ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার হেন কোনো প্রচেষ্টা নেই, যা অবলম্বন করা হয়নি। হাসিনা তার সাজানো ও অনুগত পুলিশ, র‌্যাব এবং প্রশাসনকে ব্যবহার করে দলটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিল। দলটির পক্ষ থেকে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিল, বিএনপিকে মুসলিম লীগে পরিণত করা হবে। ২০১০ সালের মাঝামাঝি দলটির এক মধ্যম সারির নেতার সাথে আমার কথা হয়েছিল। কথায় কথায় হাসতে হাসতে তিনি বলেছিলেন, বিএনপি নামে কোনো দলই থাকবে না। তার কথা তখন খুব একটা আমলে নেইনি। বিএনপির মতো একটি বিপুল জনসমর্থিত দল, যেটি তিন তিনবার ক্ষমতায় এসেছিল, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের ইতিহাসে সংসদে সবচেয়ে বড় বিরোধীদল হয়েছিল, সেই দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার এমন কথা তখন বিশ্বাস হয়নি। পরবর্তীতে দেখলাম, তার কথার প্রতিফলন ঘটছে। হাসিনা সরকার বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে স্টিম রোলার চালিয়ে দিয়েছে। হামলা-মামলা, গ্রেফতার, জেল-জুলুম, গুম, খুন, নিপীড়ন-নির্যাতন, বাড়িঘর ছাড়া করাসহ সব ধরনের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির এমন কোনো শীর্ষ নেতা নেই, যার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়নি। বেগম খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মিথ্যা মামলা দিয়ে ফরমায়েশি রায়ে কারাদ- দেয়া হয়েছে, জেলে নেয়া হয়েছে। তারেক রহমানকেও বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে একাধিকবার তদন্ত প্রতিবেদন পরিবর্তন করে ফরমায়েশি রায়ে যাবজ্জীবন পর্যন্ত সাজা দেয়া হয়েছে। বিএনপির মামলা রেকর্ড সংরক্ষণ সেলের হিসাব মতে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ওই বছরের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএনপির শীর্ষ নেতা থেকে তৃনমূলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৪১ হাজার ৬৩৬টি মামলা দেয়া হয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগেরই বাদী তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশ। এসব মামলায় বিএনপির ৪৯ লাখ ২৬ হাজার ৪৯৪ জন নেতাকর্মীকে আসামী করা হয়েছে। ২০২৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে বিএনপির যুগ্মমহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে মামলা সংখ্যা ৪৫০টি। এরপর সবচেয়ে বেশি মামলার শিকার হয়েছেন যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব (৩৫০টি), যুবদল নেতা জাহাঙ্গীর হোসেন (৩১৭টি), যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু (৩১৫টি), চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান (২৫০টি), বিএনপির যুগ্মমহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল (২৫০টি), স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু (২৫০টি), সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী (১৮০টি), চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারি শামসুর রহমান শিমুল (১৭৪টি), স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের (১৫০টি) এবং ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রাজীব আহসান (১৪৬টি)। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে মামলা সংখ্যা ৯৮টি। এসব মামলার মধ্যে, গাড়ি পোড়ানো, নাশকতা ও গায়েবি মামলা সবচেয়ে বেশি। এদের প্রত্যেককে একাধিকবার জেলে যেতে হয়েছে এবং জামিন নিয়ে বের হতে হয়েছে। তাদেরকে এবং মামলার শিকার অন্য নেতাকর্মীদেরকে ছুটির দিন ছাড়া বাকি দিনগুলোতে সকালে ঘুম থেকে উঠেই আদালতে যেতে হতো। এটা তাদের অনেকটা রুটিন কাজ ছিল। ২০২৪ সালের ৫ জানুয়ারির আমি-ডামির নির্বাচনের আগে শীর্ষ নেতাদের সাজা দেয়ার জন্য মামলার শুনানির গতি বাড়িয়ে দেয়া হয়। এমনকি, নজিরবিহীনভাবে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত আদালতে শুনানি ও রায় দেয়া হয়। দেশের ইতিহাসে তো বটেই কোনো সভ্য দেশে বিরোধীদলকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার এমন প্রক্রিয়া দেখা যায়নি, যা হাসিনা সরকার দেড় দশক ধরে বিএনপির ওপর চালিয়েছে। দেশের ইতিহাসে বিএনপির মতো আর কোনো দলকে রাষ্ট্রীয়ভাবে এত দীর্ঘ সময় ধরে নিষ্পেষণের শিকার হতে হয়নি।

দুই.
দেশের মানুষ দেখেছে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা কতটা প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে কীভাবে বিএনপি চেয়ারপার্সনকে তাঁর ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে দিয়েছিল। পতনের কিছুদিন আগেও হাসিনা দম্ভের সাথে বলেছিল, ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে আমি তাঁকে বের করে দিয়েছিলাম। বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি হাসিনা এতটাই প্রতিহিংসাপরায়ন ছিলেন যে, তাঁকে শুধু মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে জেলে নিয়ে ক্ষান্ত হননি, তাঁকে স্লো পয়জনিং করে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দিয়েছিলেন। যে বেগম খালেদা জিয়া সুস্থ অবস্থায় আদালত থেকে জেলে গিয়েছিলেন, সেই তাঁকে যখন সাজা স্থগিত করে গৃহবন্দি করা হয়, তখন তিনি হাঁটতে পারেননি। যে রোগ তাঁর ছিল না, সেই রোগ নিয়ে জেল থেকে বাসায় আসেন। লিভার সিরোসিস থেকে শুরু করে জটিল রোগ নিয়ে বাসায় আসেন। অসংখ্যবার তাঁকে মমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। এমনও হয়েছে, হাসপাতাল থেকে তিনি বাসায় ফিরতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। বিএনপি বারবার তাঁকে বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার আবেদন করলেও হাসিনা বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি এতটুকু সহমর্মিতা দেখাননি। অন্যদিকে, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও বেগম খালেদা জিয়া ফ্যাসিস্ট ও মানবিকতাহীন নিষ্ঠুর হাসিনার কাছে মাথা নোয়াননি। পৃথিবীতে কে মরতে চায়? কেউই মরতে চায় না। অথচ বেগম খালেদা জিয়া তার মৃত্যু হবে জেনেও ফ্যাসিস্ট হাসিনার সাথে আপস করেননি। আবার হাসিনার পতনের পরও তিনি তার প্রতি কোনো রাগ-ক্ষোভ রাখেননি। ব্যক্তিগতভাবে হাসিনাকে নিয়ে একটি খারাপ শব্দও উচ্চারণ করেননি। আইন ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল তাঁর সাথে দেখা করে হাসিনার প্রতি তার প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে এক ফেসবুক পোস্টে আসিফ নজরুল সে কথা লিখেছিলেন। তিনি বহু চেষ্টা করেও হাসিনাকে নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার মুখ থেকে একটি কটু কথাও বের করতে পারেননি। বেগম খালেদা জিয়া শুধু বলেছেন, আমি শুধু আল্লাহর কাছে বলেছি। যে দলের নেত্রী এমন আপসহীন তার পথে দলের শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও হাঁটবেন, এটাই স্বাভাবিক। হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে শত গুম, খুন, জেল-জুলুমের শিকার হয়েও তারা আপস করেনি। তারা বাড়িছাড়া হয়েছে, পালিয়ে বেড়িয়েছে, ঢাকায় এসে রিকশা চালিয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য, সহায়-সম্পদ হারিয়েছে, সংসার হারিয়েছে, সংসার করতে পারেনি, মামলার আসামী জেনে কোনো অভিভাবক মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে বিয়ে দিতে চাননি। তাদের সামাজিক, পারিবারিক জীবন বলে কিছু ছিল না। তারপরও তারা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছে। বিএনপি যদি দেড় দশক ধরে এই লড়াই না চালাত, হাসিনার সাথে জাতীয় পার্টির মতো ভাগাভাগি করে সংসদে যেত, তাহলে গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট কি তৈরি হতো? হতো না। সব দল হাসিনার অধীনে থেকে যেত এবং তিনি আমৃত্যু প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকতেন। দেশে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও রাজনীতি বলতে কিছু থাকত না। বাংলাদেশ আরও অনেক বছর ফ্যাসিসজমের কবলেই থেকে যেত। বিএনপি হাসিনার সাথে আপস করেনি বলেই গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, তার পতন হয়েছে। কেউ বলতে পারে, ২০১৮ সালে বিএনপি হাসিনার অধীনে জাতীয় নির্বাচনে গিয়েছিল। কেন গিয়েছিল, সেটাও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। বিএনপি অংশগ্রহণ করার কারণেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভয়ে আগের দিন রাতে ব্যালট বক্স পূর্ণ করে বিজয় নিশ্চিত করেছিল। তাঁকে এই অপকর্ম করতে হয়েছে। তার অধীনে যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না, বিএনপি সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে প্রমাণ করে দিয়েছে। সে নির্বাচনে বিএনপি ছয়-সাতটি আসন পেলেও সংসদে জাতীয় পার্টির মতো গৃহপালিত বিরোধীদল হয়নি। যতক্ষণ ছিল, তারা সরকারের বিরুদ্ধে ফাইট করেছে। পরবর্তীতে তারা পদত্যাগও করেছে। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে তুমি একবার মরতে পার, তবে রাজনীতিতে তুমি বহুবার মরবে।’ এর অর্থ হচ্ছে, রাজনীতিতে মরতে মরতেই এগিয়ে যেতে হয়। ধৈর্য্য ধরে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। এক সময় তুমি ঘুরে দাঁড়াবে। তের শতকের শুরুতে স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস স্বাধীনতার জন্য ইংল্যান্ডের সাথে সাতবার যুদ্ধ করে হেরে গিয়েছিলেন। তারপরও তিনি হাল ছাড়েননি। অষ্টমবারে বিজয়ী হয়েছিলেন। বিএনপি এই নীতি নিয়েই ফ্যাসিস্ট হাসিনার দেড় দশক অতিবাহিত করেছে। মরেছে, আবার দাঁড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। যদি ফ্যাসিস্ট হাসিনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলত, তাহলে দলটির মৃত্যু অনেক আগেই হয়ে যেত। যেমনটি হয়েছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে ক্ষমতার হালুয়া রুটি খাওয়া জাতীয় পার্টিসহ অন্যদলগুলোর। বলা যায়, বিএনপিই ফ্যাসিস্ট হাসিনার নিশ্চিহ্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে মার খেতে খেতে হার না মেনে দেশের রাজনীতিকে মরে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। জনগণ দেখেছে, আন্দোলন চলাকালে সামনের সারির ছাত্র সমন্বয়কদের গ্রেফতার করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাদের দিয়ে মিডিয়ার সামনে আন্দোলন স্থগিত করার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। তারপরও কিন্তু আন্দোলন থেমে যায়নি। তাহলে, কারা আন্দোলন চালিয়ে গেছে? তাদের পেছনের শক্তি কী ছিল? পেছনের শক্তি ছিল বিএনপি ও ফ্যাসিবাদবিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। কাজেই, ৫ আগস্ট হাসিনার পতন ও পালিয়ে যাওয়ার পর যারা বড় বড় কথা বলছেন, ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন, তাদের উচিৎ, রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার বিএনপির ত্যাগের দিকে তাকানো।

তিন.
গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর দেশ এক নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কয়েক মাস বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ ছিল এবং সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে গেছে। এখনো দিচ্ছে। তবে যতই দিন যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি, সমন্বয়কদের দ্বারা গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির মধ্যে নির্বাচন প্রশ্নে দূরত্ব বাড়ছে। এর মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে, সরকারের মধ্যে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার খায়েশ জন্মেছে। বিএনপি ও বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল প্রয়োজনীয় সংস্কার করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। অন্তর্বর্তী সরকার অল্প সংস্কার ও বেশি সংস্কারের সূত্র সামনে এনে বলেছে, অল্প সংস্কার চাইলে ডিসেম্বরে, বেশি সংস্কার চাইলে ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তবে সে নির্দিষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ বা পথরেখা ঘোষণা না করে এক ধরনের হাইপোথ্যাটিক্যাল থিওরি রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে ঝুলিয়ে দিয়েছে। গত ১ জুন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব গণমাধ্যমের সামনে সর্বশেষ বলেছেন, নির্বাচন ডিসেম্বরেও হতে পারে, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, মে এবং জুনেও হতে পারে। সরকারের এমন অবস্থানের কারণে দেশের একমাত্র বড় রাজনৈতিক ও ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনাময় দল বিএনপির মধ্যে সন্দেহ ও সংশয় ঢুকে গেছে। দলটির কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন না দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে চায়। নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে পুরোপুরি সমর্থন করছে এনসিপি। জামায়েতে ইসলামী দোটানার মধ্যে থেকে বলেছে, নির্বাচন রোজার আগে ফেব্রুয়ারি কিংবা ঈদের পর এপ্রিলে হতে পারে। তবে বিএনপি তার অবস্থানে দৃঢ় থেকে বলেছে, ডিসেম্বরেই নির্বাচন দিতে হবে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামানও ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়া উচিৎ বলে মন্তব্য করেছেন। অন্যদিকে, সরকারের সাথে তাল মিলিয়ে এনসিপি বলেছে, আগে সংস্কার পরে নির্বাচন। সংস্কার করতে যতদিন লাগে, ততদিন নির্বাচন হবে না। এরই মধ্যে বিএনপি কেন দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছে, এ নিয়ে তাকে তুলোধুনো করার জন্য কিছু অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও গোষ্ঠী উঠেপড়ে লেগেছে। তারা বিএনপিকে ভারতের দালাল ট্যাগ দিয়ে নানাভাবে সমালোচনা করছে। দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে ভারতের দালালও বলেছে। তারা শুধু বিএনপিকেই ভারতের দালাল বলছে না, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামানকেও দালাল বলছে। তাদের যুক্তি, ভারত বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচনের কথা বলেছে। ভারতের সাথে বিএনপি ও সেনাপ্রধান নাকি তাল মিলিয়ে দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন আজ হোক কাল হোক, বিএনপি যদি ভারতেরই দালাল হয় এবং জনগণ ভোট দিয়ে তাকে ক্ষমতায় বসায়, তাহলে কি হবে? তারা কি তা ঠেকাতে পারবে? প্রকৃতপক্ষে, এ ধরনের প্রপঞ্চ ও ট্যাগ লাগাচ্ছে তারাই, যারা জনগণের ভোটে নিকট ভবিষ্যত তো বটেই, দূর ভবিষ্যতেও তাদের পক্ষে ক্ষমতায় আসা দুষ্কর। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে তাল মিলিয়ে ক্ষমতা উপভোগ ও সুযোগ-সুবিধা যতদিন নেয়া যায়, ততদিন পর্যন্ত তারা নির্বাচনে যেতে চায় না। তারা ভালো করেই জানে, নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ অনেক দীর্ঘ ও সংকীর্ণ। ফলে যারাই দ্রতি নির্বাচনের কথা বলছে, তাদেরকেই ওই গোষ্ঠীটি ভারতের দালাল বলে আখ্যায়িত করছে।

চার.
বিএনপির জন্মের পর থেকে কেউ কখনোই বলতে পারেনি, দলটি ভারতের দালালী করেছে বা ক্ষমতায় যেতে তার সমর্থন কামনা করেছে। বিএনপির জন্মই তো হয়েছে, ভারতের আধিপত্যবাদের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। দেশের মানুষও তা জানে এবং জানে বলেই দলটি বিপুলভাবে সমর্থিত। বারবার ক্ষমতায় এসেছে। দেশ পরিচালনা করেছে। হাসিনার মতো ভারতের দাসী হয়ে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেনি। বলা হয়ে থাকে, দলটির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যার পেছনে ভারতের হাত রয়েছে। কারণ, তিনি ভারতের আধিপত্যবাদকে তোয়াক্কা করেননি। ভারতের চোখে চোখ রেখে কথা বলেছেন। অবিভক্ত পাকিস্তানের হয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন তরুণ আর্মি অফিসার হিসেবে ১৯৬৫ সালে ভারতের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়েছিলেন। সে সময় পাকিস্তান সরকার তাঁর এই বীরত্বের জন্য হিলাল-ই জুরত বা ক্রিসেন্ট অফ কারেজ (সাহসী চাঁদ) উপাধিতে ভূষিত করেছিল। ভারতবিরোধী তাঁর এই মনোভাব সবসময়ই ছিল। বিএনপি তো তাঁর হাতেই গড়া। বিএনপি যদি ভারতের দালালিই করত, তাহলে কি দেড় দশক ধরে ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করত? ভারতের প্রেসক্রিপশনে জাতীয় পার্টির মতো সংসদে প্রধান বিরোধীদল হয়ে কিংবা ক্ষমতার অংশীদার হয়ে থাকতে পারত। এত নেতাকর্মী গুম, খুন, হামলা-মামলা, নির্যাতনের শিকার হতো না। ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তো বিএনপির প্রবল আন্দোলনের সময় ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভারতের প্রেসক্রিপশনে দলটিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি মন্ত্রণালয় দিয়ে সরকারের অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। বিএনপি কি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল? করেনি। যদি তার ক্ষমতা ভাগাভাগি করে থাকার ইচ্ছা থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই সে যেত। ক্ষমতার লোভ ছুঁড়ে ফেলে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে গেছে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, বিএনপির জন্মলগ্ন থেকে যেখানে কেউই দলটিকে ভারতের দালাল বলতে পারেনি, হাসিনার পতনের পর ২০২৫ সালে এসে ক্ষমতালোভী এবং ক্ষমতা উপভোগকারি একটি গোষ্ঠী দলটিকে ভারতের দালাল বলে প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে। অথচ আওয়ামী লীগ ও হাসিনা সবসময় জিয়াউর রহমান ও বিএনপিকে পাকিস্তানের দালাল ও চর হিসেবে আখ্যায়িত করে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করেছে। জনগণ তা কখনোই বিশ্বাস করেনি। বরং আওয়ামী লীগ ও হাসিনাই যে ভারতের দালাল ও দাসী, তা জনগণ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি না ভারতপন্থী, না পাকিস্তানপন্থী, এ ধারায়ই সবসময় চলে এসেছে। এটা সাধারণ মানুষ ভালো করেই জানে। বিএনপি যে শুধুই বাংলাদেশপন্থী, তা আবারও সুস্পষ্টভাবে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গত ২৮ মে তারুণ্যের সমাবেশে ঘোষণা করে বলেছেন, ‘দিল্লি নয় পিন্ডি নয়, নয় অন্যকোনো দেশ, সবার আগে বাংলাদেশ।’ তাঁর এ কথা নব্য ক্ষমতাভোগী, ক্ষমতালোভী ও ক্ষমতা উপভোগকারীদের জন্য যেমন চপেটাঘাত, তেমনি দেশের মানুষের জন্য স্বস্তির।

[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews