উৎসমূল থেকে বাংলাদেশের সাহিত্যে

‘জাদুবাস্তববাদ’ বলতে আমরা প্রধানত লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের কথা বুঝলেও শিল্পের পরিভাষা হিসেবে শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় জার্মান ভাষায়। তাও সাহিত্য নয়, চিত্রকলায়। জার্মান ইতিহাসবিদ, ফটোগ্রাফার এবং শিল্প-সমালোচক ফ্রানৎস রোহ ১৯২৫ সালে তাঁর একটি গ্রন্থের নাম দেন: ‘ম্যাজিক রিয়েলিজম: পোস্ট এক্সপ্রেশনিজম’, অর্থাৎ ‘জাদুবাস্তববাদ : উত্তর অভিব্যক্তিবাদ’। দুটি বিশ্বযুদ্ধের যে ভয়াবহতা এবং জীবনের যে ভয়ংকর পরিণতি অভিব্যক্তিবাদ তা থেকে মুক্তি চেয়েছিল। মানুষকে অতিকল্পনা ও স্নিগ্ধতার মধ্যে টেনে নেয়ার চেষ্টা করছিলেন শিল্পীরা। রোহ এই প্রয়াসের নাম পড়ালেন ‘জাদুবাস্তববাদ’। কিন্তু রোহের ধারণাটি সাহিত্যে এসে পরিবর্তিত ও বিবর্তিত হলো। বাস্তবতাকে দূরে নয়, বরঞ্চ আরও নৈকট্যে আনার জন্য একটি বিশেষ ধরনের আখ্যানশৈলী হিসেবে সাহিত্যে এটি ব্যবহৃত হতে থাকে। শব্দটি স্প্যানিশ সাহিত্যে প্রথম আসে হোসে ওর্তেগার মাধ্যমে। তিনি ১৯২৭ সালে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায় রোহের প্রবন্ধটি স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করেন। তবে জাদুবাস্তববাদ চর্চিত বিষয় হয়ে ওঠে আরও দুই দশক পরে, আলেহো কার্পেন্তিয়েরের মাধ্যমে। ১৯৪৯ সালে আলেহো কার্পেন্তিয়ের উপন্যাস ‘দি কিংডম অব দিস ওয়ার্ল্ড’ প্রকাশিত হয়। সেই বইয়ের ভূমিকাতে তিনি প্রথম সাহিত্যের ন্যারেটিভ টেকনিক হিসেবে জাদুবাস্তববাদকে সংজ্ঞায়িত করেন। একই সময় অস্ট্রেলিয়ান লেখক জর্জ সেইকো তাঁর কোয়াসি-সারেরিয়েলিস্টিক উপন্যাসকে ‘ম্যাজিক রিয়েলিজম’ নামে আখ্যায়িত করলেও তিনি এ সম্পর্কে কোনো তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেননি। ফলে কার্পেন্তিয়েরকেই আমরা জাদুবাস্তববাদের প্রথম তাত্ত্বিক হিসেবে পাই। কার্পেন্তিয়ের বলেন : জাদুবাস্তবতার ধারণায় যে বাস্তবতা সেটি একমাত্র লাতিন আমেরিকাতেই আছে। ইউরোপে আঁদ্রে বিটন কর্তৃক উদ্ভাবিত যে সুররিয়ালিজম বা ফ্রানৎস রোহ কর্তৃক প্রস্তাবিত অভিব্যক্তিবাদ সেটি আসলে মস্তিষ্কসৃজিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের অতিরিক্ত মস্তিষ্কচর্চাজনিত মস্তিষ্কবিকারের ফল। অর্থাৎ ইউরোপের জাদুবাস্তববাদ নির্মিত আর লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তববাদ যাপিত। লাতিন আমেরিকার সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনধারা নির্ধারণ করে দিয়েছে এই অঞ্চলের সাহিত্যের আখ্যানরীতি বা বর্ণনাকৌশল। এখানে মানুষ বিশ্বাস করে অশরীরী অস্তিত্বে। ইউরোপ যেটা নিয়ে ফ্যান্টাসি করে। জাদুবাস্তববাদ ধারণার উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে কথা বলতে গেলে অভিব্যক্তিবাদের পাশাপাশি চলে আসে পরাবাস্তববাদের প্রসঙ্গ। সংগঠিত ইউরোপীয় শিল্প-আন্দোলন হিসেবে পরাবাস্তববাদের প্রকাশ ঘটে বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। শুরুতে চিত্রকলা হয়ে অন্যান্য শিল্পমাধ্যমে প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে আলোচনায় আসে। 

পরাবাস্তববাদে চেতন এবং অবচেতনের একটা বন্ধন গড়ে ওঠে। অন্যভাবে বলা যায়, স্বপ্নের সঙ্গে জাগতিক বিষয় যুক্ত হয়ে স্বপ্নবাস্তবতার সৃষ্টি করে। বিষয়টা ভীষণভাবে ব্যক্তিগত। কিন্তু জাদুবাস্তবতার বিষয়টি যতটা না ব্যক্তিমুখী তার চেয়ে বেশি সমাজমুখী। পরাবাস্তব এবং জাদুবাস্তব উভয় ক্ষেত্রে জাদুময়তা ও বাস্তবতার মিশেল থাকতে পারে। কিন্তু পার্থক্য হলো, একটা জগৎ আমাদের মনের ভেতর তৈরি হয়, অন্যটা তৈরি হয় আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলে। জাদুবাস্তবতায় আমাদের চারপাশের চেনাজানা জগতে হঠাৎ করেই অচেনা বা কল্পলোকের কোনো বিষয় উপস্থাপন করা হয়। বলার স্বর থাকে খুবই স্বাভাবিক, যেন সত্যিই এমনটা ঘটছে, যেন এমনটি ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পাঠক তাতে আশ্চর্য হলেও গল্পের চরিত্ররা আশ্চর্য হয় না। এক সাক্ষাৎকারে লাতিন জাদুবাস্তবতার অন্যতম ওস্তাদ গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এ সম্পর্কে বলেন : যখন আপনি বলবেন, হাতি আকাশে উড়ছে, মানুষ আপনাকে বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আপনি যদি বলেন, ৪২৫টি হাতি আকাশে উড়ছে, লোকজন আপনাকে বিশ্বাস করবে। অর্থাৎ অবাস্তব ঘটনাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হলে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার ভেতর চলে যেতে হবে। পাঠক তখন ধরে নেবেন বিষয়টি সত্যিই ঘটছে বা ঘটেছে। উদাহরণ হিসেবে মার্কেসের ‘আ ভেরি ওল্ড ম্যান উইথ ইনরমাস উইংস’, নিকলাই গোগলের ‘দ্য নোজ’, মুরাকামির ‘দ্য এলিফেন্ট ভ্যানিশেস’ গল্পগুলোর কথা বলা যেতে পারে। প্রথম গল্পে বাস্তবজীবনে হঠাৎ করেই হাজির হয় ডানাওয়ালা মানুষ। গ্রামের মানুষ ভিড় করে দেখতে থাকে। দ্বিতীয় গল্পে এক ব্যক্তি হঠাৎ করে উপলব্ধি করেন তার নাক উধাও হয়ে গেছে। এরপর সে বিভিন্ন জায়গায় নাকের সন্ধান চালাতে থাকে। একদিন দেখে, তার নাক অফিসের পোশাক পরে অফিস করতে যাচ্ছে। নাক একেবারে ব্যক্তির মতো চলাফেরা করছে। অন্যদিকে যে ব্যক্তির নাক হারিয়েছে তাকে দেখে মনে হচ্ছে না কোনোদিন তার নাক ছিল। হাতি উধাও গল্পে, হঠাৎ কড়া প্রহরায় থেকেও একটা জলজ্যান্ত হাতি উধাও হয়ে যায়। কোথাও সন্ধান মেলে না। অন্যদিকে, পরাবাস্তব সাহিত্যে অবাস্তব ঘটনার কোনো যৌক্তিক প্রেক্ষাপট থাকে না। স্বপ্নে যেমন ঘটে যাওয়া ঘটনার ভেতর কোনো যৌক্তিক সম্পর্ক বা বিন্যাস থাকে না, এবং সবকিছু কেমন বিবর্ণ মনে হয়, তেমনি এখানেও ঘটনা ও ভাষায় সেই অযৌক্তিকতা থাকে। কাঠামো বা অবয়বহীনভাবে উপস্থাপিত হয় গল্পটি।
জাদুবাস্তববাদের সঙ্গে তাই পরিষ্কারভাবে অভিব্যক্তিবাদ ও পরাবাস্তববাদের পার্থক্য আছে। মিথ, লোকগল্প, ফেবল-প্যারাবল, ভৌতিক গল্প, ফ্যান্টাসি ইত্যাদি ছোটগল্পের কাঠামোকেও কেউ কেউ জাদুবাস্তববাদ হিসেবে উপস্থাপন করেন। অথচ এ ক্ষেত্রে পার্থক্য সুস্পষ্ট। রূপকথায় যা ঘটে সবকিছু প্রায় জাদুময়। গল্পের কাঠামো, সেটিং, টোন, বিষয়বস্তু সবকিছু মিলে একটা অবাস্তব পরিস্থিতি তৈরি করে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, জাদুবাস্তবতা হলো ‘fantastic elements with realistic details’ । ঠিক এর বিপরীতে বলা যেতে পারে রূপকথা হলো ‘realistic elements with fantastic details’; যে কারণে ‘অ্যারাবিয়ান নাইটস’,‘লর্ড অব দ্য রিংস’ বা ‘নারনিয়া’, ‘হ্যারি পটার’ সিরিজ ফ্যান্টাসি হিসেবে চিহ্নিত হয়। 

লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপীয় আধুনিক জাদুবাস্তববাদের ঐতিহ্যের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখব, লাতিন আমেরিকায় উপন্যাসের জন্ম হয় সার্ভেন্তেসের স্যাটায়ারধর্মী উপন্যাস ‘দন কিহোতে’র মাধ্যমে। ১৬০৫ সালে এটি প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে ইউরোপে আইরিশ লেখক জোনাথন সুইফটের স্যাটায়ারধর্মী উপন্যাস ‘গ্যালিভার্স ট্রাভেলস’ প্রকাশিত হয় ১৭২৬ সালে। দুই মহাদেশের এই দুটি আদি উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই: ‘দন কিহোতে’ উপন্যাসের ভেতর জাদুবাস্তববাদের বীজ অঙ্কুরিত অবস্থায় আছে, অন্যদিকে ‘গ্যালিভার্স ট্রাভেলস’-এ আছে ফ্যান্টাসির বীজ। দুটি উপন্যাসের উদ্দেশ্য ও গন্তব্য এক হলেও প্রকাশভঙ্গির ক্ষেত্রে এভাবেই তারা আলাদা যাত্রাপথ বেছে নিয়েছে। এর পেছনে দুই মহাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় বিশ শতকে এসে জাদুবাস্তববাদের তেমন বিকাশ ঘটেনি, যতটা ঘটেছে ফ্যান্টাসি সাহিত্যের। এর জন্য শুধু সাহিত্যিক ঐতিহ্য ও সামাজিক বাস্তবতা না, পাশাপাশি শিল্পের বাজারও একটি বড়ো ভূমিকা পালন করেছে। এই কারণে পরিষ্কারভাবেই গুন্টার গ্রাসের ‘টিন ড্রাম’ কিংবা সালমান রুশদির ‘মিডনাইট চিলড্রেন’-এর জাদুবাস্তববাদ আর হুয়ান রুলফোর ‘পেদ্রো পারামো’ কিংবা গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড’-এর জাদুবাস্তববাদ এক না। লাতিন আমেরিকার সাহিত্য যেটা ন্যারেটিভের বাস্তবতা, ইউরোপীয় সাহিত্যে সেটা হয়ে উঠেছে ‘লিটারারি টেকনিক’। 

ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকা থেকে আমরা যদি এবার ভারতবর্ষে আসি, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বাংলা সাহিত্যে, এখানে আবার জাদুবাস্তববাদের আরেক রূপ দেখতে পাবো। লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তববাদ যদি হয় সহজাত এবং ইউরোপীয় জাদুবাস্তববাদ নির্মিত বা মস্তিষ্কসৃজিত, তাহলে বাংলা সাহিত্যে সেটা অনেকাংশে হয়ে উঠেছে অনুকৃত। বাংলা ভাষায় আধুনিক উপন্যাসের ধারা প্রতিষ্ঠিত হয় ইউরোপীয় উপন্যাসের আদলে। বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশনন্দিনী’, প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ সালে। এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে জনপ্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়– প্রত্যেকে বাস্তববাদী ধারার উপন্যাস রচনা করেছেন। চার্লস ডিকেন্স, জর্জ এলিয়ট, শার্লট ব্রন্টি, টমাস হার্ডি, উইলিয়াম ম্যাকপিস থ্যাকারে, এলিজাবেথ গ্যাসকেল, এমিলি ব্রন্টি, অ্যান ব্রন্টি, সামুয়েল বাটলার, হেনরি জেমস প্রমুখ ইংরেজি ভাষার ঔপন্যাসিকদের প্রভাব এ ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

এই প্রভাব থেকে কেউ কেউ আবার বের হওয়ার চেষ্টাও করেছেন। জগদীশ গুপ্তের কথা বলা যায়। তাঁর ‘দিবসের শেষে’ গল্পটির কাহিনি সাহিত্যের পাঠকদের কাছে অজানা নয়। রবীন্দ্রকালে এ রকম বিচ্ছিন্নভাবে জাদুবাস্তবতার বীজ কারও কারও লেখার মধ্যে অঙ্কুরিত অবস্থায় থাকলেও সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয়নি। বাংলা সাহিত্যে সচেতনভাবে জাদুবাস্তববাদের চর্চা শুরু হয়েছে আরও অনেক পরে। সম্ভবত ষাটের দশকে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে বুম-জেনারেশনের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় জাদুবাস্তববাদের বিষয়টি পরিচিতি লাভ করে। এ সময় লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের সহজাত লোকায়ত জাদুবাস্তববাদ এবং জাদুবাস্তববাদের ইউরোপীয় ধারণার সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতীয় পুরাণ ও লোকায়ত সাহিত্যের ঐতিহ্য। এই কারণে বাংলাদেশের জাদুবাস্তববাদ লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তববাদের মতো সম্পূর্ণ মৌলিক বা ‘লোকাল’ না। এর কারণ, ভারতীয় ঐতিহ্যে রামায়ণ, মহাভারত, অষ্টপুরাণ, লোকবিশ্বাস, লোকায়ত ধর্ম, জাতকের গল্প– প্রভৃতির মধ্য জাদুবাস্তববাদের বীজ সুপ্ত অবস্থায় ছিল, কিন্তু সেটা থেকে আমাদের জাদুবাস্তববাদের মৌলিক স্বরের উন্মোচন ঘটেনি। আমাদের সংস্কৃতিতে ভূতে বিশ্বাসের বিষয়টি ছিল, অথচ আমাদের কথিত সিরিয়াস ধারার কথাসাহিত্যে অলৌকিক বিষয়আশয় তেমনভাবে আসেনি। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠী জিনে বিশ্বাস করে, অথচ জিন আমাদের সাহিত্যে বলিষ্ঠ কোনো চরিত্র হয়ে ওঠেনি। বাংলা সংস্কৃতি ও লোকসাহিত্যে ভূত-পেতনি-শাঁকচুন্নি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও আধুনিক বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরিতে সেসবের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। এইসব কারণে বাংলাদেশের উপন্যাস এই ভূখণ্ডের সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ সম্পূর্ণরূপে ধারণ করতে পারেনি। তবে কিছু ব্যতিক্রম নিশ্চয় আছে। ‘জাদুবাস্তববাদ’ ধারণাটি এখানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই বাংলাদেশে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও সৈয়দ শামসুল হকের গল্পে জাদুবাস্তবতার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। সৈয়দ শামসুল হক ১৯৬৩ সালে রচনা করেন ‘রক্তগোলাপ’। তিনি লাতিন বা ইউরোপীয় জাদুবাস্তববাদ থেকে নয়, রূপকথা ও মৈমনসিংহ গীতিকা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এটা লেখেন। উপন্যাসটি আরম্ভ হয় এভাবে : ‘বছরের এ সময়ে বৃষ্টি হয় কেউ কখনো শোনেনি। এ হচ্ছে এমন একটা সময়, যখন আকাশটা প্রজাপতির পাখার মতো ফিনফিন করতে থাকে রোদ্দুরে, নীল রঙে; যখন উত্তর থেকে নতুন প্রেমের মতো গা-শির-শির-করা মিষ্টি বাতাস বয় কি বয় না তা বোঝাও যায় না; যখন লোকেরা খুব স্ফূর্তির মেজাজে থাকে আর বলাবলি করে, সংসারে বেঁচে থাকাটা কিছু মন্দ নয়; আর ছেলেমেয়েরা কাচের জিনিসপত্তর ভাঙলেও যখন মায়েরা কিছু বলে না; যখন হাট বসতে থাকে বিকালের অনেক আগে থেকেই আর ভাঙতে ভাঙতে অনেক রাত্তির হয়ে যায়, কারণ বছরের এ রকম সময়ে অনেক রাত্তিরেও মানুষ একা হয়ে যায় না, ভয় করে না, নদীর খেয়া বন্ধ হয় না।’ 

এই বৃষ্টির কারণে নৌকাডুবিতে মারা গেছে তেরোজন, ভেঙে পড়েছে মসজিদের ছাদ, ভেসে গেছে আরও অনেককিছু। অপ্রত্যাশিত বৃষ্টির দায় পড়ে ম্যাজিশিয়ান নাজিম পাশার ওপর। এই উপন্যাসে বাংলার লোকায়ত উপকরণ থাকলে এখানে মার্কেসীয় জাদুবাস্তবতার মতো পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণের চিত্র পাওয়া যায়। এর আগে শাহেদ আলী লেখেন ‘জিবরাইলের ডানা’ গল্পটি। প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। এই গল্পে শিশুচরিত্র নবী ঘরের ফুটো চাল দিয়ে আকাশপথে ময়ূরের মতো পাখনাওয়ালা সুন্দর মানুষ উড়ে যেতে দেখে। মা বলেন ফেরেশতা। নবী ঘুড়ি দিয়ে খোদার আরশে টান দিতে চায়। এ পর্যায়ে ইসলামি ও হিন্দুধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে ভারতীয় লোকগল্প, পুরাণ, রূপকথা, উপকথা এসবের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতা যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের জন্য নতুন ধরনের জাদুবাস্তব গল্পের প্রবণতা ও লক্ষণ সৃষ্টি হয়েছিল। সেই লক্ষণের কিছুটা সুসংহত রূপ প্রকাশিত হয়েছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে লাতিন জাদুবাস্তববাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠলে এবং জাদুবাস্তববাদের ইউরোপীয় তত্ত্ব পঠনপাঠন শুরু হলে বাংলাদেশের জাদুবাস্তববাদ অনুকৃতিপ্রবণ হয়ে ওঠে। এবং এ পর্যায়ে বাংলাদেশের নেতৃত্বস্থানীয় জাদুবাস্তব সাহিত্যের লেখক হয়ে ওঠেন শহীদুল জহির। তিনি ঐতিহ্যগত নির্মাণশৈলী থেকে বের হতে চেয়েছেন। ‘অথবা/হয়তো/কিংবা/বা’ ইত্যাদি শব্দের পৌনঃপুনিক ব্যবহারের ভেতর দিয়ে তিনি কতগুলো সম্ভাব্য বাস্তবতার কথা উল্লেখ করে সেগুলো বাতিল করার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যান। এর ব্যাখ্যা তিনি নিজে দিয়েছেন এই বলে, ‘এইসব অপশন দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ব্যাপারটা একটু ঘোলাটে রাখা। জিনিসটাকে যদি আপনি ছবি মনে করেন, তাহলে বলব, ছবির আউটলাইনটাকে একদম ক্লিয়ার না করা। ফটোগ্রাফিক না করা, একটু ফাজি রাখা। অর্থাৎ ছবিটাকে আমি একটু ঝাপসা রাখতে চাই।’ [সাক্ষাৎকার: আহমাদ মোস্তফা কামাল কর্তৃক গৃহীত] 

শহীদুল জহির অধিকাংশ সময় সমষ্টির বয়ানে গল্প লেখেন। অর্থাৎ মহল্লা বা ডাউনটাউনের লোকজন সেই গল্পের কথক। আখ্যান বা অবয়ব বলে কিছু থাকে না। এজন্য তাঁকে উত্তরকাঠামোবাদী হিসেবে আমরা ভাবতে পারি। প্রচলিত কাঠামো ভাঙার ক্ষেত্রে শহীদুল জহির তাঁর গল্পে চিত্রকলার কিউবিক এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অ্যাবস্ট্রাকশন ফর্ম ব্যবহার করেছেন। ফলে যেমন দুর্বোধ্যতার সৃষ্টি হয়, তেমনি পাঠকভেদে তৈরি হয় ভিন্ন ভিন্ন পাঠ। শহীদুল জহির এই ফর্মের কথা উল্লেখ করে বলছেন, ‘মার্কেসের লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে যে, এখানে চিত্রকল্পের ফর্ম আছে। পিকাসোর গুয়েরনিকা যে ফর্মে আঁকা, এটা হচ্ছে কিউবিক ফর্ম। একটা জিনিস ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে দেওয়া আছে।– আমারও মনে হয়েছে লেখাগুলো যখন যেভাবে খুশি লেখা।’ [সাক্ষাৎকার: আর কে রনি কর্তৃক গৃহীত]

শহীদুল জহির জাদুবাস্তববাদ বা কুহকী বাস্তবতার লেখক কি না, সেই প্রশ্ন তোলা উচিত হবে না। কারণ, স্পষ্টতই তাঁর লেখায় জাদুবাস্তবতার উপকরণ আছে। তিনি সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে তিনি সচেতনভাবে জাদুবাস্তবতার বিষয়টি তাঁর গল্প-উপন্যাসে এনেছেন এবং সেটি তিনি গাবরিয়েল গারসিয়া মার্কেস থেকে গ্রহণ করেছেন। তিনি বলছেন, ‘জাদুবাস্তবতার ব্যাপারটা তো আমি মার্কেসের কাছ থেকে পেয়েছি। এবং এটা আমি গ্রহণ করেছি দুটো কারণে। প্রথমত, চিন্তার বা কল্পনার গ্রহণযোগ্যতার যে পরিধি সেটা অনেক বিস্তৃত হতে পারে বলে আমি মনে করি। ... দ্বিতীয়ত, আমি আসলে বর্ণনায় টাইমফ্রেমটাকে ভাঙতে চাচ্ছিলাম...।’ 

কিন্তু শহীদুল জহিরকে পড়ার পর পাঠকের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন চলে আসে– শহীদুল জহিরের জাদুবাস্তববাদ কি মার্কেসীয় জাদুবাস্তবতা? এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা দেখব, মার্কেসীয় জাদুবাস্তবতার বিষয়টি ভীষণভাবে সমাজমুখী। ব্যক্তির অভিজ্ঞতা সমাজের ভেতর সঞ্চারিত হয়। অন্যদিকে শহীদুল জহিরের জাদুবাস্তববাদ সমাজের বা সমষ্টির অভিজ্ঞতা থেকে ব্যক্তির দিকে সঞ্চারিত হয়। তাঁর গল্পের দুর্বোধ্যতা বা সিদ্ধান্তহীনতা অনেক সময় মানুষের চেতনার জগতে প্রবেশ করে তাকে জাগিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত গল্পটি হয়ে ওঠে ননসেন্স স্টোরি। অর্থাৎ মার্কেসের গল্পে প্রতীক বা কুহকী বাস্তবতার অন্তরালে সমাজের অসংগতি তুলে ধরার প্রচেষ্টাটি যেখানে জীবনমুখী সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যায়, সেখানে শহীদুল জহিরে এসে উল্টো দিকে মোড় নেয়। এখানে এসে তাঁর গল্পে রূপকথার প্রবণতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই বলা চলে, মার্কেস যে মুহূর্তে রূপকথার ভেতর থেকে বের হয়ে আসেন, শহীদুল জহির সেই মুহূর্তে রূপকথার ভেতর প্রবেশ করেন। 



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews