রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ ব্যয়ে কোনো কর্মকর্তার বিদেশ প্রত্যাবর্তন মানে এখানেই তার দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল বা আগ্রহে ভাটা পড়ে যাবে, তা মোটেই কাক্সিক্ষত নয়। এবং এমনটা যাতে কেউ মনে না করতে পারেন এর একটা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম। তিনি সবাইকে জানিয়ে দিলেন এখন থেকে প্রতি রবিবার প্রথম প্রহরে সদ্য বিদেশফেরত কর্মকর্তার সঙ্গে একটা মনোজ্ঞ চা-চক্র হবে। ছোট্ট একটি উপস্থাপনায় তিনি তাঁর সফর সম্পর্কে সহকর্মীদের অবহিত করবেন। এতে সচিবসহ সব কর্মকর্তাই স্বতঃস্ফূর্ততায় অংশ নেবেন এবং তৎপরবর্তীতে যথারীতি দিনের কাজ শুরু করবেন। সফরকালে একটা দেশ, সরকার, ওখানকার অর্থনীতি, রাজনীতি, ভূপ্রাকৃতিক সম্পদ ও বিদ্যমান আমলাতন্ত্র সম্পর্কে একজন নবীন কর্মকর্তা কতটুকু আগ্রহী, তিনি কীভাবে দেখেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে মিল-অমিল, গ্রহণীয়-বর্জনীয় বিষয় কী কী হতে পারে ইত্যাদি নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা। এতে যে-কেউ প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করতে পারবেন। তবে কোনো বাধ্যবাধকতার বিষয় নয়। একজন নবীন কর্মকর্তার পর্যবেক্ষণ, আত্মবিশ্বাস ও মননশীল দৃষ্টিভঙ্গি যাচাই করাই মূল লক্ষ্য।

প্রজাতন্ত্রের কর্মে অতটা সময় পার করে এসে এখন অখণ্ড অবকাশে এসে ভাবছি, কেবল বিদ্যালয় বা শিক্ষায়তনে নয়, সরকারি চাকরিতেও ভালো শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। অধস্তনের কাছে জ্যেষ্ঠতরগণ সর্বত্রই শিক্ষকতুল্য। তবে খাঁটি দেশপ্রেম, মাটি ও মানুষের প্রতি নিঃশর্ত অঙ্গীকার ও একচ্ছত্র প্রতিশ্রুতি ছাড়া অনেকের পক্ষে এটি হয়ে ওঠে না।

বিদেশ ভ্রমণ নাকি মানুষের রাশিফলেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিদেশে যাওয়া ভাগ্যে লেখা থাকতে হয়। মানুষ জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে প্রথম জানতে চায় তার ভূতভবিষ্যৎ বা অর্থবিত্তের সম্ভাবনা কতটুকু। দ্বিতীয় চাওয়া হয়, তার হাতে বিদেশ-রেখা আছে কি না! চাকরি জীবনে এ কথা আমি অনেক সময় ভেবেছি, ললাটলিখন না থাকলে হাতে টিকিট পেয়েও বিদেশ যাওয়া সম্ভব হয় না। আমার নিজের বেলায়ও এমন জ্বলন্ত নজির আছে। সরকারি আদেশ ও এয়ার টিকিট হাতে এসে পৌঁছেছে, কিন্তু পরদিন আমার শ্রীলঙ্কার কলম্বোয় যাওয়া হয়নি, যেতে হয়েছিল খাগড়াছড়ি!

মানুষ জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে প্রথম জানতে চায় তার ভূতভবিষ্যৎ বা অর্থবিত্তের সম্ভাবনা কতটুকু। দ্বিতীয় চাওয়া হয়, তার হাতে বিদেশ-রেখা আছে কি না! চাকরি জীবনে এ কথা আমি অনেক সময় ভেবেছি, ললাটলিখন না থাকলে হাতে টিকিট পেয়েও বিদেশ যাওয়া সম্ভব হয় না

তা ছাড়া প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে পদাধিকারী হিসেবে বিদেশ সফরের সুযোগ পাওয়ার জন্য নানাবিধ কৌশল, লবিং ও কর্তৃপক্ষের আস্থাভাজন হওয়া খুবই জরুরি। বিদেশের ক্ষেত্রে কেবল দাফতরিক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বিবেচনায় শতভাগ নিরপেক্ষতা বা নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়নে প্রার্থী মনোনয়ন করা হয় না বা করা যায় না। সব দলীয় সরকারের সময়ে এর যাচাই-বাছাই হয় অনেকটা নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে। এতে কখনো কখনো বিদ্যমান নীতিমালার প্রয়োগ গৌণ হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে সব সময় সরকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়।

চাকরিতে প্রথম দেশের বাইরে এবং একই সঙ্গে বিমানে চড়ি নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। ঢাকা থেকে ব্যাংকক হয়ে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা পর্যন্ত ছিল এ সফর। প্রথম, তবে কয়েক সপ্তাহের এ ভ্রমণ ছিল নিঃসন্দেহে কৌতূহলোদ্দীপক এবং অবিশ্বাস্য আবেগাপ্লুত। ভয় ও আনন্দ মিলিয়ে ভ্রমণ ছিল অভিজ্ঞতার প্রথম পাট। এশিয়ার এ দ্বীপরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার ঐতিহাসিক বান্দুং শহর, কিংবদন্তি রাজনীতিক ড. সুকর্ণর নেতৃত্বে ১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত বান্দুং সম্মেলনের স্থান ও ভিডিওচিত্র দেখে বিমোহিত হয়েছিলাম। সে সময় দেশটির জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি থেকে উদ্গত লাভা দেখে শঙ্কিত বোধ করেছিলাম। দাউদাউ রক্তিম আগুনের উত্তাপ-তরঙ্গ আছড়ে পড়েছিল চারদিকে। সে সময় বিভিন্ন প্রদেশে তথা জনপদে যাওয়ার এবং অবস্থানের বিরল সুযোগ হয়েছিল। পরে বিদেশ সফর করি সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের কতিপয় রাজ্যে। বিশেষ করে দিল্লি, আগ্রা, জয়পুর, মুম্বাই, রাজস্থান, আজমির ও আনাসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে আলোর ঝলকানিতে নিসর্গের সৌন্দর্য উপভোগ করেছি দুবার। চাকরির জ্যেষ্ঠতার মাপকাঠিতে পরে একে একে সফর করার সুযোগ আসে নিউইয়র্ক-ওয়াশিংটনসহ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অঙ্গরাজ্যে। স্বল্পসময়ের জন্য দেখার সুযোগ মিলেছে বোস্টন সিটি এবং বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নানন্দিক ক্যাম্পাস। দেখেছি যুক্তরাজ্যের ডাউনিং স্ট্রিট, অক্সফোর্ডসহ নানা ঐতিহাসিক স্থান। মনে পড়ে, কোনো এক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ইংল্যান্ডের বাঙালি অধ্যুষিত ব্রিকলেন এলাকা থেকে গভীর রাতে বন্ধুদের সঙ্গে শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করি। জেনেভা লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর বিচিত্র পর্যটকের অবাধ বিচরণ আর ঘড়ির আদিভুবনে হারিয়ে গিয়েও মুগ্ধ হয়েছি বারবার।

ইউরোপ সব সময়ই প্রাচ্যদেশিদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলেও আমার অনুভূতি একটু ভিন্ন। বেশি দিনের জন্য আমাকে কোনো মাটিই টানে না। আমার জন্মগত দুর্বলতা আমার জন্মভূমি। ‘হোমসিক’ বলতে যা বোঝায় তা পুরোটাই আমার ভিতরে প্রবলভাবে বাস করে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, লেখাপড়া, উচ্চশিক্ষা, ডিগ্রি, জ্ঞান অর্জনের নিমিত্ত ইউরোপ সত্যিই পৃথিবীর তীর্থভূমি। তবু এশিয়া, ভারতবর্ষ বা আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের তুলনা হয় না। যেন জন্মভূমি স্বর্গগরীয়সী জননীর মতো। ভাববাদী দার্শনিক হেগেল একবার বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষ সব সময় আমাদের কাছে কল্পলোকের এক মায়াবী স্বর্গরাজ্য।’ ইউরোপে আমি সর্বোচ্চ ১৫ দিন করে থেকেছি। সেটা দুবার, ইংল্যান্ড এবং ইতালিতে। তারপর সস্ত্রীক ১০ দিনের জন্য গিয়ে নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশে সংক্ষিপ্ত সফর করেছি। প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, রোমের ঐতিহ্যবাহী মিউজিয়াম, ভ্যাটিকান সিটি, ভেনিস শহরের জলজ সৌন্দর্য, জার্মানির রাইন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে দেখে নিয়েছিলাম এদের জাতীয় সমৃদ্ধির নানাবিধ কলাকৌশলের শিখরস্পর্শী অর্জন। তবে সবই দেখেছি পাখির চোখে।

ফাঁকে ফাঁকে সরকারের ইডেন ভবনে কাজ করার সুবাদে এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় যাওয়ার আকস্মিক সুযোগ চলে আসে বেশ কয়েকবার। এক প্রসন্ন সকালে বস্ বললেন, নেপালে আগে না গেলে চল। তাই তো! আমি যাইনি। কাজেই দু-তিন দিন বাদেই কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট। নেপাল পাহাড়ের জনপদ, হিমালয়ের হাতছানি, সূর্যোদয় উপভোগ, লং জার্নির ফুকারা ইত্যাদি। তেমনি থাই পর্বতমালার বুক চিড়ে দীর্ঘ পথ মাড়িয়ে পাথায়ার কৃত্রিম সৈকতে চোখ রাখা, এদের উন্নতমানের হাসপাতালের সেবা খাতের বাস্তব চিত্র দেখা। মহাচীন আমাকে ভীষণভাবে টানে। গ্রেট নেশন। আশ্চর্য প্রাচীর আর মাও সে তুংয়ের লংমার্চ যেন মুখস্থবিদ্যা। কিন্তু কুনমিং আর গুয়াংজু পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেও সাংহাই-বেইজিংয়ের দেখা পাইনি। ফিলিপিনের স্বচ্ছ জলের লেকে একদিন উদাস চোখ রেখেছিলাম, কম্বোডিয়ার নমপেনে নেমে বানান বিভ্রাটের মতো চোখের ধাঁধায় পড়ে যাই। দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাস্থ্যসেবায় ইন্স্যুরেন্সের প্রভাব, রকমারি গাড়ির বাহার, মেট্রোরেল প্রকল্পের সফলতা, নদীর ওপর নয়নাভিরাম সেতু, পাহাড়কাটা পথ, মনোরম স্নিগ্ধতায় ছোঁয়া বৃক্ষের সারি, স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, জনবান্ধব পরিবেশ আর মানুষের নিরন্তর পরিশ্রমই যেন এ পৃথিবীর শেষ কথা।

বিদেশপ্রিয় কর্মকর্তারা সব সময় মওকা খুঁজে বেড়ায়, নেশা শুধু বিদেশ যাওয়ার। তারা সরকারকে ফাঁকি দেওয়ার বিরামহীন ঘোরের ভিতর থাকে। মাঠে ঘাটে পদায়নে তাদের ন্যূনতম আগ্রহ নেই। এ ক্ষেত্রে বছরের কোটা ফুরিয়ে গেলেও শিথিল করার সুযোগ নিয়ে নেয়। কেউ কেউ শুরুতে লিয়েন নিয়ে কালক্ষেপণ, পরে ডিপ্লোমা, এমএস পিএইচডি, পোস্ট ডক্টরাল এসব নানাবিধ উচ্চশিক্ষার নামে বছরের পর বছর বিদেশে বসে সময় কাটানোয় তাদের পরম তৃপ্তি। বলা বাহুল্য, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশি এসব ডিগ্রি আমাদের ব্যবস্থায় খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। তবু দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক জীবনও এদের কাছে সীমাহীন আত্মমর্যাদার। এদের কাছে মাতৃভূমি কোথায়? জন্মভূমির মাটি কোথায়? মহাভারতের শ্লোক বলে, ‘এরাই অসুখী, যারা বিভূঁইয়ে স্থায়ী হয়ে যায়।’ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু নাকি তাঁর কাছে থাকা দু-এক জন ব্যক্তিগত কর্মচারীকে বলেছিলেন, ‘তোমরা আর কত পড়াশোনা করবা, আমার এই দেশের জন্য কাজ করবে কারা?’ তারা যায়, তারা আসে, যথাসময়ে পদোন্নতিও পায়। তাদের অনেকেরই মাঠ প্রশাসনে চাকরি নেই, শত্রুও নেই। যেন অজাতশত্রু সুশীলসেবক তারা। এখানে অচেনা অদৃশ্যদের পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। তারা প্রাপ্ত ছুটি শেষ করে গড় বা অর্ধগড় বেতনে, বিনা বেতনে, বিশেষ পারিবারিক কারণে মেডিকেল সার্টিফিকেট দিয়েও ছুটি নিয়ে পরবাসী হতে ইচ্ছুক। ফিরে এসে চাকরিও বহাল তবিয়তে। তবে একেবারে না-ফেরার নজিরও কম নয়।

অন্যদিকে ক্রমাগত বদলির শঙ্কা মাথায় রেখে মাঠের চাকরি। পাবলিক পরীক্ষা, স্থানীয় সরকার নির্বাচন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন, জাতীয় দিবস উদযাপন, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, অতিমারি, অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ মোকাবিলা, রাষ্ট্রাচার, সার্কিট হাউস ব্যবস্থাপনা, প্রটোকল, আপ্যায়ন, গাড়ি অধিযাচন, অন্য সহকর্মীদের বিরাগভাজন হওয়া তবু খোশমেজাজের প্রশাসক। বিদেশি ডিগ্রি নেই, ছুটিবিলাসের সুযোগ নেই, পরিবার, স্ত্রী-সন্তান প্রায় বিচ্ছিন্ন। এসব নিয়েই ছিল আমাদের সময়ের মাঠ প্রশাসন। এরই মধ্যে দেখতে দেখতে চাকরি প্রান্তে এসে দরজায় কড়া নাড়ে। বিদেশে শিক্ষারও বয়স নেই। এবার নিজের টেবিলের ওপর জীবনের নথি। অর্জিত ছুটির হিসাব দেখে অপরাহ্ণের অবসন্ন দৃষ্টিতে অনুশোচনার অন্ত নেই। ৩২ বছরের চাকরিতে দুই বছরের অধিক ছুটি পাওনা আছে। কোনো কাজে আসছে না। এখন কোথাও কেউ নেই। বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস আতঙ্কের এখনো অবসান হয়নি।

লেখক : সাবেক সচিব



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews