নরেন্দ্র মোদীর মতো নেতা কমই আছেন, যারা নিজেদের ব্যাপারে খুব ভালো বিজ্ঞাপন করতে পারেন।

২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি নিজেকে তুলে ধরতে চেয়েছেন শক্তিশালী ও দৃঢ় ভারত গড়ার কারিগর হিসেবে।

তিনি ভারতের অর্থনীতির বড় ধরনের প্রবৃদ্ধির কৃতিত্ব নিজের বলে দাবি করেন। আর যখন খারাপ কিছু হয়, তার পুরো দায় চাপিয়ে দেন পূর্বসূরীদের ঘারে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী টাইমের এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদন বলছে, ভারতীয় ভোটারদের একটা প্রজন্ম এটা বিশ্বাসও করে যে, বিশ্ব মঞ্চে তাদের ক্রবর্ধমান যে আধিপত্য, সেটা মোদীর কারণেই সম্ভব হয়েছে।

কিন্তু এর মধ্যে সামনে হাজির হন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প, যিনি মোদীর সেই বিজ্ঞাপনে বিঘ্ন ঘটিয়েছেন।

বুধবার ট্রাম্প ঘোষণা দেন, চুক্তিতে না এলে বিশ্বের চতুর্থ অর্থনীতির দেশ ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসানো হবে।

এর মানে দাঁড়ালো, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য বেচতে যেসব দেশকে চড়া শুল্ক দিতে হয়, ভারতও এখন সে তালিকায় যুক্ত হতে যাচ্ছে।

মোদীর সঙ্গে যে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ সম্পর্ক, তাতে ট্রাম্পের শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণায় অনেকে অবাক হয়েছেন।

মোদী ও ট্রাম্প—দুজনের মধ্যে আদর্শগত অনেক মিল রয়েছে এবং একসময় একে অপরের গুণগানও করেছেন।

গেল জানুয়ারিতে ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্ব নেতাদের মধ্যে মোদীই প্রথম হোয়াইট হাউস সফরে গিয়েছিলেন।

পরের মাসে যখন আবার গেলেন, তখন ট্রাম্পকে সম্বোধন করলেন ‘ভালো বন্ধু’ হিসেবে। আর দুজন মিলে প্রতিশ্রুতি দিলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে নেওয়া হবে ৫০ হাজার কোটি ডলারে।

কিন্তু সেই সম্পর্কে বড় ধরনের চিড় ধরে গেল জুলাইয়ের শেষদিকে, যখন ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। সেই ২৫ শতাংশই আবার বুধবার দ্বিগুণ করার ঘোষণা দেন তিনি।

রাশিয়া থেকে ভারতের তেল কেনার ঘটনায় ট্রাম্প এমন সময় মনোযোগ দিলেন, যখন ইউক্রেইনের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে মস্কোকে বেঁধে দেওয়া সময়সীমা ফুরিয়ে আসছে।

টাইম বলছে, ২৭ অগাস্ট থেকে কার্যকর হতে যাওয়া এ শুল্ক মার্কিন বাজারকে খুব একটা সুরক্ষা দেবে না। কিন্তু তারা এমন একটি দেশকে সাজা দেবে, যারা আমদানি করা তেলের ৩৬ শতাংশ রাশিয়া থেকে কেনে।

তিন বছর আগে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর আগে এই হার ছিল সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ২ শতাংশ।

ভারত তাদের জ্বালানি তেলের ৮০ শতাংশের বেশি আমদানি করে। ফলে রাশিয়াকে বাদ দিয়ে আশপাশে বিকল্প কোনো বাজার খুঁজে বের করা এবং সাশ্রয়ী মূল্যে তেল পাওয়াটা তাদের জন্য বেশ কঠিন।

টাইম বলছে, ট্রাম্পের শুল্ককে ভারতের ‘অন্যায্য’ বলে প্রত্যাখ্যান করার পেছনে সম্ভবত এটাও একটা কারণ।

আবার ইউরোপের প্রতি ট্রাম্পের ভিন্ন নীতিও নয়াদিল্লির ক্ষোভের একটা কারণ হতে পারে।

ভারত তাৎক্ষণিক এটা সামনে এনেছে যে, ইউরোপের দেশগুলো ঠিকই রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনছে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।

নয়াদিল্লি এটাও বলছে, বৈশ্বিক বাজার স্থিতিশীল রাখতে এই যুক্তরাষ্ট্রই তাদেরকে রাশিয়ার কাছ তেল কেনার ব্যাপারে একসময় সমর্থন জুগিয়েছিল।

ছবি: রয়টার্স।

রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা অব্যাহত থাকবে কিনা, নয়াদিল্লির কাছ থেকে এখন সেই জবাব শোনার অপেক্ষায় আছেন ভারতের স্থানীয় তেল পরিশোধনকারীরা।

নয়াদিল্লি এখনো সে জবাব দেয়নি। কিন্তু ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা রাশিয়া সফরে আছেন। আর রাশিয়ায় গিয়ে তিনি বলেছেন, চলতি বছরের শেষ দিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভারত সফর করবেন।

এছাড়া মোদীর ঘনিষ্ঠ কিছু কর্মকর্তা কয়েক দিনের মধ্যে রাশিয়া সফরে যাবেন, এমন কথাও শোনা যাচ্ছে।

মোদী সরকার যেভাবেই প্রতিক্রিয়া দেখাক না কেন, একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে। সেটা হলো— মোদী যতটা ঘনিষ্ঠ ভাবতেন, ট্রাম্প ততটা ঘনিষ্ঠ বন্ধু নয়; ব্যক্তিগত সম্পর্কের রসায়ন কখনো বৈশ্বিক স্বার্থের হিসাব-নিকাশকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না।

রাশিয়ার কাছ তেল কেনাটাই অবশ্য একমাত্র কারণ নয়। অন্যান্য বাণিজ্য, শুল্ক ও ভূরাজনীতি নিয়েও ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

ট্রাম্প চাচ্ছেন, বিভিন্ন দেশ থেকে কারখানাভিত্তিক কর্মসংস্থান যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসুক। অন্যদিকে ‘মেইক ইন ইন্ডিয়া’ প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে মোদী চাইছেন, মার্কিন কোম্পানিগুলো যেন চীন থেকে ভারতে চলে আসে।

মোদীর এ দৃষ্টিভঙ্গি খুব স্বাভাবিকভাবেই ট্রাম্পের ‘আমেরিক ফার্স্ট’ নীতির সঙ্গে যায় না। আবার পাকিস্তানের প্রতি ট্রাম্পের হঠাৎ ঝুঁকে পড়াটাও ভারতের ক্ষুব্ধ হওয়ার একটি কারণ।

গেল জুনে হোয়াইট হাউসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে আথিতিয়েতা দেন ট্রাম্প। সম্প্রতি পাকিস্তানের সঙ্গে তেল অনুসন্ধানের চুক্তির ঘোষণাও দেন তিনি।



মে মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার চার দিনের যুদ্ধের ইতি ঘটানোর কৃতিত্ব দাবি করেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের এমন দাবিও নয়াদিল্লি ভালোভাবে নেয়নি।

যে দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে কয়েকবার যুদ্ধে জড়িয়েছে, যে দেশের কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে দুই দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের জন্য ট্রাম্পের এসব পদক্ষেপের কোনোটিই মেনে নেওয়া সহজ নয়। ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত দুই দেশের সম্পর্কের ভিতকেই নাড়িয়ে দিয়েছে।

ভারতের অর্থনীতি নিয়ে যে ধারণা ছিল, ট্রাম্পের মন্তব্য তাতেও আঘাত হেনেছে। গেল সপ্তাহে তিনি ভারতের অর্থনীতিকে ‘মৃত’ বলে অভিহিত করেছেন। বিশৃঙ্খলতা থেকে মোদী সুবিধা নেন, এমন কথাও বলেছেন তিনি।

ভারতের পতাকা, ডনাল্ড ট্রাম্প আর শুল্ক লেখা শব্দের একটি থ্রিডি-প্রিন্টেড মডেল। ছবি: রয়টার্স

সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে মোদী বেশ কিছু দিন চুপচাপই ছিলেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার মার্কিন শুল্কের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের কৃষকের স্বার্থের বিষয়ে তিনি কোনো আপস করবেন না।

কিন্তু সামনে তার জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত অপেক্ষা করছে। তিনি যদি ট্রাম্পের কাছে কোনো ধরনের নতি স্বীকার করেন, তাহলে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ক্ষতির মুখে পড়বেন।

আর যদি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নিতে যান, তাহলে সেটা নিজেদের অর্থনীতির জন্য আরও বিপদ ডেকে আনতে পারে।

ভারত এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ভারতের আট হাজার ৬০০ কোটি ডলারের রপ্তানি পণ্যের বড় একটা অংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। ২০ দিন পর নতুন শুল্ক কার্যকর হলে তাদের এই রপ্তানি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে।

শুল্ক নির্ধারণে ট্রাম্প প্রায়ই স্বেচ্ছাচারী আচরণ করেন। তবে নিয়মিতভাবে এই হারে পরিবর্তনও আনেন তিনি। সেক্ষেত্রে কখনও পিছু হটেন; কখনও হয়ে ওঠেন আরও আক্রমণাত্মক।

ঘরের রাজনীতিতে মোদীর আরও ঝুঁকি রয়েছে। বিরোধীরা মার্কিন শুল্কের বিষয়টি ব্যবহার করে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছেন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে একতরফা বলছেন, যা মোদীর জন্য কোনো চুক্তিতে যাওয়াটা কঠিন করে তুলেছে।

ট্রাম্পের শুল্কের মাধ্যমে ভারতের অন্তত এই শিক্ষা হলো— উষ্ণ আলিঙ্গন নয়, নীতি চলে স্বার্থের হিসাবে; আর ট্রাম্পের কাছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, চুক্তির নন্দনত্ত্বই সবচেয়ে বড় বিষয়।

মোদী হয়ত ভেবেছিলেন— তিনি ট্রাম্পকে খুশি রাখতে পারবেন; কেবল প্রশংসা করলেই ট্রাম্পের মন পাওয়া যাবে। কিন্তু মোদীর সেই ধারণা শেষমেশ টিকল না।

আরও পড়ুন

ভারতীয় পণ্যে আপাতত 'না' অ্যামাজন, ওয়ালমার্ট, টার্গেট ও গ্যাপের

‘গুণ্ডাকে ছাড় দিলে মাথায় চড়ে,’ ভারতের ৫০% শুল্ক নিয়ে ট্রাম্পকে কটাক্ষ চীনা রাষ্ট্রদূতের

শুল্ক বিরোধ না মিটলে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা নয়: ট্রাম্প

ট্রাম্পের ৫০% শুল্ক এড়াতে সময় আছে ২০ দিন, কী করবে ভারত?



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews