ছবি বা ফটো বিজ্ঞানের এক বড় আবিষ্কার বটে। মহাসৃষ্টির সবকিছু নিয়েই আমার ঔৎসুক্য কমে না। জাম্বুরার গঠন দেখে আমি তাজ্জব হই, আনারের কোষভিত্তিক পাতলা পর্দার বিভাজন আমাকে অবাক করে, ডিমের খোসার নিচের কী পাতলা পর্দা, ভাবা যায়! সব সময়ে খাই এই কলা এমন হলো কেমন করে? কোনটা ফেলে কোনটা বলি? সমুদ্র-মহাসমুদ্রের নিচের প্রাণিজগৎ তো মাথা ঘুরিয়ে দেয়। হালে মহাকাশের যেসব ছবি দেখি, তাতে চোখ ছানাবড়া হয়ে পড়ে। চন্দ্রযান চাঁদে নামল, ছবি দেখছি-মাথা ঘুরে যায়। এসবের কাজ নাকি বিজ্ঞানের সৃষ্টি। এ বিজ্ঞানকে সৃষ্টি করল কে? মানুষ। এ মানুষ সৃষ্টি করল কে? স্রষ্টা-হোক না আল্লাহ, খোদা, ভগবান, ঈশ্বর কিংবা গড, যে নামেই ডাকি। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহ ছয় দিনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন। আর কুরআনে বর্ণিত এ ছয় দিনের এক দিন সমান আমাদের জাগতিক ক্যালেন্ডারের ৫০ হাজার বছর। তার মানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টিতে আল্লাহর আমাদের ৩ লাখ বছর লেগেছে। আল্লাহর সৃষ্টির সংজ্ঞা কী? হও বললেই হয়ে যায়। এমন শক্তিতে অর্থাৎ হও বললেই যখন সৃষ্টি হয়ে যায়, তাহলে সৃষ্টির গতি হিসাবে ৩ লাখ বছরের সৃষ্টির কূলকিনারা পাওয়া যায়? ছোট্ট হিসাবটুকু করলেই তো বোঝা যায়-বিজ্ঞানীরা বলেন যে, এমন অগণিত নক্ষত্র রয়েছে যার আলো এখনো পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়নি। এবার তাহলে দূরত্বটা হিসাব করা যায় কিনা দেখা যাক। আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে এক লাখ ছিয়াশি হাজার মাইল। এক আলোকবর্ষের দূরত্ব সমান ১,৮৬,০০০ মাইল x৬০x৬০x২৪x৩৬৫, ক্যালকুলেটরে ধরবে তো? এবার যদি কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে হয়, তখন তো উপরের যোগফলকে আবার কোটি কোটি দিয়ে গুণ করতে হবে। কিন্তু কত কোটি তা তো বলা হয়নি এখনো। এখনো নাকি মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। চাঁদ, মঙ্গল থেকে এখন নাকি দৃষ্টি সূর্যের দিকেও, হ্যাঁ, বিজ্ঞান পারবে, আল্লাহ সে শক্তির ইঙ্গিত পবিত্র কুরআনে দিয়েছেন। আমি আদার ব্যাপারি জাহাজের খবরে না গিয়ে ছোট্ট-সহজ ছবি বা ফটো, হালের সেলফি নিয়ে সীমিত থাকতে চাই।

আমরা ছোট থাকতে আয়নায় নিজের ছবি দেখে খুশি হতাম। নিজেকে নিজে ভেংচি কাটতাম, চুল আঁচড়ানোর জন্য কত ঢংয়ে যেতাম। কিন্তু কাগজে নিজের ছবি মুদ্রিত করার চিন্তা ছিল না। আমার নিজের প্রথম ছবি তুলি চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হওয়ার সময়ে ১৫.১১.১৯৬৭, সিরাজউদ্দৌলা রোডের লাকি স্টুডিওতে। সে ছবিই আমার জীবনের প্রথম ছবি। প্রথম বিদ্যুৎ বাতি দেখি ১৯৬০ সালে বড় বোনের বিয়ের বাজারের সময়ে ফেনীতে। কী আশ্চর্য এ বিদ্যুৎ, একটা ছোট কাঠি নিচে নামলে বাতি জ্বলে, আরেকটায় পাখা চলে, ওই কাঠিটা (সুইচ) উপরে ওঠালে আবার বন্ধ হয়ে যায়। এই যে বিদ্যুৎ আমার কাছে এক আজব শক্তি মনে হলো, তা এখনো বহাল থাকল। ২৪ ঘণ্টা সময় পৃথিবীতে বিদ্যুৎ বন্ধ থাকলে আমাদের কী হবে, ভাবা যায়? আমি আমার প্রথম ছবি থেকে পরের ছবিগুলো দেখি, ভাবি, অনুধাবনের চেষ্টা করি-ছবি তো ছবি নয়, ছবি যে কথা বলে, কত কথা! মা-বাবা মরে গেলেন, তাদের ছবি দেখি, কী জীবন্ত! সিনেমাতে রাজ্জাক-কবরীকে দেখি, আহা তারাও জীবিত ছিলেন। প্রিয় অন্যতম নায়িকা কবরীর পাশে বসে টিভিতে এক অনুষ্ঠান করার সময়ে সে কী যে অনুভূতি আমার, এ সেই আমাদের কবরী, আর আমি তার পাশে বসে, একই সোফায়, টিভিতে অনুষ্ঠান করেছি! নায়করাজ রাজ্জাকের জানাজায় গেলাম, এ মানুষটি মারা গেল। মেয়র আনিসুল হকের সঙ্গে কথা হলো, বৈঠক হলো, তিনি মরে গেলেন, জানাজায় গেলাম। কত কত জানাজার কথা বলব? থাক, কিন্তু ছবি রয়ে গেল। ছবিগুলো কেবল বলে, একদা আমিও ‘অমুক-তমুক’ ছিলাম গো।

মা মারা গেলেন ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১। বড় ভাই চলে গেলেন ফেনী থেকে বাসে চট্টগ্রাম, আব্বাকে খবর দিতে। আমি ছুটলাম ফেনীর উদ্দেশে-একজন ফটোগ্রাফার আনতে, মায়ের একটা ছবি রাখতে। ৬ মাইল পথের তিন মাইলই হেঁটে গেলাম, বাকিটা রিকশায়। ট্রাঙ্ক রোডের ফটো ক্লাব স্টুডিও’র এক ফটোগ্রাফারকে পাঁচ টাকার বিনিময়ে এবং যাতায়াতের রিজার্ভ রিকশায় বাড়ি এনে মায়ের একটা ছবি নেওয়া হলো, জীবনের বড় সম্বল এ ছবিটা। মায়ের মৃতদেহের মাথার পাশে আমি, ছোট ভাই শাহ আলম, এক ভাগনে ফারুক এবং আমার কোলে ভাইপো নেসার। সে ছবি এখনো দেখি, হ্যাঁ, আমার একজন মা ছিলেন, তিনি ছবিতে এখনো আছেন। ছবিতেই আমার আব্বা আছেন, আরও কত কত জন। এসব ছবি আবেগের, এসব ছবি সম্মানের, স্মৃতির, আনন্দের এবং কখনো কখনো বেদনার। তাহলে আমরা দেখলাম, ফটো বা ছবি আমাদের জীবন্তরূপে যেন রেখে দিয়েছে। এই-ই ছিল ছবি নিয়ে আমাদের মূল্যায়ন, আমাদের অনুভূতি, আমাদের আবেগ। কোনো অনুষ্ঠানে ছবি আমাদের জীবন্ত করে দেয়, আমিও সেখানে ছিলাম। অ্যালবামে কতজন কত কত ছবি রাখে। এখন ক্যামেরা ঘরে ঘরে, মোবাইলে মোবাইলে। বিজ্ঞানের উন্নতিতে এখন কথা হয় ছবি দেখে দেখে জীবন্ত, জীবন্ত শুধু অডিও নয়, ভিডিও। ডিজিটাল দুনিয়ায় এখন ভিডিও-কনফারেন্সে হয়ে যাচ্ছে কত সভা-সেমিনার-উদ্বোধন। অতএব, বিজ্ঞান আর কারিগরি উৎকর্ষ কীভাবে অস্বীকার করি? এক মোবাইলে এসে গেল সারা পৃথিবী। আমি হয়তো বেশ পিছিয়ে, কিন্তু আমার তৃতীয় প্রজন্মের পিচ্চিটাও আমার ভিডিও করে, দেখায়, তাদের নাচগান তো আছেই।

কিন্তু এ ছবি যে এখন ভিন্নমাত্রায় চলে যাচ্ছে, এটা তো এখন আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে পড়ছে, এটা তো এখন প্রাপ্তির এক মহাবিনিয়োগ, এটা তো এখন কাউকে ব্ল্যাকমেইল করার পুঁজি। ভালোবাসার কোনো ছবি কাকে কখন কোন বেকায়দায় ফেলবে তা কে বলতে পারবে? আড্ডা-আলোচনায় কোন ছবি এখন কাকে কোন দলের কেউটে করে ফাঁসিয়ে দেবে কে জানে? ক্ষমতায় থাকলে, চেয়ারে থাকলে একটা ছবিও তো হতে পারে বড় ক্ষমতা, নাকি? নিজের একটা বাস্তব উদাহরণই দেই না কেন। আমি তখন রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বলা চলে ক্ষমতাও নাকি বেশ ছিল আমার, যদিও আমি কখনো তা টের পাইনি। চেয়ারের পেছনের একটা বাঘের ছবি দেখে অনেকে বাঘ বলত, এটা টের পেয়েছি মাত্র। চেয়ারের ক্ষমতা বুঝতে না বুঝতেই তো চাকরিটা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম। গানম্যানও নিলাম না, অতএব, ফুটানিও বুঝলাম না। লাল পাসপোর্ট তো দেখলামই না। আগে যেমন ছিলাম তখনো তো তেমনই চলেছি, তেমনই ছিলাম। তাই বোধকরি ক্ষমতা টের পেলাম না। কিন্তু আমার এক আত্মীয় একদিন আমার সঙ্গে একটা ছবি তুলে নিল। পরে তার কাছে থেকেই জানলাম, ওই ছবি তাকে কত উপকার করেছে। ও চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজে তার এক ব্যবসায়িক কাজে গেল, ক্লিয়ারিং-ফরোয়ার্ডিং এজেন্টের কী কাজ যেন। তার কাছে সাহেবের বড় অঙ্কের দাবি। সে কোনোভাবই কমাতে পারছিল না। সে পরে তার ব্যবসায়িক বুদ্ধি কাজে লাগাল। হালকাভাবে কথায় কথায় জিজ্ঞেস করল, আপনাদের বর্তমান চেয়ারম্যান কে? অফিসার নাম বলতেই সে তার বুক পকেট থেকে তার সঙ্গে আমার ছবি বের করে দেখাল, উনি কিনা। আর যায় কোথায়, তার সে কী কদর, সে আমার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথাও বলল, কেমন আত্মীয়। এবার ওই অফিসার তাকে কত আপ্যায়ন করে, বলেন নাকি-আপনি এটা আগে বলবেন না? বিনে পয়সায় সঙ্গে সঙ্গে তার কাজ হয়ে যায়, আমাকে যেন এসব না বলে তার জন্য আরও কত অনুনয়-বিনয়। এরপর থেকে আমি আর কারও সঙ্গে ছবি তুলিনি, এখনো পারলে দূরে থাকি অবস্থা বুঝে। কিন্তু অনেকে এ ছবির বিষয়ে এত বেশি ক্রেজি থাকে যে, এটাকে তারা অনেক গর্বের মনে করে।

একবার এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার কোনো এক বিষয়ে কথা হয়। তিনি ক্ষমতার পটপরিবর্তনে একটা ছবি হঠাৎ আড়াল করে ফেললেন। আমি দেখে ফেললাম, বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার ছবি, এখন আওয়ামী-আমলে আর তা তিনি বাসায় ঝুলিয়ে রাখতে চান না। হয়তো সময়মতো পরে কাজে লাগাবেন। এখন তো রাজনীতির চেলা-চামুণ্ডা এবং তাদের তস্য-তস্যরা এসব বলেই এবং ছবি দেখিয়েই ব্যবসা করছেন। রাস্তার ফেস্টুন, পোস্টার, ব্যানারে তো বঙ্গবন্ধুর ছবিটা এখন উপলক্ষ্য মাত্র, শেখ হাসিনারটাও, বাকি প্রচার-প্রসার সবই তার। অদূর ভবিষ্যতে, নজরুলের চল চল কবিতা যা আমাদের রণসংগীত, তা যেমন এখন একটি মোবাইল আর্থিক কোম্পানির বিজ্ঞাপনে ব্যবহার হচ্ছে, তেমনি হয়তো ছবিসহ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অংশও অন্য কোনো কোম্পানি তাদের ব্যবসায়িক কাজে বিজ্ঞাপন হিসাবে চালু করে দিতে পারে। এসব দেখার কে আছে? মনমানসিকতা উঠেই গেল। ড. ইউনূসের একটা ভালো গুণ আছে, তিনি ছবি তুলতে দিতে কার্পণ্য করেন না। আমি কিন্তু যথেষ্ট সুযোগ পেয়েও তার সঙ্গে একটা ছবিও তুললাম না। এমনকি হোস্টের অনুরোধেও তার টেবিলে খেতেও বসলাম না। হতে পারে এ আমার অক্ষমতা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সাবেক গভর্নর ড. ইউনূসকে দাওয়াত দিয়ে মাত্র জনাচারেক অতিথির মধ্যে আমাকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, ছবিটবি উঠানো হতে পারে বিবেচনায় আমি ওই দাওয়াতেও যাইনি। কিন্তু তারপরও একটা প্রতিষ্ঠান আমাকে দিয়ে উদ্বোধন করাতে চাইলে আমি প্রতিবেশী হিসাবে ড. ইউনূসকে দিয়ে উদ্বোধন করানোর সম্মান দেখিয়েছিলাম। এটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।

সেলফি যে এখন রাজনৈতিক হাতিয়ারও হবে, তা আমরা আগে অল্পস্বল্প টের পেলেও এবার আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ হাসিনা এবং তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের সেলফিতে বেশ টের পাচ্ছি। এ সেলফি নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তো হুংকার ছাড়লেন-এক সেলফিতেই বিএনপির অবস্থা খারাপ। আবার মির্জা ফখরুল, বিএনপির মহাসচিব বললেন, সেলফিতে রক্ষা হবে না। দুদলের সে কী কাণ্ড! আমার হাসি পায়, এরা নাকি আমাদের বড় নেতা। আওয়ামী লীগ বোঝাতে চায় যে, বাইডেন অর্থাৎ আমেরিকা আওয়ামী লীগের ওপর খুশি না হলে কি এমন সেলফি তুলতেন? জানি না, বাইডেন সাহেব আর কার কার সঙ্গে সেলফি তুলেছেন, তার নাকি সেলফি-বাতিক আছে। অথচ আওয়ামী লীগ দাবি করে, তারা আমেরিকাকে ভয় পায় না। তাই যদি হবে, একটা সেলফি নিয়ে, বড় কারও একটা অটোগ্রাফ পেলে ছোট ছাত্র যেমন খুশিতে লাফায়, আওয়ামী লীগ কেন এটা নিয়ে এত বাকবাকুম হবে? এটা কি রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা? যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক শেখ হাসিনার সঙ্গে যে সৌজন্যে বসেছেন, এটা নেহায়েত বড় সম্মান-প্রদর্শন। এটা নিয়েও বোধকরি কেউ কেউ লাফাচ্ছেন। এবার বাংলাদেশে ফরাসি প্রেসিডেন্টও এলেন, ছবি তো উঠল, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীও এলেন, এখানেও ছবি উঠল, এগুলো স্বাভাবিক। ভৌগোলিক গুরুত্বে বাংলাদেশ গুরুত্ব পাবেই, জি-২০তেও তার প্রমাণ মেলে। কিন্তু তাই বলে সেলফি নিয়ে রাজনীতি হবে কেন? আমাদের রাজনীতিকরা আর কত নিচে নামবেন? হ্যাঁ, একটা ছবি না হয় বাঁধিয়ে রেখে দিলে তৃতীয়-চতুর্থ প্রজন্ম বুঝবে তার পূর্ব প্রজন্ম কী ছিল।

বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews