ছবির উৎস, Getty Images
২ ঘন্টা আগে
করোনাভাইরাস এবং ডেঙ্গু, বাংলাদেশে এখন এই দুই রোগেরই প্রকোপ বাড়তে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে, ডেঙ্গু আক্রান্তের হার ক্রমশ বেড়েই চলেছে বলে জানাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য।
এমনকি ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। তবে ডেঙ্গুর তুলনায় করোনা সংক্রমণের হার এখনও কিছুটা কম।
বাংলাদেশে বর্ষা এলে প্রতি বছরই ডেঙ্গু সংক্রমণের হার বেড়ে যায়। কিন্তু চলতি বছর একই সময়ে করোনা সংক্রমণের ঘটনা ঘটায় বিষয়টি উদ্বেগের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কারণ, বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতে করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পর থেকে মানুষ করোনা পরীক্ষা করাতে তৎপর হয়ে উঠেছে।
কিন্তু দেশের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে করোনা পরীক্ষার কিট ও টিকার সংকটের কথা শোনা যাচ্ছে।
এছাড়া, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, প্লাটিলেট কিট, জনবল ও স্থান সংকটের কারণে হাসপাতালগুলো ডেঙ্গুর চিকিৎসা সেবা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানাচ্ছে, এই দুই সংকট মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার ।
ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
হাসপাতালের বেডে জায়গা না হওয়ায় মেঝেতে রোগী (ফাইল ফটো)
এই সময়ের মাঝে ঢাকা ও চট্টগ্রামে করোনায় মারা গেছেন দুই জন। তারা প্রত্যেকেই নারী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. আবু জাফর গত ১১ই জুন এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত দেশে করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন ১৫৮ জন।
আর জুন মাসের প্রথম ১০ দিনে শনাক্ত হয়েছেন ৫৪ জন।
এছাড়া, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু সংক্রান্ত নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শুক্রবারের তথ্য অনুযায়ী, তার আগের ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে মোট ১৫৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
আক্রান্তদের মাঝে বেশিরভাগ-ই পুরুষ। বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সীরা।
এই সময়ের মাঝে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন পাঁচজন, তাদের তিনজনই নারী।
চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে ১৩ই জুন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ২৮ জন।
তবে, এই গত প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু, দু'দিক থেকেই শীর্ষে পুরুষরা।
এদিকে, ডেঙ্গু সংক্রমণে সবচেয়ে শীর্ষে আছে বরিশাল বিভাগ। মৃত্যুতে আবার ঢাকা।
এ পর্যন্ত যারা ডেঙ্গুতে মারা গেছেন, তাদের অর্ধেকই ঢাকার মহানগরের দক্ষিণাঞ্চলের।
এছাড়া, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে চলতি মাসে। গত মে মাসে মোট এক হাজার ৭৭৩ জন আক্রান্ত হয়েছিলো।
কিন্তু জুন মাসের প্রথম ১৩ দিনে দেশব্যাপী এক হাজার ২২৫ জন ইতোমধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মৃত্যু হারও এখন পর্যন্ত চলতি মাসেই বেশি।
কারণ এ মাসে ইতোমধ্যে পাঁচজন ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। অথচ পুরো জানুয়ারিতে মারা গিয়েছিলো ১০ জন।
এ বছর ডেঙ্গু সংক্রমণের হার বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলায় সর্বোচ্চ।
শুক্রবার পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ওই জেলায় ৬৭ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত পহেলা জানুয়ারি থেকে শুক্রবার অবধি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর এক হাজার ৫৫২ এবং মৃতের সংখ্যা ছয় জন।
বরগুনা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোঃ রেজায়ানুর আলম বিবিসিকে জানিয়েছেন, তারা "সক্ষমতার বাইরে গিয়ে রোগীর চাপ সামলাতে প্রাণপণ চেষ্টা" করছেন।
তিনি বলেন, হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বরাদ্দ বেডের সংখ্যা কেবল ৫০টি হলেও এই মুহূর্তে সেখানে মোট পাঁচ শতাশিক ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন।
"এমার্জেন্সিতে অনেকেই আসছেন, ডেঙ্গু পজেটিভ পাচ্ছি। যে বাসায় একজন সদস্য ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, ওই বাসায় প্রায় প্রত্যেক সদস্যরই ডেঙ্গু," বলেন তিনি।
হাসপাতালে যারা আসছেন, তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে 'বাড়ি পাঠানো হচ্ছে' জানিয়ে তিনি বলেন, "সক্ষমতা তো থাকতে হবে। হাসপাতালের কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নাই।"
তাই, যারা তুলনামূলক একটু সুস্থ, তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে না।
"এরকম একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডেঙ্গুর এত প্রকোপ কল্পনাও করা যায় না," বলেন এই চিকিৎসক।
তবে, জেলায় এত বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসেবে বরগুনায় ব্যাপক জলাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
"এ জেলার চারপাশে নদী। কিন্তু ফ্লোয়িং ওয়াটারে তো লার্ভা থাকে না। কিন্তু এখানে জলাবদ্ধতাও প্রচুর। বাড়ির আঙ্গিনা থেকে শুরু করে সব জায়গায় ময়লা আবর্জনা, পানি জমা থাকে," বলেন তিনি।
তিনি বলছেন, "সময়মতো সঠিকভাবে মশার ওষুধ ছিটানো হলে এবং পৌর শহরটা যদি আরও পরিচ্ছন্ন থাকতো, তাহলে পরিস্থিতি এই পর্যায়ে যেত না।"
ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
সম্প্রতি বাংলাদেশে আবার করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে দেখা গেছে (ফাইল ফটো)
আর যেসব মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে, তার কার্যকারিতা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি জানান, বরগুনার সবাই এখন ডেঙ্গু নিয়ে ব্যস্ত। এর মাঝে যদি করোনার প্রকোপ বাড়ে, তাহলে হিমশিম খেতে হবে।
"আমরা করোনার টেস্ট করাতে পারছি না, কারণ এখানে কিট এখনও আসে নাই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী শুধু সচেতনতা বৃদ্ধি করে যাচ্ছি," বলেন তিনি।
এদিকে, বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল ডেঙ্গুর বিষয়ে বিবিসিকে জানান, "গতবার থেকেই ওখানে ডেঙ্গু রোগী বেশি, এবার আরও বেশি।"
কারণ হিসাবে তিনি জানান, ওই এলাকায় থেকে নমুনা নিয়ে দেখা গেছে যে সেখানে এডিস মশা আছে। ওই মশা যখন কোনও সুস্থ মানুষকে কামড়াচ্ছে, তখন সেও আক্রান্ত হচ্ছে।
"জুন মাসে আমাদের কেনাকাটা শেষ হয়ে যায়" জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এবার তার আগেই সংক্রমণ বাড়ায় "আমরা এতটা প্রস্তুত ছিলাম না।"
কিন্তু তারপরও বিভিন্ন জায়গা থেকে সমন্বয় করে রোগীদের সেবা দেয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান। পাশাপাশি, স্বাস্থ্য শিক্ষাও দেওয়া হচ্ছে।
করোনার ব্যাপারে তিনি বলেন, "কাল-পরশুর মাঝে আমরা আমাদের কিটগুলো পেয়ে যাবো। আমরা আমাদের বেডগুলো রেডি করে ফেলতেছি।"
"অক্সিজেন রেডি আছে। আর আমাদের ডাক্তাররা তো আগে থেকেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।"
ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
বরগুনা ডেঙ্গুর হটস্পট হয়ে উঠেছে (ফাইল ছবি)
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক মো. ফরহাদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, করোনার কিট ও টিকার ব্যবস্থা ছিল।
তবে ইতোমধ্যে "এগুলো অ্যারেঞ্জ করা হয়েছে, বাইরে থেকে এগুলো আরও বেশি করে আনার বা কেনার ব্যবস্থা চলছে।"
হাসপাতালগুলো করোনা পরস্থিতি সামলাতে প্রস্তুত উল্লেখ করে তিনি বলেন, "মাঝখানে দুই বছর করোনা না থাকাতে আমাদের কার্যক্রম কিছুটা স্তিমিত ছিল। এখন পূর্ণ দমে চালু হচ্ছে।"
টিকার ব্যাপারে গত ১১ই জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মােঃ আবু জাফর বলেছেন, ১৭ লাখ করোনা টিকা বিভিন্ন টিকাকেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে আগেই।
এছাড়া, বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে খুব শীঘ্রই করোনা শনাক্তকরণ কিট পৌঁছানো হবে।
জনস্বাস্থ্য ও মহামারী বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন মনে করেন, ২০২০ সালে যখন দেশব্যাপী ব্যাপক হারে করোনা সংক্রমণ শুরু হলো, তখন যারা কাজ করেছেন, এখনও তারাই আছেন।
অল্প কিছু মানুষ হয়তো অবসরে চলে গেছেন। কিন্তু নতুনদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে নিয়মিত। তাই করোনা সামলাতে চিকিৎসকদের কোনও সমস্যা হওয়ার কথা না।
ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
২০২০ সালে করোনা মহামারী দেখা দিয়েছিলো বাংলাদেশে (ফাইল ছবি)
তার মতে, বাংলাদেশকে যেহেতু প্রতিবছরই ডেঙ্গু সংক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়, তাই এক্ষেত্রেও এ দেশের চিকিৎসকরা অভ্যস্ত।
"সমস্যা হলো, আমাদের জনস্বাস্থ্যকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। কিন্তু আমাদের সবশেষ সেবাটা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কেন্দ্রিক।"
বিগত সরকারের সময়ে এই সমস্যাগুলো সংশোধন করা হয়নি। আর অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন এগুলো সুপারিশ করলেও তা এখনও বাস্তবায়ন করা শুরু হয়নি, বলে জানান তিনি।
"কোভিড রোগী কিছু বাড়লেও এটা মারাত্মক হবে না বলে আমার ধারণা। কারণ অক্সিজেনের সাপ্লাই, ডায়াগনোসিস, টেস্ট, সবই পুনরায় চালু করা যাবে। এখানে অসুবিধা দেখছি না। কিন্তু আগের ধারাতেই সব হলে ডেঙ্গু সামলানো সম্ভব হবে না" বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি মনে করে, যে জনবল ও সম্পদ এখন আছে, তা দিয়ে চাইলে এখনই স্তরভিত্তিক চিকিৎসা সেবা দেওয়া যায়।
"যেমন, ডেঙ্গুতে প্রত্যেকটা ওয়ার্ডে বা ভ্রাম্যমান স্যাম্পল কালেকশনের ব্যবস্থা করা দরকার। কোভিডেও তাই। আমাদের জনবল দিয়েই করা যায় এগুলো। সিটি কর্পোরেশন হাসপাতাল, রেলওয়ে হাসপাতাল এগুলো সেকেন্ডারি হাসপাতাল হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।"