে লোকগুলো পিছন থেকে ইন্ধন যোগায় তারা ইহুদি। এ জন্যই তো হিটলার ৬০ লাখ ইহুদিকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আর কিছুকে বাঁচিয়ে রাখে যাতে বিশ^বাসী জানতে পারে ইহুদিরা কত খারাপ জাতি!
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র সৃষ্টি; ফিলিস্তিনের আকাশে দেখা দেয় কালোমেঘের ঘনঘটা। এ মেঘে সৃষ্টি হয় কখনও ঝড়ঝঞ্ঝা, কখনও কালবৈশাখী, কখনও আগুনবৃষ্টি, যা আজও চলমান। সে যাই হোক ইহুদিচক্র ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টি করে, যা মধ্যপ্রাচ্যে বিষফোঁড়া হয়ে আছে। বিশ^ব্যাপী ইহুদিদের মাঝে জাগরণ সৃষ্টি হয়। তারা দলে দলে ফিলিস্তিনে এসে জোরপূর্বক ভূমি দখল নিয়ে বসবাস শুরু করে। শুরু করে ফিলিস্তিনের ভূখ- থেকে মুসলমানদের উৎখাতের মিশন। ফ্রান্স, বৃটেন ও আমেরিকার শাসকরা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে অন্ধের মতো ইসরাইলের অপরাধ সমর্থন করে যায়। অর্থ, রসদ দিয়ে ইসরাইলকে সাহায্য করে। আর ফিলিস্তিনের মুসলমানরা তাদের সাপ-লুুডুর খেলায় দিনে দিনে জাতিগতভাবে নিঃশেষ হয়।
ইরান শিয়া রাষ্ট্র। বৈশি^কভাবে শিয়াদের অবস্থান দুর্বল। আরব-ইসরাইল যুদ্ধে সুন্নি রাষ্ট্রগুলো পরাজিত হলে মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া মতবাদ পাকাপোক্তের জন্য ইরান তার মিশন শুরু করে। লেবানন, সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে সৃষ্টি করে অনেক সশস্ত্র মিলিশিয়া সংগঠন। ইরান কামনা করে, ফিলিস্তিন ইস্যুকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নি রাষ্ট্রগুলোতে শিয়া মতবাদ ছড়িয়ে দিতে। সৌদি আরবসহ সুন্নি রাষ্ট্রগুলো ইরানের এ তৎপরতার বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। তারা ফিলিস্তিনের সংকট মুহূর্তে আমেরিকা, বৃটেনের সাথে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করে। মিশর ও কাতারের ভূমিকা সে দিকেই ইঙ্গিত করে। সিরিয়ায় শিয়া সরকারের পতনের পর সেখানে সুন্নি শাসক। শিয়া-সুন্নির লড়াইয়ের দৌড়ে ইসরাইল সিরিয়ার বিশাল এলাকা দখল করে। সিরিয়া থেকে ইসরাইলে হামলার খবর আর শোনা যায় না। বরং সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে ইসরাইল বার বার সিরিয়ায় হামলা চালায়। লেবাননের হিজবুল্লাহর রকেট বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে। গাজায় হামাসও দুর্বল। সেই সাথে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সুন্নি মতবাদের জয়জয়কার। বলা চলে শিয়া-সুন্নির এই মনস্তাত্বিক লড়াইয়ে সুন্নিরা জয়ী হয়েছে। কিন্তু ইহুদিরা হয়েছে লাভবান। লেবানন, পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরাইলি রাষ্ট্রের সম্প্রসারণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গোলান মালভূমিসহ সিরিয়ার অনেক দখল হয়েছে। সেখানে বাফার জোন তৈরি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। যুদ্ধ বিরতি লঙ্ঘন করে ইসরাইল লেবাননের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে বারবার হামলা করে। লেবানন সরকার নির্বাক হয়ে শুধু বিবৃতি দেয়। পাল্টা হামলা করার সাহস পায় না। ইসরাইল রাষ্ট্রের চতুর্দিকে মিশর, জর্ডান, সিরিয়া, লেবাননে অবস্থানরত সশস্ত্র মিলিশিয়া সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে আর হুমকি, হামলা আসে না। অভ্যন্তরীণভাবে গাজা ও পশ্চিম তীর থেকে যে হামলাগুলো আসে তা নৃশংসভাবে দমন করার চরিত্র দেশটির আছে, যার চিত্র গাজায় লক্ষ করা যায়। গাজা এখন বিশে^র বড় কবরস্থান।
ভৌগোলিকভাবে ইয়েমেন ও ইসরাইলের অবস্থান অনেক দূরে। ইয়েমেনের হুতিরা শিয়া মতবাদে বিশ^াসী। এবার হুতিরা মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখার জন্য ইয়েমেন থেকে ড্রোন, ব্যালেস্টিক ও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরাইলে আঘাত করে। লোহিত সাগরে বাব আল মান্দাব দিয়ে ইসরাইল, আমেরিকা ও বৃটেনের বাণিজ্য জাহাজ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তাদের বাণিজ্য জাহাজে হামলা করে। আমেরিকার বিমানবাহী রণতরীতে হামলা করে। উদ্দেশ্য একটাই তা হলো গাজায় হামলা বন্ধ করা। এতে চটে গেছে আমেরিকা ও বৃটেন। হুতিদের শায়েস্তা করার জন্য আমেরিকা, বৃটেন, ইসরাইল বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন হামলা শুরু করে। ধ্বংস হচ্ছে ইয়েমেন, আহত ও মারা যায় সাধারণ মানুষ। এ লড়াইয়ে হুতিরা তাদের সাথে পারবে না, এটা সবাই জানে। তবুও তাদের বেঁচে থাকার লড়াই। ইসলামের পক্ষে গাজাবাসীকে রক্ষার লড়াই। ইহুদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই। সৌদি আরবসহ অন্যান্য সুন্নি আরব রাষ্ট্র হুতিদের উপর আমেরিকা-বৃটেনকে হামলা করার জন্য পরক্ষভাবে সমর্থন করে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে রয়েছে আমেরিকার ১০টি সেনাঘাঁটি।
ইয়েমেনে হুতিদের শায়েস্তা করার পর আমেরিকার পরবর্তী টার্গেট ইরান। ট্রাম্প ইরানে বোমা হামলার হুমকি দিয়েছে। ইরানে হামলা হলে মধ্যপ্রাচ্যে আরেক সংকট সৃষ্টি হবে। আর এর ফায়দা নেবে আমেরিকা, বৃটেন ইসরাইল ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইসরাইল গ্রাস করবে আরবভূখ-। আর যুদ্ধে যুদ্ধে মুসলমানরা হবে দুর্বল। ইহুদিদের পদতলে মুসলমানদের ভাগ্য চক্রাকারে ঘুরতে থাকবে।
বর্তমানে ফিলিস্তিন মৃত্যুপুরি। আবাসিক ভবন, মসজিদ, গীর্জা, মন্দির, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাটির সাথে মিশে গেছে। ইসরাইল হামাসকে গাজা থেকে উৎখাতের নামে লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে গৃহহীন করেছে, হত্যা করেছে, আহত করেছে, পঙ্গু করেছে। আর আরব বিশ^ মায়াকান্না করছে। ওআইসি, আরবলীগ নিতে পারছে না জোরালো পদক্ষেপ। কেননা সংস্থা দু’টোর অধিকাংশ রাষ্ট্রপ্রধান কোন না কোনভাবে আমেরিকার মদদপুষ্ট। গদি বাঁচাবে, না ফিলিস্তিন বাঁচাবে, এটাই তাদের চিন্তা। ফিলিস্তিনিদের মুখে হাসি ফুটাতে নিজের বিপদ কেন ডেকে আনবে?
হামাস-ইসরাইল যুদ্ধবিরতি হয়, আবার ভেঙে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা, নারীধর্ষণ, উচ্ছেদের পর নেতানিয়াহু বলেন, ‘যুদ্ধ কেবল শুরু’। ট্রাম্প চায় গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের মিশর ও জর্ডানে পুনর্বাসন করতে। তিনি গাজায় তৈরি করবেন বিশাল রিসোর্ট। উপার্জন করবেন অর্থ। ট্রাম্পের এ উক্তির পরও মুসলিম দেশগুলোর বোধদয় হয় না।
ইরাক-ইরান যুদ্ধ, সিরিয়া-ইরাকে আইএস-এর উত্থান ও লড়াই ইহুদিবাদীদের চক্রান্তের ফল। তারা চায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে দুর্বল থাক। সাদ্দাম ও আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে পরমাণু অস্ত্রের অজুহাত তুলে ইরাক ও সিরিয়ায় গায়ে পড়ে হামলা ইতিহাসের নির্লজ্জ ট্রাজেডি। আজ আমেরিকা জোট সেই একই সুরে ইরানে পরমাণু অস্ত্রের অজুহাত তুলে বোমা হামলার হুমকি দিচ্ছে। ইরানও পাল্টা হুমকি দিচ্ছে; আবার মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধের দ্বার প্রান্তে। আমেরিকা একটা যুদ্ধবাজ দেশ। তারা অস্ত্র ব্যবসাকে পুঁজি করে অর্থ উপার্জন করে। সম্প্রতি সিপ্রি (STOCKHOLM INTERNATIONAL PEACE RESEARCH INSTITUTE) বিশে^র অস্ত্র ব্যবসায়ী শীর্ষ ১০০টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা করেছে; যার ৪২টি আমেরিকার। এ অস্ত্র ব্যবসা থেকে আমেরিকা বৈশি^ক অস্ত্র-বাণিজ্যের ৫১% আয় করে থাকে। ইরাক ও সিরিয়ার তেল খনিগুলোর নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। সেখানে তাদের সৈন্য ঘাঁটি আছে। এভাবে ইউক্রেনে অস্ত্র সহযোগিতা করে ঋণের বিশাল বোঝা দেশটির জনগণের উপর চাপিয়ে অসম বাণিজ্য চুক্তি করতে বাধ্য করেছে। আমেরিকার দরকার অর্থ। কোথায় কত মানুষ নিহত হবে, কত ভবন ধ্বংস হয়ে সমতল হবে, কত চোখের পানিতে সাহারা সিক্ত হবে তা তার দেখার বিষয় নয়। রাশিয়া ও চীন আমেরিকার বিরুদ্ধে এসব যুদ্ধে চেচামেচি করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু করে না। আজ ফিলিস্তিনের জনগণ শকুনের খাবার। গাজাকে নিয়ে গাজাখোরি কারবার চলছে।
গাজা ও পশ্চিম তীর থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে ইসরাইল রাষ্ট্র সম্প্রসারণ করার প্রক্রিয়া চলমান। আমেরিকা, বৃটেন ও ইসরাইলের গোয়েন্দা শক্তি অনেক উন্নত। তারা এ শক্তি ব্যবহার করে যে কোনো দেশে বিজয় অর্জন করতে পারে। কিন্তু ভৌগোলিকভাবে ক্ষুদ্র গাজায়, ক্ষুদ্র হামাসের হাতে কয়েকজন বন্দিকে উদ্ধার করতে না পারা কী তাদের ব্যর্থতা? নেতানিয়াহু গাজার ভূমি তামায় পরিণত করে। ইহুদিরা চায় গাজাকে নিজেদের ভূখ-ের সাথে একত্রিত করার। সাধারণ ফিলিস্তিনির উপর হামলা, তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করা, হাসপাতাল ধ্বংস করা, ওষুধ-খাদ্য সামগ্রী পৌঁছাতে বাধা দেয়া, দৌড়ের মধ্যে রাখা-সবগুলোর পিছনে একটাই উদ্দেশ্য আর তা হলো ফিলিস্তিনের ভূমি থেকে মুসলমানদের তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে ইহুদি বসতি বৃদ্ধি করা। বিশে^র মানচিত্র থেকে গাজা-ফিলিস্তিনের নাম মুছে দেয়া।
ইসরাইলের অপরাধ আন্তর্জাতিক আদালতে প্রমাণিত হওয়ায় নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা জারি করেছে। এতে আমেরিকা ক্ষেপে গিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আইনের শাসনকে কবর দিয়েছে। বৈশি^কভাবে আমেরিকা নিজের ঘৃণ্যচরিত্র প্রকাশ করেছে। ইসরাইলকে রক্ষা করাই তার লক্ষ্য। এর কারণ হলো আমেরিকার অর্থনীতির অধিকাংশই নিয়ন্ত্রণ করে ইহুদিরা। সম্প্রতি ফোর্বস সাময়িকির জরিপে দেখা যায়, বিশে^র শীর্ষ ১০ জন ধনীর মধ্যে সাতজনই মার্কিন ইহুদি। বাকি তিনজন খৃস্টান। অপরদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের সিনেটে ১০ জন ইহুদি এবং কংগ্রেসে ৭.৫% ইহুদি সদস্য আছে। তাই আমেরিকার কাছ থেকে ধোকা, বিশ^াসঘাতকতা, মিথ্যাচার, নির্যাতন, মুসলিম নিধন ও ইহুদিপ্রীতি ছাড়া ভালো কিছু আশা করা যায় না। আমেরিকা, বৃটেন ও ইসরাইলের ষড়যন্ত্র এখনই রুখে না দিলে এর প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে পড়বে। মুসলিম বিশ^ হবে দ্বিধাবিভক্ত। ইসরাইল ফিলিস্তিন, লেবানন ও সিরিয়ার অনেক অঞ্চল নানা অজুহাতে একের পর এক দখল হয়ে যাবে। আর এই অপকর্মকে স্বীকৃতি দেবে আমেরিকা জোট।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুসলিম স্কলার্স ইউনিয়নের (আইইউএমএস) মহাসচিব আলী আল-কারদাঘি মুসলিমদের উদ্দেশ্যে জারি করা ফতোয়ায় সব মুসলিম দেশকে ‘গাজার গণহত্যা এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধে অবিলম্বে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করার আহবান জানিয়েছেন। ইহুদি রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে তিনি ১৫টি বিষয়ে ফতোয়া জারি করেন। তার আহবানে বিশে^র সাধারণ মুসলিমগণ সাড়া দেবে। কিন্তু মুসলিম রাষ্ট্রনায়কগণ ইসরাইলের সাথে সংঘাতে জড়াবে কি? ফতোয়ার ১৫টি ধারা বাস্তবায়ন করবে কি?
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক।