আজ আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস। কভিড-১৯ মহামারির কারণে সীমিত পরিসরে হলেও বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব এই দিবসটি পালন করছে। আমরা জানি, ১৯৯৫ সালের ১৬ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থার (ইউনেসকো) সদস্য রাষ্ট্রগুলো ‘সহনশীলতা নীতির ঘোষণাপত্র’টি সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে। ওই ঘোষণায় মানুষকে সহনশীলতার মূল্যবোধ ও গুরুত্ব সম্পর্কে সজাগ করার জন্য এ বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক দিবস উদযাপনের আহ্বান জানানো হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৯৬ সালে ৫১/৯৫ নম্বর প্রস্তাবটি গ্রহণের মাধ্যমে ১৬ নভেম্বরকে আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টি নির্ধারণ করা হয়—‘সহনশীলতা হলো আমাদের বিশ্বের সংস্কৃতির সমৃদ্ধশালী বৈচিত্র্য, আমাদের প্রকাশের ধরন এবং মানুষ হওয়ার উপায়গুলোর সম্মান, গ্রহণযোগ্যতা এবং উপলব্ধি।’ ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘ সহনশীলতা বছর এবং মহাত্মা গান্ধীর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ইউনেসকো সহনশীলতা এবং অহিংসা জোরালো করার জন্য ইউনেসকো-মদনজিৎ সিং পুরস্কার নামে একটি পুরস্কারেরও প্রবর্তন করে।
আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস উদযাপনের উদ্দেশ্য হলো সহনশীলতার নীতি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। এই দিনটি পালিত হয় অন্যের সংস্কৃতি, ধর্ম এবং ঐতিহ্যকে সম্মান করার এবং সমাজে অসহিষ্ণুতা ও বৈষম্যের ঝুঁকি অনুধাবন করার জন্য। সত্যি বলতে কী, ধর্মীয় বিশ্বাস, জাতি, রাজনীতি এবং ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর বিভিন্ন মতামত এবং দৃষ্টিভঙ্গি নানা সম্প্রদায়ের সম্মিলনে গড়া সমাজেরই একেক বর্ণ। আমরা জানি যে মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, বিশ্বের সংস্কৃতি এবং মৌলিক স্বাধীনতা বিশ্বকে আরো সুন্দর এবং আনন্দময় করেছে। আজ সমাজকে ঘৃণা, শত্রুতা, নিপীড়ন ও অন্যায়ের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার শপথ নেওয়ার দিন, যাতে আমরা সমগ্র পৃথিবীকে একটি শান্তির প্রাণবন্ত আবাসে পরিণত করতে পারি।
সহনশীলতা একটি শক্তিশালী উপায়, যা একজন ব্যক্তির জন্য সামগ্রিক সুফল বয়ে নিয়ে আসে। জীবনে সাফল্য লাভ করার জন্য আমাদের অবশ্যই সহনশীল হতে হবে। এমনকি আমাদের খারাপ বা দুর্যোগ সময়ে প্রবীণরা আমাদের সহনশীল হতে এবং আকাশ থেকে মেঘ অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন। মেঘ কেটে গেলেই যে সূর্যের আলোতে সব কিছু ঝলমলিয়ে উঠবে। সহনশীলতা মানুষকে সংগ্রাম করতে এবং তাদের প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহস জোগায়। সহনশীলতাহীন জীবন কখনোই অসাধারণ কিছু আশা করতে পারে না। সহনশীলতা আমাদের সব সমস্যা থেকে উত্তরণের প্রত্যাশা দেয়।
আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা অন্যের কথা শুনতে চায় না বা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। অথচ অন্যদের কথা শোনার সহনশীলতা তাদের থাকা উচিত। অন্যদের কথা শোনার ফলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সমৃদ্ধ করার এবং আরো ভালো করে আমাদের অবস্থানকে বোঝার সুযোগ হতে পারে। এভাবে অসহিষ্ণুতার কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের কথা শোনার ফলে আমরা অনেক নতুন তথ্য পেতে পারি, আপনার জ্ঞানের পরিধি বেড়ে যেতে পারে। আমাদের দুটি কান এবং একটি মুখ রয়েছে। সৃষ্টির এ রহস্য আমার জানা নেই। তবে যতটুকু বুঝি, আমরা কথা বলার চেয়ে দ্বিগুণ শুনব। এ ব্যাপারে সহনশীলতা আমাদের সহায়ক হতে পারে।
একদিকে দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে, যোগাযোগের বিকাশ ঘটছে এবং জীবনযাত্রার মানও বাড়ছে। অন্যদিকে সমাজে সহনশীলতা কমে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিশ্বাস-নির্বিশেষে সমাজে অসহিষ্ণুতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের চর্চারও অভাব দেখা যাচ্ছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষও নানা সম্প্রদায়ের মিশ্রণ এবং এই মিশ্র সম্প্রদায়ের সমাজে বেঁচে থাকা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই সহনশীল হওয়া একান্ত প্রয়োজন, যা বিশ্বের এই অংশে শতাব্দীকাল ধরে বিদ্যমান।
সহনশীলতা শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয়, বর্তমান সমাজের প্রতিটি স্তরে তার শক্তিশালী উপস্থিতি কাম্য। আইনের প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু অসহিষ্ণুতা প্রতিরোধে শুধু আইনই যথেষ্ট নয়। অতএব সহনশীলতা বৃদ্ধি এবং সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সহনশীলতা এবং অহিংসা প্রচারের জন্য সমতা এবং মৌলিক মানবাধিকারের জন্য আইন প্রণয়ন করা উচিত। আইনি কাঠামোর এমন বাস্তবায়ন থাকতে হবে, যাতে মানুষ বিচার নিজেদের হাতে তুলে নিতে না পারে এবং তাদের বিরোধ মেটানোর জন্য সহিংসতার আশ্রয় নিতে না পারে। অসহিষ্ণুতা প্রায়শই একজন ব্যক্তি বা একটি গোষ্ঠীর রাজনৈতিক বা অন্যান্য দুরভিসন্ধি পূরণ করতে সাহায্য করে। এসব ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ছাড়াও মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যখন অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পায়, আমাদের অবিলম্বে এগিয়ে আসা এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সর্বোত্তম প্রচেষ্টা করা উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সহনশীলতার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে হবে এবং তাদের জীবনের প্রতিক্ষেত্রে সহনশীল হতে অনুপ্রাণিত করতে হবে। দেশের প্রত্যেক মানুষকে সহনশীল হতে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন সচেতনতামূলক আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস উদযাপন করার এই শুভ দিনে আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে বাংলাদেশে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টির, যাতে প্রত্যেক নাগরিক নির্দ্বিধায় তার বিশ্বাস ও মতামত প্রকাশ করতে পারে। কারো মতামত বা চিন্তা-ভাবনা যদি অন্যের চোখে আপত্তিকর হয়, তাহলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করা উচিত। এটাই সহনশীলতার শিক্ষা। আমাদের সহনশীলতার শক্তিতে আমরা যেন সমাজের প্রতিটি স্তরে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রেখে বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি সেই প্রত্যাশাই রইল।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব