অভিযোগ ওঠেছে, ‘হকার’ হিসেবে ব্যবসার অনুমতি নিয়ে শহরের কোটিপতি ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাসহ খোদ সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতারাই এ অপকর্মে জড়িত।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবণী পয়েন্ট থেকে কলাতলী পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার সৈকতের মধ্যেই পাঁচ শতাধিক অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। এরপরও বিভিন্ন সময় নতুন করে অবৈধ দোকান ঘর নির্মাণ থেমে নেই। সর্বশেষ ঈদে সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টের বালুচরে আরও অর্ধ শতাধিক অবৈধ দোকান নির্মাণ করা হয়। এনিয়ে স্থানীয়রা বিক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলনে নামলে জেলা প্রশাসন নতুন করে তৈরি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে।
তবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শিগগিরই এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সৈকতের সৌন্দর্য বর্ধনে কাজ করা হবে। পাশাপাশি বাতিল করে হবে প্রভাবশালীদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হকার কার্ড।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পর্যটন ও প্রটোকল শাখা সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে অনুমোদিত ২৬৪টি ঝিনুকের দোকান এবং ৯৮টি খাবারের দোকান রয়েছে। আর লাবণী পয়েন্টে রয়েছে ২০২টি ঝিনুকের দোকান আর ৪৯টি খাবারের দোকান। এছাড়াও সৈকত এলাকায় প্রায় দেড় হাজার কিটকট, ৫৪টি বিচ বাইক ও ২৫টি জেট-স্কি’র অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও কথিত ২৩৯টি স্টুডিওর নামে দুটি করে মোট ৪৭৮টি ফটোগ্রাফার কার্ড এবং আরও ১৮০টি ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফারের কার্ডও ইস্যু করা হয়েছে জেলা প্রশাসন থেকে।
তবে সম্প্রতি সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির অন্যতম সদস্য, জেলা জাসদের একাংশের সভাপতি ও শহরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত নইমুল হক চৌধুরী টুটুল নামে ইস্যুকরা একটি হকার কার্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চলে আসলে বিষয়টি নিয়ে জেলাব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আওয়ামী লীগ নেতা বাংলনিউজকে বলেন, সৈকতে ভ্রাম্যমাণ হকারদের জন্য এসব অস্থায়ী দোকান বরাদ্দের কথা বলা হলেও বাস্তবে এ তালিকায় রয়েছে সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, স্থানীয় রাজনীতিক, সরকারের প্রভাবশালী আমলার স্বজন, সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রভাবশালীরা। এরমধ্যে কেউ নিজের নামে, কেউ স্বজন কিংবা অনুগতদের নামে বরাদ্দ নিয়েছেন।
শুধু দোকান বা হকার কার্ড নয়, এ চক্রটি কিটকট, জেট স্কি, বিচ বাইক, ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফারসহ বিভিন্ন ব্যবসার লাইসেন্সও হাতিয়ে নিয়েছেন। জেলা প্রশাসনের পর্যটন ও প্রটোকল শাখা থেকে দেওয়া হয়েছে এসব লাইসেন্স।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুত লাবনী ও সুগন্ধা পয়েন্টের কয়েকজন ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে বলেন, সুগন্ধা পয়েন্ট হয়ে সাগরে নামার পথে ডান পাশের মার্কেটের বড় একটি অংশ ‘মুক্তিযোদ্ধা’ মার্কেট নামে পরিচিত। ওই অংশে ৪০টির মতো দোকান রয়েছে। সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য নইমুল হক চৌধুরী টুটুল ও মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহাজাহানের শেল্টারে ওই মার্কেটের দেখভাল করেন লালু নামে একজন। এখানে টুটুলের দুটি মুদি দোকান ও দুটি ঝিনুকের দোকান রয়েছে। সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির আরেক সদস্য জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মো. শাহাজানের রয়েছে চারটি দোকান। আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সন্তানদের নামে দোকান রয়েছে। এসব দোকানের ভোগ দখলে রয়েছেন সৈকতে কথিত ব্যবসায়ী সমিতির নেতা মো. লাল মিয়া ওরফে লালু। লালু ও তার ছেলে বকুলের নামেও এ মার্কেটে চারটি দোকান রয়েছে। বাবা-ছেলে সৈকতে ২০টি কিটকট ব্যবসার কার্ডও বরাদ্দ নিয়েছেন। ভাড়া নিয়ে চালান আরও ২৫টির মতো। লালু স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতির একাংশের সভাপতি। সড়কের পাশে রয়েছে টুটুলের একটি খাবারের দোকান। তবে এটি চালান কক্সবাজার সদরের ঈদগাঁওর বাসিন্দা হেলাল।
হেলাল বাংলানিউজকে বলেন, আমি লালুর কাছ থেকে মাসিক ভাড়ায় এ দোকান নিয়েছি।
একই পয়েন্টে একটি খাবারের দোকান রয়েছে সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির আরেক সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রেজাউল করিমের। তার নিয়ন্ত্রণেও রয়েছে কিছু দোকান। সেগুলোর তদারকি করেন ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. রুবেল। এভাবেই চলছে সৈকতের সৌন্দর্য্য বিনষ্ট করে বালিয়াড়ি দখল করে প্রভাবশালীদের ব্যবসা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নইমুল হক চৌধুরী টুটুল বাংলানিউজকে বলেন, আমি এদেশের একজন নাগরিক। নাগরিক হিসেবে সৈকতে দোকান বরাদ্দ নিতেই পারি।
কিন্তু ভ্রাম্যমাণ হকারের কথা বলে খোদ সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা এই দোকান কেন বরাদ্দ নিয়েছেন জানতে চাইলে এ বিষয়ে তিনি বলেন, কমিটির সভার সিদ্ধান্তে এবং নিয়ম মেনেই তা হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহাজান বাংলনিউজকে বলেন, সুগন্ধা পয়েন্টে ৬-৭ জন মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের সন্তানদের নামে দোকান বরাদ্দ রয়েছে। আমার ছেলের নামে অনেকটা জোর করে একটি দোকান দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে জানান, সরকারের প্রভাবশালী আমলা কক্সবাজারের সন্তান মন্ত্রী পরিষদ সচিব শফিউল আলমের ভাই জহির আলমের নামে মাস তিনেক আগে সুগন্ধা পয়েন্টে অন্তত ২০টি দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। কিটকট ব্যবসার জন্য ৩০টির বেশি কার্ডও বরাদ্দ নিয়েছেন তিনি। সেগুলোর দেখাশোনা করেন সৈকতে স্টুডিও মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাঞ্চন আইচ। তবে কাঞ্চন আইচ বলেন, জহির আলমের নামে সেখানে ছয়টি দোকান রয়েছে। এছাড়াও সি-গাল পয়েন্টে ৩০টি কিটকট রয়েছে।
সুগন্ধা পয়েন্টে মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের পরের অংশ ‘জালাল মার্কেট’ হিসেবে পরিচিত। সেখানে রয়েছে ১০৫টি দোকান। ব্যবসায়ী সমিতির একাংশের সভাপতি জালাল ওই মার্কেটের নিয়ন্ত্রক। জেলা আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা তাকে শেল্টার দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আরও অভিযোগ রয়েছে, এই মার্কেটে প্রতিটি দোকান বিক্রি হয়েছে ৪-৬ লাখ টাকায়।
এদিকে, সৈকতের বালিয়াড়ি দখল করে অবৈধ স্থাপনা তৈরীসহ নানা অনিয়নের কারণে সম্প্রতি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহজাহান আলীকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা প্রশাসক। এরপর জেলা প্রশাসনের পর্যটন ও প্রটোকল শাখা থেকে সংশ্নিষ্ট ফাইল ও নথিপত্র জব্দ করা হয়। পর্যটন সেলের ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল আশরাফ জয়কেও প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সি-বিচ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, সৈকতে হকারদের জন্য নির্ধারিত স্থানে দোকান ও অন্যান্য ব্যবসা পরিচালনায় কার্ড বরাদ্দ নিয়ে কিছু অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৩২০ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০১৯
এসবি/এনটি