হুলিও পারেদেস কাস্ত্রো কলোম্বিয়ান লেখক, কবি, ঔপন্যাসিক, অধ্যাপক ও দার্শনিক। তিনি সাহিত্য ও দর্শনের গভীর অনুসন্ধানী মনোভাব নিয়ে কলোম্বিয়ান সাহিত্যজগতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তার রচনায় শহুরে জীবন, পরিচয় সংকট, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্মৃতি এবং অস্তিত্ববাদের প্রতিফলন দেখা যায়। তিনি ১৯৫৭ সালের ১ জুলাই কলোম্বিয়ার বোগোতা শহরে জন্মগ্রহণ এবং ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট বোগাতায় মৃত্যুবরণ করেন। ছোটগল্প সংকলন: জুপিটার হল ও অন্যান্য গল্প, ভ্রান্তদের জন্য পথনির্দেশিকা, পারিবারিক ব্যাপার, নিজস্ব প্রবন্ধ, অরণ্যের এক দৃশ্য। উপন্যাস: ডুবে থাকা কোষ, সিমেননের সঙ্গে পাঁচ সন্ধ্যা, ২৯টি চিঠি: এক নীরব আত্মজীবনী, নিশ্চল পাখিরা ইত্যাদি। স্প্যানিশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন অ্যান্ড্রিয়া ই. ওলসেন।



‘সে উপরতলার জানালা থেকে মায়ের হাত নাড়ার এক ঝলক দেখেছিল,
আর সেই অচেনা ভঙ্গিমা তাকে বিচলিত করেছিল,
যেন তা ছিল কোনো রহস্যময় বিদায়ের ইঙ্গিত।’
—ভ্লাদিমির নবোকভ, স্মৃতি, বলো

সে (ছেলেটি) কল্পনাও করেনি তার শরীর থেকে এত ঘাম ঝরতে পারে। হাতের তালু চটচটে হয়ে গেছে, আর পিঠ দিয়ে বইছে ঠান্ডা ঘামের ধারা। মনে হচ্ছিল, জামার সেলাইয়ের ফাঁক দিয়ে যেন পানি চুঁইয়ে পড়ছে।

রোদে গাড়ির ছাদ উত্তপ্ত হওয়ায়, আর শহরের কোলাহল ও বিশৃঙ্খল যানবাহণের কারণেই হয়ত এত গরম লাগছে তার। সে অনেক দিন পর শহরের কেন্দ্রে এসেছে, বেশিরভাগ রাস্তাও সে চিনতে পারছে না।

স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখেই তার বাবা নিচু স্বরে গালাগালি করলেন। ছেলেটির মনে হলো, তার বাবাও হয়তো নার্ভাস, তার মতোই বিভ্রান্ত। নিজেকে শান্ত করতে সে পাশের গাড়িগুলোর ভেতরে মানুষদের দিকে তাকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তেমন কিছু নজরে পড়ল না। তার মন তখনো মায়ের কথা নিয়েই ব্যস্ত। শেষ কবে দেখা হয়েছে—তা সে নিশ্চিত নয়, তবে বাবা বলেছিলেন, তিন বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে।

গত রাতে, ঘুমোবার আগে সে মায়ের কিছু সাম্প্রতিক ছবি দেখে নিয়েছিল। ছবিগুলো তিন-চার মাস আগে তোলা, এবং বেশিরভাগ ছবিতেই মা হাসছিলেন—চোখে খুশির ঝিলিক। একটি ছবিতে দেখা যায়, মা কোনো রেস্তোরাঁয় বসে আছেন থুতনিতে হাত দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে। সেই মুখটার সঙ্গে নিজের মুখের কোনো মিল খুঁজে পায়নি সে, যেন সেই মুখটা স্বপ্নের ভেতরে দেখেছে।

"পৌঁছে গেছি," হঠাৎ ছোট একটি হোটেলের সামনে গাড়ি থামিয়ে বাবা বললেন। তিনি গাড়ি চালু রেখেই ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন,
"তুই ভিতরে যাচ্ছিস?"

ছেলেটি কিছু বলার আগেই বাবা কয়েক সেকেন্ড ভাবলেন, তারপর বললেন,
"এখন নয়। তোকে নিতে আসব।"

হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে ছেলেটি মায়ের কথা জিজ্ঞেস করল, তারপর লবির একটি চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। দশ মিনিট পর, তার মা এলেন। কালো, দুই টুকরো পোশাক পরেছেন, চুল ছোট ও লালচে, সদ্য গোসল করে এসেছেন বলে মনে হলো; মুখে কোনো মেকআপ নেই।

ছেলেটি মাকে লাজুকভাবে জড়িয়ে ধরল। তার মায়ের গাল ছিল মসৃণ ও উষ্ণ। আলিঙ্গন শেষ করে সে লক্ষ করল, মায়ের হাতে একটি আয়তাকার উপহার—বেগুনি কাগজে মোড়ানো, তাতে সোনালি ফিতা ও শুকনো পাতা দিয়ে তৈরি সবুজ সাজসজ্জা। পাতাগুলো এক পাশের একটি ছোট কার্ড আড়াল করে রেখেছে।

"আমরা এখানেই দুপুরের খাবার খেতে পারি," মা প্রস্তাব করলেন, তিনি ছেলেটির বাহু ধরে এগিয়ে চললেন।

ছেলেটি বিনা আপত্তিতে মায়ের হাত ধরে চলল। সে একটু অস্বস্তিতে ছিল—ভয়ে, যদি মা তার ঘামে ভেজা জামার গন্ধ টের পান। মাত্র কয়েক সেকেন্ড সামনাসামনি দেখেও সে বুঝে গেল—ছবির চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর তার মা। যেন এক জীবন্ত রহস্য।

বসে পড়তেই মা উপহারটি তার হাতে দিলেন।
"জন্মদিনের উপহার—বেশ দেরি করে ফেলেছি, জানি।"

মা হেসে বললেন কথাটা, যেন সত্যিকারের দুঃখ প্রকাশ করলেন না। সে ধন্যবাদ জানাল, কিন্তু দেখল—তার হাত কাঁপছে। ঘাম থামছে না। যতক্ষণে সে সুন্দর খোদাই করা বাক্সটা খুলল, ততক্ষণে ঘামে ভিজে গেছে তার কপাল।

বাক্সের ভেতরে ছিল এক সেট দাবার ঘুঁটি। ঘুঁটিগুলো বাক্সেরই উপকরণ দিয়ে তৈরি, নিচে সবুজ কাপড় লাগানো। সে কিছুই বলতে পারল না। বিশপদের হাতে ছিল বর্শার মতো কিছু একটা, নাইট ঘুঁটির ঘোড়াগুলোর সামনের পা ছিল এমনভাবে তোলা যেন মাথার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, আর প্রতিটিতে ছিল একটি ক্ষুদ্র, গম্ভীর অশ্বারোহী। কালো ঘুঁটিগুলো ঝকঝক করছিল।

"তোর বাবা বলেছে, তুই দাবা খেলায় খুব আগ্রহী," বললেন মা।

"হ্যাঁ," বলল সে, তখনো সাদা রানীটি তার হাতে। মনে হলো, সেটি এক অপার সৌন্দর্য, যেমন তার মা।

তার ক্ষুধা ছিল না, তবু একটা বার্গার আর এক গ্লাস কোমল পানীয় অর্ডার করল। মা নিলেন এক প্লেট সালাদ। নীরবতা ঘিরে রইল। ছেলেটি ভাবল—জিজ্ঞেস করবে কি না, মা এখানে কয়েকদিন থাকবেন কিনা, কিন্তু পরে মত পাল্টাল। ভালো লাগল, খাবারঘরটা ফাঁকা।

"তুই অনেক বড় আর সুন্দর ছেলে হয়ে উঠেছিস," তার হাত ধরে বললেন মা।

সে তাকাল মায়ের হাতে—নাড়িভর্তি শিরা, ছোট ছোট নখ, আর মধ্যমায় একটি কালো পাথরের আংটি। এই প্রথম সে স্পষ্ট শুনতে পেল নিজের হৃদস্পন্দন। চাইল, মায়ের চোখে চোখ রেখে হাসুক, আর বলুক—খুব ভালো লাগছে আবার তার পাশে থাকতে পেরে।

"তুই কী পড়তে চাস?" হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন মা।

"জানি না," উত্তর দিল সে।

"কিছুই ভালো লাগে না?"

"না।"

খাওয়া শেষ হলে মা আবার তার হাত ধরলেন, বললেন,
"আমার দিকে তাকাও তো।"

তাকিয়ে থাকা কঠিন ছিল। মায়ের হালকা বাদামি চোখ খুব কমই পলক ফেলছিল। তিনি আলতো করে তার আঙুলগুলো চেপে ধরলেন।

"আমি যদি এই শহরে ফিরে আসি, তাহলে তুই কি আমার সঙ্গে থাকবি?"

"হ্যাঁ," বলল সে, বিনা দ্বিধায়। যদিও কথাটা তখন তার জন্য সত্য ছিল, তবুও নিজের সোজাসাপ্টা উত্তর শুনে সে নিজেই কিছুটা অবাক হলো। মা জানালার দিকে তাকালেন।

সে জানতে চাইল, মা কোথায় যাচ্ছেন এখান থেকে।

"আজ রাতেই বুয়েনোস আইরেসে যাচ্ছি," বললেন মা।
"একটা সিনেমার প্রস্তাব এসেছে। শুধু তোকে দেখার জন্যই বোগোতা এলাম।" তখনো তার হাত মায়ের হাতে ধরা।

তারা কিছুক্ষণ গল্প করল। ছেলেটি স্কুলের কথা বলল, আর হাসল যখন মা জানতে চাইলেন, তার কোনো প্রেমিকা আছে কিনা।

তারপর তার বাবা এলেন। মায়ের ঠোঁটে ছোট্ট একটি চুমু দিলেন। স্পষ্ট বোঝা গেল—তারা আগেই দেখা করে সব ঠিক করে রেখেছেন। মাকে বাবাই বিমানবন্দরে পৌঁছে দেবেন। ছেলেটি বলল, সে একাই ট্যাক্সি করে ফিরে যাবে।

মা তাকে দরজার কাছে পৌঁছে দিলেন। তার মুখ দুহাতে ধরে, দুই গালে আলতো করে চুমু খেলেন। সে লক্ষ করল—মায়ের চোখে হঠাৎ এক ঝলক দীপ্তি জ্বলে উঠল।

এক সপ্তাহ পরে, মা আর্জেন্টিনা থেকে একটি পোস্টকার্ড পাঠালেন। তখন ছেলেটি তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল, "তুমি কি মনে করো, মা সত্যিই ফিরবেন?"

"এই শহরে?" বাবা বললেন—একেবারে শান্ত ও বেদনাহীন কণ্ঠে, "আমার তো মনে হয় না।"



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews