নিউইয়র্ক শহরের বিশাল ক্যানভাসে এক উজ্জ্বল রঙের আঁচড়—জ্যাকসন হাইটস। এটি শুধু একটি এলাকা নয়, বরং অভিবাসী জীবনের এক গতিময় চিত্রকল্প। আকাশের ওপরে লম্বা সাদা রেখা রেখে উড়ে যায় জেট প্লেন, নিচে থেমে থেমে বাজে পাতালরেলের ধাতব সুর, রাস্তার মোড়ে মোড়ে হলুদ ট্যাক্সির ছুটে চলা, আর কোণে কোণে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ—হাতে কফি, মনে স্বপ্ন।

এই অস্থিরতা আর অন্বেষণের মধ্যেই গড়ে উঠেছে এক কমিউনিটি। রেস্তোরাঁ, গ্রোসারি, হেয়ার সেলুন, কাপড়ের দোকান, মানি এক্সচেঞ্জ, ট্র্যাভেল এজেন্সি সর্বোপরি দোকানের সাইনবোর্ডটিই যখন বাংলায় লেখা তখন বুঝতে বাকি থাকে না এটা এক ক্ষুদ্র বাংলাদেশ।

এখানকার বাঙালি নারীরা নানা পরিচয়ে জীবনের লড়াইয়ে ব্যস্ত—কেউ ওয়েট্রেস, সেলাই মেশিন অপারেটর, নার্সিং হোমের সহকারী, কেউ বা ছোটখাটো দোকানে সেলস গার্ল। আধখানা দিন কাটে চুপচাপ পরিশ্রমে, বাকিটা কাটে সন্তানের স্কুল ফরম পূরণে বা টেলিফোনে মায়ের সঙ্গে কথা বলার তৃষ্ণায়। পুরুষেরা অনেকেই চালান ইয়েলো ক্যাব, উবার, কেউ কেউ রেষ্টুরেন্ট, টেকআউটে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করেন।

জীবন এখানে অদ্ভুত রকমের মিশ্র—প্রতিদিনের রুটিনের ভেতরেও আছে উত্তেজনা, ক্লান্তির ভেতরেও আছে একরাশ আনন্দ। নিউইয়র্কের আলোকিত আকাশের নিচে, কংক্রিটের এই রাজ্যে, ভাষা-সংস্কৃতির ভিন্নতার ভেতরেও জেগে থাকে বাঙালির এক টুকরো শেকড়—যা ছিঁড়েও যায় না, ফুরিয়েও যায় না।

এই বহুজাতিক, ব্যস্ত নগরের মাঝে একদিন ঝরে পড়ে এক নাম। এক নারী, এক মা। তার গল্প এক খাঁচায় আটকে থাকা পাখির, যে রক্তে লিখে যায় স্বাধীনতার গান।

আফসানা মিনি। একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় জন্ম নেওয়া প্রতিভাবান কন্যা। তাঁর শৈশব কেটেছে সরাইল গার্লস হাই স্কুলে, যৌবনের সিঁড়ি বেয়ে উঠেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে, তারপর ঢাকায় পড়াশোনা শেষ করে হিসাববিজ্ঞানে ডিপ্লোমা করেছেন ঢাকার একটি কলেজ থেকে। তাঁর জীবন তখন একটি প্রাইভেট ব্যাংকের সঙ্গে শুরু হয়েছে। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এক মধ্যবিত্ত নারীর স্বপ্ন তিনি তখন বুকে বয়ে বেড়াচ্ছেন।

অন্যদিকে, কামরুল ইসলাম—কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকার এক সময়ের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান, যিনি পড়াশোনা শেষ না করেই ভাগ্য ফেরানোর আশায় পাড়ি জমান আমেরিকায়। ১৯৯৫ সালে ট্যুরিস্ট ভিসায় নিউইয়র্ক এসে প্রথমে রেস্টুরেন্টে কাজ করেন, পরে ইয়েলো ক্যাব চালান। কষ্টের রুটিরুজির মাঝে একদিন বিয়ের প্রস্তাব পাঠান আফসানার পরিবারে। ১৯৯৮ সালে বিয়ে হয়।

নিউইয়র্কে আসার পর শুরু হয় আফসানার নতুন জীবন—বেঁচে থাকার লড়াই। জ্যাকসন হাইটসের একটি ক্ষুদ্র অ্যাপার্টমেন্টে উঠেন, তারপর একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে সেলাই মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ পান। সন্ধ্যায় ইংরেজি শেখার ক্লাসে যোগ দেন।

এই আত্মউন্নয়নই ছিল স্বামীর চোখে অপরাধ। অন্য নারীদের সঙ্গে মেলামেশা করা, নিজের মতো করে বাঁচতে চাওয়া—এসব ছিল তার মতে ‘সংস্কৃতি বিরোধী’ কাজ। তাই আফসানা শুধু মার খেতেন না, তাঁকে মানসিক ভাবেও চুরমার করে ফেলা হতো। তার পাসপোর্ট, ফোন—সবই ছিল স্বামীর হেফাজতে। গর্ভবতী অবস্থাতেও রেহাই পাননি। আফসানার বাড়ির সঙ্গে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।

এরই মাঝে এই দমবন্ধ জীবনে এক কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। আফসানার জীবনের একমাত্র আনন্দ। মেয়েকে ভালো মানুষ করার স্বপ্ন দেখতে থাকেন তিনি। স্কুলে দেওয়া, নিজের মতো করে বড় করা—এসব নিয়েও স্বামীর আপত্তি। আফসানা বুঝে যান, তাকে শুধু বাঁচলেই চলবে না, লড়তে হবে। গোপনে নিজের সামান্য আয় থেকে কিছু টাকা জমিয়ে একটি জীবনবীমা করান, যেখানে কন্যাকে বেনিফিশিয়ারি করা হয়।

২২ মে ২০০১। সেদিন সন্ধ্যায় কাজ শেষে বাসায় ফেরেন আফসানা। তিনি জিন্স পরে ছিলেন—আর এটিই হয়ে দাঁড়ায় অজুহাত। রাত এগারোটার দিকে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর, কামরুল আফসানাকে বাথরুমে আটকে রাখেন। প্রতিবেশীরা তার চিৎকার শুনে ভয় পান এবং ৯১১ নম্বরে কল করেন। কিন্তু ভাষাগত বিভ্রান্তি ও ঠিকানা জটিলতায় পুলিশ পৌঁছাতে সময় লাগে ৪৭ মিনিট।

ততক্ষণে সব শেষ। আফসানার শরীরে ছিল ৯টি ছুরিকাঘাত, যার মধ্যে ৫টি সরাসরি হৃদপিণ্ডে। দেয়ালে রক্ত দিয়ে লেখা ছিল—”HELP”। তাঁর হাত ছিল প্রতিরোধে ফোলা, চোখ ছিল কাঁদতে-কাঁদতে শক্ত হয়ে যাওয়া।

আদালতে শুরুতে কামরুল সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেন। পরে স্বীকার করেন, “সে আমার কথা অমান্য করেছিল, তাই তাকে শাস্তি দিয়েছি।” তাঁর আইনজীবী ‘কালচারাল ডিফেন্স’ হিসেবে যুক্তি তুলে ধরেন যে, স্ত্রী তাঁর সংস্কৃতি ও সম্মানের পরিপন্থী আচরণ করেছিলেন। তবে বিচারক সেই যুক্তিগুলো গ্রহণ না করে তা খারিজ করে দেন। তবে পূর্বপরিকল্পনার প্রমাণ না থাকায়, আদালত তাকে দ্বিতীয় ডিগ্রির হত্যার দায়ে ১৫ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।

ঘটনার দিন পাশের ঘরে থাকা তিন বছরের শিশুটিকে উদ্ধার করে চিলড্রেন সার্ভিসেস। পরে আফসানার ভাই তাঁকে দত্তক নেন।

২০২১ সালে জানা যায়, সে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান পড়ছে। তার জীবনের আদর্শ তার মা—আফসানা।

আফসানার মৃত্যুর পর নিউইয়র্কে চালু হয় বাংলা ভাষার ৯১১ সহায়তা লাইন। জাতিসংঘের এক রিপোর্টে এই মামলাকে ‘গ্লোবাল ফেমিসাইড ট্রেন্ড’-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

পুনশ্চ: ২০১৭ সালে শাস্তির মেয়াদ শেষ হলে কামরুল বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে আবারও বিয়ে করেন। কিন্তু ২০২০ সালে তাঁর নতুন স্ত্রীও নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন। সময় গড়ায়, নতুন ঘটনার ভিড়ে হারিয়ে যেতে থাকে আফসানার গল্পও—সাধারণ মানুষের স্মৃতি থেকে ধীরে ধীরে মুছে যেতে থাকে সেই করুণ অধ্যায়।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews