দেশের আন্দোলন সংগ্রামে সাধারণ মানুষের অবদান থাকলেও এর নেতৃত্ব দেয় শিক্ষিত সমাজ। সমাজ বিনির্মাণে তাদের ভূমিকাই অগ্রগণ্য। কিন্তু বিগত সরকার মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিতে থাকে। তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া পেনশন স্কিম বাতিল, কোটা পুনর্বহাল হওয়ায় মাঠে নামেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এক দিকে পেনশন স্কিম বাতিলে শিক্ষকরা আন্দোলন করেন। আরেক দিকে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে রাজপথে থাকেন শিক্ষার্থীরা। যাদের থাকার কথা গবেষণাগার, শ্রেণিকক্ষে তারাই মাঠে বিপ্লবীদের মতো নিজ অধিকার আদায়ে আন্দোলন শুরু করেন। এই দুই আন্দোলনই জোরালো হয় গত বছরের জুলাই মাসে। যেটি আগস্টের ৫ তারিখে সরকার পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
জুলাই ১ থেকে শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণার পর রাজপথে শিক্ষার্থীরা, ক্লাস কার্যক্রম বর্জন করেন শিক্ষকরা। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এক রকম অচলাবস্থা বিরাজ করছিল। শুরুর দিকের আন্দোলন ৩ জুলাই খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু তাৎপর্য বহন করে। ওই দিন একযোগে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান কর্মসূচি, বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা জানান, কোটার ইস্যুতে হাইকোর্টে ফয়সালা না হলে রাজপথে তার ফয়সালা হবে। সরকারের পক্ষ থেকে তখনো আলোচনার কোনো প্রস্তাব আসেনি। এ দিকে হলে হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আসতে বাধা দিতে শুরু করে। হলগুলোতে তখন ছাত্রলীগের পুরো আধিপত্য। তার পরেও নিষেধ অমান্য করে রাজপথে নেমে আসেন শিক্ষার্থীরা।
দাবি আদায়ে লাগাতার বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, সড়ক ও রেলপথ অবরোধ : হাইকোর্টের রায়ের অপেক্ষা
কোটা বাতিলের দাবিতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ, অবস্থানসহ নানা কর্মসূচি পালন করছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ধারাবাহিক আন্দোলনের তৃতীয় দিনের মতো ৩ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ ও শাহবাগ মোড়ে সড়ক অবরোধ করেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। একই কর্মসূচির অংশ হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল এবং ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যাল, কবি নজরুল ইসলাম কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার মোড়ে বিক্ষোভ করেন। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ে রেলপথ অবরুদ্ধ করে রাখেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কে অবস্থান এবং সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
ওই দিন কোটা পুনর্বহাল সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের রায় বহাল থাকবে কি না সে বিষয়ে আপিল বিভাগের শুনানি ছিল। আপিল বিভাগের চূড়ান্ত শুনানিতে শিক্ষার্থীদের পক্ষে রায় না এলে বৃহত্তর আন্দোলনে যাবে বলে হুঁশিয়ারও দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এ দিন বেলা আড়াইটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আবাসিক হল থেকে স্বতন্ত্র ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে দলে দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে দোয়েল চত্বর হয়ে হাইকোর্টের পাশ ঘেঁষে মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগ মোড়ে গিয়ে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী। সে সময় ক্ষণে ক্ষণে গান আর স্লোগানে মুখরিত হয় শাহবাগ চত্বর। এ সময় আশপাশের সড়কে যানচলাচল বন্ধ থাকে। বিকেল পৌনে ৪টা থেকে ৫টা ১০ মিনিট পর্যন্ত চলে শিক্ষার্থীদের এ অবরোধ কর্মসূচি। এ সময় ঢাকা কলেজসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এতে যোগদান করেন।
অবরোধ কর্মসূচির সময় বর্তমান জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য চাকরির বয়স ৩২ করা থেকে নানান সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে, তখন তো আমরা কিছু বলিনি। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান রেখে বলি- তাদের জন্য আরো গাড়ি দেন, বাড়ি দেন, ভাতা বাড়ান; কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করবেন না। মুক্তিযোদ্ধারা কখনো এই বৈষম্যমূলক সমাজ চাননি। তারা একটা সাম্য ও সমানাধিকারের রাষ্ট্র চেয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান ঢাবির গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী ফারাবী রহমান শ্রাবণ বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা কোনো বৈষম্য চাননি। তারা চেয়েছিলেন সবার অধিকার নিশ্চিত করতে। তারা চেয়েছিলেন সাম্য, সুযোগের সমতা। কিন্তু সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা কখনোই সবার অধিকার নিশ্চিত করে না। আমি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হিসেবে সব মুক্তিযোদ্ধার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি- আপনারা দয়া করে শিক্ষার্থীদের এই ন্যায্য দাবির পাশে দাঁড়ান।
বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং তৎকালীন সময় আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, আমরা আগামীকালের আপিল বিভাগের শুনানির অপেক্ষা করছি। আমাদের পক্ষে রায় এলে আমরা ক্লাসে ফিরে যাবো। যদি ছাত্র সমাজের রায়কে উপেক্ষা করে আদালত একই রায় বহাল রাখেন তবে আমরা আরো বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করব।
৩ জুলাইয়ে ঢাকার বাইরেও নানা জায়গায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। রেলপথ, সড়ক অবরোধ আন্দোলনে এক নতুন গতি দেয়।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে জাবি শিক্ষার্থীদের অবরোধ : ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দুই ঘণ্টা (বেলা ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত) ধরে অবরোধ করে রাখেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন।
তাঁতীবাজার মোড় অবরোধ : সে দিন বেলা সাড়ে ৩টায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা তাঁতীবাজার মোড় অবরোধ করেন। এক ঘণ্টা পর তারা অবরোধ তুলে নিলে সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা।
ট্রেন থামিয়ে বিক্ষোভ : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা দুই দফায় বিক্ষোভ মিছিল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল জব্বার মোড়ে রেললাইন অবরোধ করেন। ওই সময় এক ঘণ্টা ট্রেন অবরোধ করে রাখা হয়। দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চের সামনে সমবেত হন শিক্ষার্থীরা। পরে সেখান থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কে আর মার্কেট হয়ে মুক্তমঞ্চে এসে শেষ হয়। সেখানে একটি প্রতিবাদ সভা করেন শিক্ষার্থীরা। পরে সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল জব্বার মোড় পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। ওই সময় ঢাকা থেকে মোহনগঞ্জগামী মহুয়া কমিউটার ট্রেন আটকে রেখে বিক্ষোভ করেন তারা। প্রায় এক ঘণ্টা পর বেলা ২টা ২০ মিনিটে তারা রেললাইন অবরোধ তুলে নেন। পরে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক : কাফনের কাপড় পরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। ববির গেট-সংলগ্ন মহাসড়ক অবরোধ করে বেলা ১১টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত অবস্থান নেন তারা।