দক্ষিণ ভারতে কেন কাজ করেনি বিজেপি-র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি?

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

চেন্নাইয়ে ভোটের প্রচারে রোড শো করছেন নরেন্দ্র মোদী। ৯ এপ্রিল, ২০২৪

  • Author,

    শুভজ্যোতি ঘোষ

  • Role,

    বিবিসি নিউজ বাংলা, দিল্লি

  • ২৭ মিনিট আগে

গত ১৬ মার্চ ভারতের লোকসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রথম কোনও সংবাদমাধ্যমে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, সেটি ছিল তামিলনাডুর থান্তি টিভিকে।

শুধু তাই নয়, ওই চ্যানেলের অ্যাঙ্করদেরও চমকে দিয়ে তিনি সাক্ষাৎকারের জন্য হাজির হয়েছিলেন সাবেকি তামিল লুঙ্গি ‘ভেশতি’ পরে, আর সাক্ষাৎকারের শুরুতে বেশ কিছুটা কথা বলেছিলেন ভাঙাভাঙা তামিল ভাষাতেও।

এ বছরের শুরু থেকে তিনি অন্তত বারদশেক তামিলনাডু সফর করেছেন, ভোটের প্রচারে ওই রাজ্যে একের পর এক জনসভা ও রোড শো-ও করে গেছেন ক্লান্তিহীনভাবে।

একই রকম ভাবে প্রধানমন্ত্রী মোদী সম্প্রতি বারে বারে ফিরে গেছেন দক্ষিণ ভারতের আর একটি রাজ্য কেরালাতেও।

গত জানুয়ারিতে অযোধ্যায় নবনির্মিত রামমন্দিরে বিগ্রহের ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ অনুষ্ঠানের আগেও মি মোদী দক্ষিণ ভারতের একের পর এক মন্দির দর্শন করেছেন এবং পুজো দিয়েছেন।

কর্নাটক, তামিলনাডু, তেলেঙ্গানা বা তামিলনাডুর অনেকগুলো মন্দিরই প্রধানমন্ত্রীর সেই তীর্থ পরিক্রমায় ঠাঁই পেয়েছিল।

ফলে ভোটের মরশুমে দাক্ষিণাত্য প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যে প্রবল রাজনৈতিক গুরুত্ব পাচ্ছে তা দেখাই যাচ্ছে।

তামিলনাডুর কোয়াম্বেটোরে বিজেপির হয়ে প্রচারে দলের একাকী সমর্থক

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

তামিলনাডুর কোয়াম্বেটোরে বিজেপির হয়ে প্রচারে দলের একাকী সমর্থক

কিন্তু বাস্তবতা হলো, তামিলনাডু বা কেরালার মতো রাজ্যে এই মুহূর্তে বিজেপির কোনও এমপি বা সংসদ সদস্যই নেই। একই অবস্থা অন্ধ্রেও।

বস্তুত দক্ষিণ ভারতের মোট পাঁচটি রাজ্য (অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, কর্নাটক, তামিলনাডু ও কেরালা) ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (পন্ডিচেরি) মিলে যে মোট ১৩০টি সংসদীয় আসন– বিদায়ী লোকসভায় বিজেপির দখলে ছিল তার মাত্র ২৯টি।

এই ২৯টির মধ্যে ২৫টিই আবার কর্নাটক থেকে, আর বাকি চারটি তেলেঙ্গানায়। কর্নাটকই দাক্ষিণাত্যের একমাত্র রাজ্য যেখানে বিজেপি এককভাবে কখনও সরকার গড়েছে, যদিও গত বছরের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস সেখানে জিতে আবার ক্ষমতায় ফিরেছে।

তবে এবারের লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজে বিজেপি জোটের জন্য ‘আব কি বার চারশো পার’ বা চারশোরও বেশি আসনের যে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছেন – তার ধারেকোছে যেতে হলেও বিজেপিকে দক্ষিণ ভারতে অনেক বেশি আসন পেতে হবে।

কারণ উত্তর, পশ্চিম বা পূর্ব ভারতে যে সব রাজ্য বিজেপির দুর্গ বলে পরিচিত – সেখানে ইতোমধ্যেই প্রায় সর্বোচ্চ সংখ্যক আসন তাদের ঝুলিতে, সেটা আর বাড়ানো কার্যত অসম্ভব। ফলে বিজেপির আসন বাড়ানোর একমাত্র সুযোগ কেবল দক্ষিণেই।

অথচ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস বলে, দাক্ষিণাত্য চিরকালই বিজেপির রাজনৈতিক ভাবধারা ও দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। শতকরা ভোটের হার বা আসনসংখ্যা– দু’দিক থেকেই এই রাজ্যগুলোতে বিজেপির প্রভাব বরাবরই ছিল নগণ্য।

সাবেকি তামিল পোশাকে নরেন্দ্র মোদী সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন চেন্নাইয়ের একটি চ্যানেলেকে

ছবির উৎস, Narendra Modi

ছবির ক্যাপশান,

সাবেকি তামিল পোশাকে নরেন্দ্র মোদী সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন চেন্নাইয়ের একটি চ্যানেলেকে

আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে আঁতাত করে মাঝেসাঝে তামিলনাডু বা অবিভক্ত অন্ধ্রে এক-আধটা আসন পেলেও কর্নাটক ছাড়া বিজেপি দক্ষিণের কোথাওই কিন্তু তেমন কোনও সাফল্য পায়নি।

অন্যভাবে বললে, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিজেপির আত্মপ্রকাশের পর পরবর্তী চার দশকেরও বেশি সময় ধরে (একমাত্র কর্নাটক ছাড়া) দক্ষিণ ভারত বিজেপির কাছে অধরাই রয়ে গেছে। বাকি রাজ্যগুলোতে তারা এমনকি প্রধান বিরোধী দলও হয়ে উঠতে পারেনি।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিজেপির এই ব্যর্থতার পেছনে আসলে নানা ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক বা রাজনৈতিক কারণ আছে– আজ যেগুলো অতিক্রম করার জন্য তারা প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে।

দ্রাবিড় সংস্কৃতির সঙ্গে সংঘাত?

মধ্য ভারতে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত যে বিন্ধ্য পর্বতমালা দাক্ষিণাত্যকে বাকি ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে, সেটাকে শুধু একটা ভৌগোলিক বিভাজন বলে মনে করলে ভুল হবে।

বিন্ধ্যের দক্ষিণে ভারতের যে অংশটুকু,একপাশে বঙ্গোপসাগর আর অন্য পাশে আরব সাগরে ঘেরা সেই দাক্ষিণাত্যই হলো এ দেশে দ্রাবিড় সংস্কৃতির পীঠস্থান। আর স্থলবেষ্টিত উত্তর ভারত বা ‘আর্যাবর্ত’কে মনে করা হয় আর্য সভ্যতার কেন্দ্রস্থল।

এখানে উল্লেখ্য, মহারাষ্ট্র যদিও বিন্ধ্যের দক্ষিণে অবস্থিত – ভারতের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে ওই রাজ্যটিকে পশ্চিম ভারতের অংশ হিসেবেই গণ্য করা হয়। ফলে দক্ষিণ ভারতের মধ্যে আমরা মহারাষ্ট্রকে ধরছি না।

এই দাক্ষিণাত্যের তামিলনাডুতেই আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে ই ভি রামস্বামী বা ‘পেরিয়ারে’র নেতৃত্বে ‘দ্রাবিড়িয়ান আন্দোলনে’র জন্ম, যা আর্যাবর্তের হিন্দু সমাজের জাতপাত বা বর্ণাশ্রম প্রথাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছিল।

ব্লুমবার্গের কলামনিস্ট ও বিশ্লেষক অ্যান্ডি মুখার্জি মনে করেন, দক্ষিণ ভারতে সামাজিক সংস্কারের এই যে একটা দীর্ঘ পরম্পরা আছে সেটাই তাদের উত্তর ভারতের রাজনীতি থেকে চিরকাল আলাদা করে রেখেছে।

দলিত আইকন আম্বেডকর ও পেরিয়ারের ছবি, চেন্নাইয়ের দেওয়ালে

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

দলিত আইকন আম্বেডকর ও পেরিয়ারের ছবি, চেন্নাইয়ের দেওয়ালে

“তামিলনাডু যেমন হিন্দুদের জাতপাতের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন লড়াই করেছে। পাশের রাজ্য কেরালাতেও শিক্ষার হার প্রায় একশোভাগ, আর ওটাই কিন্তু ভারতে প্রথম রাজ্য যেখানে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এসেছিল,” জানাচ্ছেন তিনি।

“ফলে বিজেপির ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কখনওই এখানে পায়ের তলায় জমি খুঁজে পায়নি।”

“পাশাপাশি উত্তর ভারতকে দেখুন, তারা বোধহয় বিশ্বাস করতেই ভুলে গেছে সেখানে সত্যিকারের উন্নয়ন কখনও সম্ভব। ফলে উত্তর ভারতে রামমন্দির দিয়ে মানুষের আবেগকে উসকে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু দক্ষিণে সেটা সম্ভব নয়,” বলছিলেন অ্যান্ডি মুখার্জি।

ভারতের দক্ষিণ আর উত্তরভাগের মধ্যে এই যে বিপুল সাংস্কৃতিক ব্যবধান, প্রধানত উত্তর ভারতের ও হিন্দিভাষীদের দল হিসেবে পরিচিত বিজেপি দক্ষিণে এসে সেই ‘বৈচিত্র্য’র প্রতি সুবিচার করতে পারেনি বলেও বিশ্লেষকরা অনেকেই মনে করেন।

হায়দ্রাবাদ আইআইটি-র অধ্যাপক সৌম্য জানা তার কাজের সুবাদে দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণের রাজ্যগুলো চষে বেড়াচ্ছেন।

তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, “আমার ধারণা স্থান-কাল ভেদে সংস্কৃতির পরতটা যে একটু একটু পাল্টে যায়, দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রে সেই ‘লোকাল ন্যুয়ান্সেস’গুলো বিজেপি ঠিকমতো ধরতেই পারেনি।”

কলাপাতায় পরিবেশন করা বিফ কেরালায় খুব জনপ্রিয় পদ

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

কলাপাতায় পরিবেশন করা বিফ কেরালায় খুব জনপ্রিয় পদ

যেমন ধরা যাক, কেরালাতে ‘বিফ’ বা গরুর মাংস খুবই জনপ্রিয় একটি পদ, লাগোয়া তামিলনাডুতেও বিফ নিষিদ্ধ নয়।

অথচ বাকি দেশে বিফের বিরুদ্ধে বিজেপির উগ্র ও মারমুখী অবস্থান ওই রাজ্যগুলোতে দলটি সম্পর্কে অবশ্যই খুব উচ্চ ধারণা তৈরি করেনি।

“আমার ধারণা বিজেপিকে এই সব কারণেই দক্ষিণ ভারত একটি ‘এলিয়েন’ বা বাইরে থেকে আসা বিজাতীয় দল হিসেবে দেখে এসেছে”, বলছিলেন ড: জানা।

তিনি আরও জানাচ্ছেন, “তা ছাড়া দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে রাজনৈতিক স্পেসটা দীর্ঘদিন ধরেই পুরনো দলগুলো ভর্তি করে রেখেছে, সেখানে বিজেপি ঠিক সেভাবে নতুন কোনও ‘ওপেনিং’ তৈরি করতে পারেনি।”

তামিলনাডুতে যেমন ডিএমকে-এডিএমকে, কেরালায় বামপন্থী-কংগ্রেস কিংবা অন্ধ্র-তেলেঙ্গানায় আঞ্চলিক দলগুলো বনাম কংগ্রেসই দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ‘ব্যাটললাইন’টা স্থির করে এসেছে।

পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে নবাগত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিজেপি নিজের পায়ের তলায় জমি খুঁজে পেয়েছে, সেই একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি কিন্তু দক্ষিণ ভারতে সেভাবে হয়নি।

“এর একমাত্র ব্যতিক্রম হল কর্নাটক, যেখানে ইয়েদিরাপ্পার মতো নেতার হাত ধরে প্রভাবশালী লিঙ্গায়েত হিন্দুদের সমর্থনে বিজেপি রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করতে পেরেছিল,” বলছিলেন সৌম্য জানা।

কর্নাটকে বিজেপির সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারিগর ইয়েদিরাপ্পা

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

কর্নাটকে বিজেপির সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারিগর ইয়েদিরাপ্পা

তামিল সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার মাথুর সত্যা আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বিজেপির ‘বৈষম্য’ প্রতিফলিত হয়েছে খাদ্য-শিল্প-সংস্কৃতির মতো ভাষার ক্ষেত্রেও।

“কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যে জাতীয় শিক্ষানীতি তৈরি করেছে, তাতে সংস্কৃতর কথা অন্তত ২০বার উল্লেখ করা হয়েছে।”

“অথচ সারা দেশে সংস্কৃতে কথা বলেন কতজন? বড়জোর ১৪ হাজার? সেই জায়গায় কোটি কোটি মানুষের মুখের ভাষা তামিল বা মালয়লাম কিন্তু শিক্ষানীতিতে কোনও গুরুত্বই পায়নি”, রীতিমতো আক্ষেপের সুরে বলছিলেন মাথুর সত্যা।

ধর্মভীরু, কিন্তু হিন্দুত্ববাদী নয়?

দক্ষিণ ভারতের বেশ কয়েকটি ‘পকেট’ মুসলিম বা খ্রিষ্টান অধ্যুষিত হলেও সার্বিকভাবে এই গোটা দাক্ষিণাত্যই হিন্দুপ্রধান অঞ্চল। বস্তুত দক্ষিণের পাঁচটি রাজ্য মিলিয়ে জনসংখ্যার আশি শতাংশেরও বেশি হিন্দু।

তার চেয়েও বড় কথা, এই হিন্দু জনগোষ্ঠী সাধারণভাবে খুবই ধর্মভীরু বা ধর্মপ্রাণ। নিয়মিত মন্দিরে যাওয়া, পূজা দেওয়া এগুলো তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ।

তা ছাড়া তিরুপতি, রামেশ্বরম, পদ্মনাভস্বামী বা গুরুভায়ুরের মতো ভারতে হিন্দুদের খুব গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী মন্দিরগুলোর বেশির ভাগই দক্ষিণ ভারতে অবস্থিত।

তা সত্ত্বেও বিজেপির মতো একটি আপাদমস্তক হিন্দুত্ববাদী দল কেন দক্ষিণ ভারতে সেভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, এটা কিছুটা দুর্বোধ্যই বটে।

তামিলভাষী প্রবীণ সাংবাদিক সুধা রামাচন্দ্রন অবশ্য মনে করেন, বিজেপির হিন্দুত্বের সংজ্ঞা আর দাক্ষিণাত্যের মানুষের হিন্দু জীবনচর্যার মধ্যে যে বিরাট ফারাক আছে– সেটাই তার মূল কারণ।

দক্ষিণ ভারতে মন্দিরগুলো হিন্দুদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

দক্ষিণ ভারতে মন্দিরগুলো হিন্দুদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ

‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ সাময়িকীর দক্ষিণ এশিয়া এডিটর মিস রামাচন্দ্রন বলছিলেন, “দক্ষিণ ভারতে যে দ্রাবিড়িয়ান আদর্শবাদ প্রসার পেয়েছে, সেটা ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে।”

“আবার বিজেপিকে এখানে দেখা হয় হিন্দি-হিন্দুত্ব-উচ্চবর্ণের আদর্শের প্রতীক হিসেবে। দুটোর মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত বিরোধ আছেই, যে কারণে বিজেপি এই অঞ্চলের ধর্মভীরু হিন্দুদের মধ্যেও সেভাবে জায়গা করে নিতে পারেনি।”

একই জিনিস একটু অন্যভাবে ব্যাখ্যা করলেন সিপিআইএমের পলিটব্যুরো সদস্য ও তামিলনাডুর প্রবীণ রাজনীতিক জি রামাকৃষ্ণন।

মি রামাকৃষ্ণন বিবিসিকে বলছিলেন, “দক্ষিণ ভারতের মানুষ কিন্তু হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে নন, তবে তারা হিন্দুত্বের বিরোধী।”

“হিন্দুত্ববাদীদের আইকন সাভারকর নিজেই বলেছিলেন হিন্দুত্ব আর হিন্দু ধর্ম এক জিনিস নয়। তাদের হিন্দুত্ব হলো একটা পলিটিক্যাল প্রোজেক্ট, যেটা দক্ষিণ ভারতের মানুষ চিরকাল বর্জন করে এসেছে,” বলছিলেন বর্ষীয়ান এই বামপন্থী নেতা।

কেরালায় যেমন হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিষ্টান– তিনটি সম্প্রদায়ই প্রায় সমান শক্তিশালী, এবং একটা পারস্পরিক সহাবস্থানের মধ্যে দিয়েই তারা শত শত শত বছর পাশাপাশি থেকেছে।

সব সময় তা হয়তো শান্তিপূর্ণ ছিল না, কিন্তু এই ধর্মীয় বিরোধ ওই রাজ্যের আর্থসামাজিক বা শিক্ষার উন্নয়নে কখনও বাধা হয়ে দেখা দেয়নি।

কেরালায় হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের সহাবস্থান বহুকাল ধরে

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

কেরালায় হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের সহাবস্থান বহুকাল ধরে

“এখানে বিজেপি-আরএসএসের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি একটা ‘ডিসরাপ্টিভ ফোর্স’ হিসেবে ঢোকার চেষ্টা করলেও কেরালার মানুষ নিজেদের স্বার্থেই তা প্রত্যাখ্যান করেছেন,” বলছিলেন মি রামাকৃষ্ণন।

আমেরিকার ব্রাউন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অধ্যাপক আশুতোষ ভার্শনে আবার এর পেছনে কিছু ঐতিহাসিক কারণ দেখাচ্ছেন।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, “হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের আদর্শকে রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে রাখার জন্য যে ধরনের ঐতিহাসিক নিদর্শন বা অবশেষ থাকা দরকার, তেলেঙ্গানা বা কর্নাটকের মতো রাজ্যে তার কিছু কিছু আছে।”

যেমন কর্নাটকের মহীশূরে টিপু সুলতানের শাসনকাল বা তেলেঙ্গানার হায়দ্রাবাদে নিজামের শাসনকে এরকম নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে।

“কিন্তু তামিলনাডু, কেরালা বা অন্ধ্রে ওই ধরনের কোনও ঐতিহাসিক নিদর্শন নেই, এটা কিন্তু মনে রাখতে হবে।”

ফলে ড. ভার্শনে যুক্তি দিচ্ছেন দক্ষিণ ভারতে বিজেপির সীমিত যেটুকু সাফল্য – তা কর্নাটক বা তেলেঙ্গানাতেই সীমাবদ্ধ এবং ঠিক সেই কারণেই বাকি রাজ্যগুলোতে দলটি তেমন কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।

বিজেপির চোখে ‘দক্ষিণী প্রহেলিকা’

দক্ষিণ ভারতের ‘রাজনৈতিক রহস্য’টা যে তারা দীর্ঘদিন ভেদ করতে পারেননি, দিল্লিতে শীর্ষস্থানীয় বিজেপি নেতারা একান্ত আলোচনায় তা একরকম খোলাখুলিই স্বীকার করেন।

বিজেপির পলিসি রিসার্চ উইং-য়ের প্রধান তথা জাতীয় স্তরে দলের সাবেক ভাইস-প্রেসিডন্ট ড. বিনয় সহস্রবুদ্ধেও মানছেন, বিজেপিকে নিয়ে দক্ষিণ ভারতে নানা রকমের ‘ভুল ধারণা’ও আছে।

বিজেপি নেতা বিনয় সহস্রবুদ্ধে

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

বিজেপি নেতা বিনয় সহস্রবুদ্ধে

ড. সহস্রবুদ্ধে বিবিসিকে বলছিলেন, “এটা ঠিকই যে দাক্ষিণাত্যে বিজেপিকে বহুদিন ধরেই উত্তর ভারতের দল, হিন্দি ভাষাভাষীদের দল কিংবা অ্যান্টি-দ্রাবিড় হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে এবং আমরা তার উপযুক্ত জবাব দিতে পারিনি।”

তবে একই সঙ্গে তিনি দাবি করছেন, গত এক দশকে নরেন্দ্র মোদীর শাসনে সেই ‘ভুল’গুলো অনেকটাই ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

“আমরা এই দশ বছরে দক্ষিণের মানুষের কাছেও ‘রিচ আউট’ করেছি। তারা আমাদের কাছ থেকে দেখেছেন, আমাদের সরকারের শাসন পদ্ধতি আর কাজকর্ম বুঝতে পেরেছেন এবং সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের গ্রহণ করেছেন”, বলছিলেন ড. সহস্রবুদ্ধে।

একটা কথা ঠিকই, দক্ষিণ ভারতে বহুদিন হালে পানি না-পেলেও বিজেপি কিন্তু সেখানে কখনওই হাল ছেড়ে দিয়ে বসে যায়নি – বরং মাটি কামড়ে থেকে তারা কোথাও একটা বিধানসভা আসন, কোথাও বা একটা মিউনিসিপালিটি ওয়ার্ড দখলের জন্যও জোরালো লড়াই চালিয়ে গেছে।

“এই ধরা যাক একজন বিজেপি এমএলএ কিংবা একজন বিজেপি কাউন্সিলর, এদের পারফরমেন্স দেখেও কিন্তু দক্ষিণ ভারতের মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছেন বিজেপি অন্য রকম একটা দল!”

“আমাদের সম্বন্ধে যে অপপ্রচারগুলো চালানো হতো, সেগুলোও যে মিথ্যে এটা আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি,” আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানাচ্ছেন বিনয় সহস্রবুদ্ধে।

ডিএমকে নেতা ও তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী স্টালিন

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

ডিএমকে নেতা ও তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী স্টালিন

দক্ষিণে বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা অবশ্য পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন, কেন্দ্রে গত এক দশক ধরে নরেন্দ্র মোদীর শাসন দক্ষিণ ভারতীয়দের বিজেপির প্রতি আরও ক্ষুব্ধ ও রুষ্ট করে তুলেছে।

তামিলনাডুর শাসক দল ডিএমকে যেমন লাগাতার প্রচার করছে, বিজেপি দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে মানতে চায় না এবং রাজ্যগুলির ক্ষমতাকে ক্রমাগত খর্ব করে চলেছে।

রাজ্যে ডিএমকে-র জোটসঙ্গী সিপিএমের নেতা জি রামাকৃষ্ণন বলছিলেন, “বিজেপি যে সব রাজ্যে ক্ষমতায় নেই, সেখানে নিজেদের এজেন্টকে রাজ্যপাল করে পাঠিয়ে সারাক্ষণ ওই রাজ্য সরকারগুলোর সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। তামিলনাডু এর সব চেয়ে কুৎসিত দৃষ্টান্ত।”

“তাছাড়া দক্ষিণের রাজ্যগুলো, যেগুলোকে বলা চলে ভারতের গ্রোথ ইঞ্জিন – অর্থনৈতিকভাবেও দিল্লি তাদের ক্রমাগত বঞ্চিত করে চলেছে”, বলছিলেন তিনি।

ডিএমকে যেমন জানাচ্ছে, তামিলনাডু যদি কেন্দ্রকে ১ রুপি রাজস্ব হিসেবে দেয় – তার থেকে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ হিসেবে ফেরত পায় মাত্র ২৯ পয়সা। অথচ উত্তরপ্রদেশের মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্য ১ রুপি দিয়ে ফেরত পাচ্ছে ২ রুপি ২০ পয়সা!

এই ধরনের ‘নির্লজ্জ বঞ্চনা’র পর দক্ষিণ ভারতে বিজেপির সমর্থন বাড়ার আসলে কোনও সম্ভাবনাই নেই, যুক্তি দিচ্ছেন তারা।

সিপিআইএমের পলিটব্যুরো সদস্য জি রামাকৃষ্ণন

ছবির উৎস, G Ramakrishnan

ছবির ক্যাপশান,

সিপিআইএমের পলিটব্যুরো সদস্য জি রামাকৃষ্ণন

আগামী দিনে বিজেপির সঙ্গে ‘দক্ষিণে’র আর একটি সম্ভাব্য সংঘাতের দিকেও দিকনির্দেশ করছেন নামী ইতিহাসবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক রামচন্দ্র গুহ।

তিনি বলছেন, বিজেপি টানা তৃতীয়বার জিতে ক্ষমতায় এলে দেশে জনসংখ্যার ভিত্তিতে লোকসভা আসনগুলোর পুনর্বিন্যাসের নীতি বাস্তবায়নের পথে হাঁটবে – এটা ধরেই নেওয়া যায়।

“এর ফলে জনবহুল উত্তর ভারতে আসনের সংখ্যা এখনকার চেয়েও আরও অনেক বাড়বে, আর সফলভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ করেও দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে এমপি-র সংখ্যা কমে যাবে।”

“দক্ষিণ ভারত এটা চুপ করে মাথা পেতে নেবে, সেটা ভাবার কিন্তু কোনও কারণ নেই,” প্রচ্ছন্ন সতর্কতার সুরে বলছেন রামচন্দ্র গুহ।

দক্ষিণে তাহলে বিজেপির ভবিষ্যৎ কী?

বিজেপির নীতি, এজেন্ডা ও ইতিহাসের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতে দলটির গ্রহণযোগ্যতার একটা সরাসরি সংঘাত আছে, এটা তারাও খুব ভাল করেই জানে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও ২০২৪র লোকসভা নির্বাচনে তারা যেভাবে দেশের ওই অঞ্চলে মরিয়া প্রচার চালাচ্ছে এবং শক্তি সংহত করেছে, তা এর আগে কখনওই দেখা যায়নি।

বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীই এখানে তাদের তুরুপের তাস। দেশের বহু প্রান্তে যেভাবে মোদীর ব্যক্তিগত ক্যারিশমা বা ‘মোদী ম্যাজিক’ বারবার কাজ করেছে, দক্ষিণেও তা না-করার কোনও কারণ নেই বলে তাদের ধারণা।

কেরালার তিরুবনন্তপুরমে বিজেপির ভোটের প্রচার

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

কেরালার তিরুবনন্তপুরমে বিজেপির ভোটের প্রচার

এ কারণেই নরেন্দ্র মোদী বারবার ওই অঞ্চলে ভোটের প্রচারে গেছেন, যাচ্ছেন। তামিলনাডুতে দলের বর্তমান সভাপতি, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ও সুবক্তা আন্নামালাইয়ের জনপ্রিয়তার ওপরও বিরাট ভরসা করছে বিজেপি।

তামিল ভাবাবেগকে উসকে দেওয়ার জন্য পঞ্চাশ বছর আগে কচ্ছথিভু নামে যে দ্বীপটির ওপর দাবি শ্রীলংকাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, বিজেপির পক্ষ থেকে সেই পুরনো ইস্যুটিও নতুন করে খুঁচিয়ে তোলা হয়েছে।

এদিকে কর্নাটকে জনতা দল (সেকুলার) বা অন্ধ্রে তেলুগু দেশমের মতো আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাতও করেছে তারা – তাতেও ওই দুটো রাজ্যে বিজেপির আসন সংখ্যা কিছুটা বাড়তে পারে।

কেরালা বা তামিলনাডুতে বিজেপি অবশ্য মূলত একাই লড়ছে। তামিলনাডুতে অন্যতম প্রধান দল এআইডিএমকে তাদের সঙ্গ ছাড়ার পর বিজেপি জোট গড়েছে রাজ্যের ছোট কয়েকটি দলের সঙ্গে।

এই ধরনের ‘সর্বাত্মক প্রচেষ্টা’র পরও দক্ষিণ ভারতে বিজেপির আসন সংখ্যা (গতবারের ২৯র চেয়ে) খুব একটা বাড়বে বলে রাজনৈতিক পন্ডিতরা মনে করছেন না।

বিশ্লেষক সুধা রামাচন্দ্রন যেমন পূর্বাভাস করছেন, “তামিলনাডুতে বিজেপির ভোটের শতকরা হার এবার অবশ্যই বাড়বে। কিন্তু তাতে তাদের কপালে কোনও লোকসভা আসন জুটবে, এমন লক্ষণ কিন্তু দেখা যাচ্ছে না।”

কেরালাতেও বিজেপি যেমন নির্দিষ্ট দু-তিনটি আসনে জেতার লক্ষ্য নিয়ে ঝাঁপিয়েছে। এর একটি হল তিরুবনন্তপুরম, যেখানে বর্তমান এমপি, কংগ্রেসের শশী থারুরের বিরুদ্ধে লড়ছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর।

তামিলনাডুতে বিজেপির সভাপতি আন্নামালাই

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

তামিলনাডুতে বিজেপির সভাপতি আন্নামালাই

কেরালাতে কোনও দিনই বিজেপি কোনও লোকসভা আসনে জেতেনি। কেরালা থেকে লোকসভায় এমপি পাঠানোর স্বপ্ন তাদের এবারেও অপূর্ণ থাকবে বলে ওই রাজ্যের বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন।

তবে তারা অনেকেই বলছেন বিজেপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে একটা দীর্ঘমেয়াদি স্ট্র্যাটেজি নিয়ে চলার ছাপ আছে – যা থেকে মনে করা যেতে পারে ২০২৪-এ না-হলেও ২০২৯য়ে এই দুটো রাজ্য থেকেই তারা আসন জেতার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে।

বিজেপি নেতা বিনয় সহস্রবুদ্ধে আবার জোর গলায় দাবি করছেন, এই ২০২৪-এও দক্ষিণ ভারতে বিজেপির ফল অনেককে চমকে দেবে!

“আমি কোনও সংখ্যায় যাচ্ছি না। তবে আমাদের নিজস্ব ক্যালকুলেশন কিন্তু বলছে তামিলনাডু বা কেরালার মতো রাজ্য থেকেও আমাদের একাধিক প্রার্থী পার্লামেন্টে যাচ্ছেন। ৪ঠা জুন গণনার দিন শুধু আমার কথাটা মিলিয়ে নেবেন”, বিবিসিকে বলছিলেন ড. সহস্রবুদ্ধে।

দাক্ষিণাত্য বিজেপিকে আরও একবার নিরাশ করবে, না কি আগামী দিনে তাদের জন্য সেখানে একটা সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দেবে – সেটা জানার জন্য আরও প্রায় মাসদেড়েক অপেক্ষা করা ছাড়া তাই গতি নেই!

(পুরো তামিলনাড়ুতে ভোট হয়েছে গত ১৯শে এপ্রিল। ২৬ এপ্রিল (শুক্রবার) ভোট হচ্ছে কেরালায় আর দক্ষিণ কর্নাটকে। কর্নাটকের উত্তরাঞ্চলে ভোট ৭ মে, আর অন্ধ্র ও তেলেঙ্গানায় ১৩ মে। বাকি দেশের সঙ্গে এই রাজ্যগুলোতেও ভোট গণনা হবে ৪ঠা জুন)



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews