বাদশাহ আলমগীরের বদনা আর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেতৃবৃন্দের বদন: ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দকে প্রত্যাখ্যান করার সময় এখন

ঠিক কী কারণে আমাদের শৈশবে বাদশাহ আলমগীরের ওই বদনা কাহিনি পড়ানো হতো তা আমি অত নিশ্চিত হতে পারিনি এত বছরেও। আদতে এটা ছিল একটা কবিতা, শিক্ষাগুরুর মর্যাদা, কাজী কাদের নেওয়াজ বিরচিত। এমনকি এটাও হতে পারে যে, আমি যে-পাঠ্যসূচিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করি তাতে ওটা সংযোজিত ছিল না। বড় কোনো পার্থক্য তাতে হয়নি, আমাদের ঠিক পরের বছরেই তা সংযোজিত হয়েছিল। ওই কবিতাটির মূল প্রতিপাদ্য ছিল এই যে, বাদশাহ আলমগীর কিংবা ইতিহাসবিদগণ যাকে আওরঙ্গজেব বলে থাকেন, তাঁর পুত্র নিজের শিক্ষাগুরুর পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন। এই দৃশ্য বাদশাহ স্বচক্ষে দেখার পর শিক্ষক প্রথমে নার্ভাস, পরে আত্মগরবে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। বাস্তবে বাদশাহ আসলেই শিক্ষককে তলব করেন (এবং শিক্ষক আবার নার্ভাস হন) এবং পরিশেষে বাদশাহ রায় দেন যে, যদি বাদশাহ-পুত্র ভালো কিছু শিখে থাকতেনই, তাহলে শুধু পানি ঢেলে দিলেই চলবে না, শিক্ষকের পায়ে হাত দিয়ে (ডলে ডলে) পা ধুইয়ে দিতে হবে।

এখন, যদি জীবনে কখনও দরকার পড়ে, সুযোগ আসে, এবং গুলি খেয়ে বেঘোরে মারা না যাই, এই পদ্যটা নিয়ে, বিশেষে এর দৃশ্যকল্প ও সম্পর্কের স্তরবিন্যাস নিয়ে কষে কখনও একটা রচনা করতে সাধ করি। কাজী কাদের নেওয়াজ নিরীহ একজন মানুষ, শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা কিছু একটা হবেন, আমার মাথাব্যথা নাই; কিন্তু শিশুমানসে প্যাঁচ লাগানোর কারণে কঠোর সমালোচনা তাদের পাওনা। আজকে সে বিষয়ে আমার আগ্রহ নাই। আজকে শুরু করেছিলাম এই জন্য যে এই কবিতাটার এত গুরুত্ব তৈরি হয়েছিল তার সম্ভাব্য পরিধি বলতে গিয়ে। এখানে বদনা বিষয়ে একটা কথা না বলে নিলেই নয়। কবি কাদের কোথাও বদনার কথা উল্লেখ করেন নাই, করেছেন ‘পাত্র’। রাজা-বাদশাহর বাড়িতে আর যাই থাকুক না কেন, বদনা থাকে তা ভাবতেও অশান্তি হয় বৈকি। আবার বদনার প্রধান উপযোগ পা-ধোয়ানি নয় তা আপনারা জানেন। বস্তুত, প্রধানতম যে উপযোগ বদনার তা ব্যতিরেকেই বা রাজা-বাদশাহরা চলতেন কীভাবে! ফলে আন্দাজ করা যায়, আরএফএলের প্লাস্টিক বদনা না হলেও, স্বর্ণনির্মিত হলেও, তার নাম ‘বদনা’ না হলেও, বাদশাহ আলমগীরের বাসায় (আই মিন প্রাসাদে) ‘বদনাসদৃশ’ কোনো পাত্রের উদরস্থল হতে উদ্ভূত নালিসমেত কোনো এক বা একাধিক পাত্র বলবৎ ছিল। আর সেটাই ছোট শহরের কল্পনাতে বদনায় পর্যবসিত হয়েছে। আপাতত, এতে কাজ চলবে। কিন্তু তাতেও মূল প্রশ্ন মীমাংসিত হয়নি। কেন এই অত্যাগ্রহ এই কবিতার চিত্ররূপ নিয়ে? কীভাবে এই কিসসাটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এত শক্তিশালী হয়ে বিরাজিছে?

আমাদের বহু পিতামাতাই চাইতেন যে আমরা শিক্ষকের প্রতি ভক্তির যে মডেলটি গ্রহণ করব তা যেন বাদশাহ আলমগীরের (আসলে তাঁর পুত্রের) আদলেই তৈরি হয়। এখানে ‘আমাদের’ খুব শিথিল শোনালো, এবং আমি তা কখনোই বরদাশত করি না। গড়ে মফস্বলের সরকারি প্রাথমিক-মাধ্যমিকে পড়ুয়াদের মা-বাবাকে এখন ‘আমাদের’ পিতামাতা হিসাবে দেখা চলবে। ফলে এই কবিতা তথা কিসসাটির একটা অন্যতম প্রাণশক্তি হলো ‘শিক্ষাগুরুর প্রতি বাচ্চাকাচ্চাদের প্রদর্শিত/অরিজিনাল ভক্তির প্রত্যাশিত মধ্যবিত্ত মডেল’। কিন্তু এখানেই মামলা ফিনিস হচ্ছে না। বাস্তবে গরিব বা আধাগরিব সেসব শিক্ষকও প্রাণপণে শিক্ষাগুরুর প্রতি ভক্তির এই মডেলটাই সমুন্নত রেখে চলে আসছিলেন। বাস্তবে, অন্তত এখন মাস্টারির চাকরিটাই করি বলে, আমি বুঝতে পারি নানান বর্গের (ও নানান বেতনের) নানান শিক্ষকই শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীদের ভক্তিশ্রদ্ধার এই মডেলটাই মাথায় এত তীব্রভাবে বহন করেন যে মা-বাবাগণ যদি এই কিসসা জীবিত নাও রাখেন আর, শিক্ষকেরাই রেখে দেবেন।

কিন্তু হায়! সেই চরণও নাই আর সেই চরণধুলাও নাই! চরণ এখন জুতাময়। জুতা এখন গোময়। শিক্ষকের জুতা, যদি সঠিক জায়গায় আছে ধরেও নিই, তোষামোদের হাঁটাহাঁটিতে ক্ষয়িষ্ণু।

সারাদেশে পুলিশ ও সরকারি বাহিনির হত্যা ও নৃশংসতা যখন দেশবাসীকে হতভম্ব করেছে, কাঁদিয়ে ছেড়েছে, যখন হাসপাতাল আর থানা দৌড়ে সন্তানসন্ততির খোঁজ নিচ্ছেন মা-বাবা, যখন তাক করে বুকে গুলি করছে পুলিশ, আর মামলা সাজাচ্ছে ফ্যান্টাসি সিনেমার প্লটের মতো করে, যখন রাস্তার পথচারী, জানালার শিশু, ছাদের শিশু, কৌতূহলী কিশোর, খেটে খাওয়া শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হচ্ছেন পুলিশ বাহিনীর গুলিতে, যখন প্রথমবারের মতো কোনো দেশে সিভিলিয়ানদের উপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হলো, যখন বোকার ব্ল্যাকআউট ডিঙায়েও আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশের স্বৈরতান্ত্রিক ক্র্যাকডাউনের চেহারা দেখতে পাচ্ছে, আর একটার পর একটা টিভিতে সরকারি গায়েন গাদাগাদা বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মী ‘জামায়াত-শিবির/বিএনপি’ স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করে পাঠ করে চলেছেন, ঠিক তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ, আলতো পায়ে, হয়তো জুতা-পায়েই, ২৪ জুলাই, দেখা করতে গেছেন এক কবির সাথে, শিক্ষা উপদেষ্টা।

ঘটনার এত উত্তুঙ্গতার মধ্যে অনেকেই সেই আলতো-পায়ে দেখা করতে যাওয়াটি লক্ষ্য না-করে থাকতে পারেন। কিন্তু আমার চোখের গুণ হবে, লক্ষ্য করেছি। কিন্তু কেন? কেন তারা দেখা করতে গেছেন? কেন তারা এই শিক্ষা উপদেষ্টার সাথেই দেখা করতে গেছেন? হয়তো এই হত্যাযজ্ঞের নিন্দা জানাতে! কিন্তু, এই নেতৃবৃন্দকে এত হাড়ে হাড়ে আমি চিনি যে তা আশাও করিনি। তবে ভেবেছি যদি ম্যাজিকের মতোও এটা ঘটে। হয়তো আগামী প্রজন্মের অসীম ঘৃণার হাত থেকে আমাদের শিক্ষকতার পেশাজীবীরা কিছুটা পরিত্রাণ পাব! কিন্তু সেটা নিজের অশান্তি দূর করার একটা উপায় ছিল মাত্র। এই শিক্ষা উপদেষ্টার পদপ্রান্তে (মতান্তরে, করকমলে) অনেক কবি-সাহিত্যিক থেকে থাকেন বলে লোকজন বলে থাকেন। সেসব কথা ঈর্ষাবশত বলেও আমি মনে করি। যদিও ঈর্ষাটা পদপ্রান্তীয়/করকমলিত কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি নাকি এই কবিবরের প্রতি, তা নিয়ে দ্বিধাহীন হওয়া সহজ কাজ নয়। শিক্ষকেরাও যে তাঁর আশপাশে আসতে চান নাই অতীতে তা নয়। তাই বলে ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ? এই সময়ে? এবং সেটাও কোনো নিন্দা প্রস্তাব সরকারের কাছে পৌঁছানোর জন্য নয়, নিছকই ‘ভাতাদি’ নিয়ে তদবিরের জন্য?

হায়! হায় বাদশাহ আলমগীর! হায় কবি কাজী কাদের নেওয়াজ! আপনারা কি জান্নাত থেকে পরিলক্ষণ করছেন যে কাদের জন্য বদনা রেডি করতে বলে গেছিলেন?! আপনাদের এই জান্নাতজীবন কি এই শিক্ষকদের দেখে হাহাকারময় হয়ে উঠছে না?

পরে জেনেছি, ২৯ এপ্রিল শিক্ষামন্ত্রীর সাথে ফেডারেশনের বৈঠক। আরও পরে জেনেছি সেই বৈঠক হয়ে গেছে। এবং যেমনটা আপনারা পুনঃপুনঃ ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দের কাছে শুনে এসেছেন, এবারও তারা বার্তা দিয়েছেন যে ‘বৈঠক ফলপ্রসূ’ হয়েছে। এমনিতেই ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দের ফলপ্রসূতা সম্বন্ধে কমবেশি বোঝাবুঝি আমাদের কারও কারও ২০১৫তেই হয়ে গেছিল। পেট-ভরে আমরা আমাদের লিডারদের চিনে নিয়েছিলাম। এখন নৈর্বাচনী গণতন্ত্রে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন নিয়েও কথা-কওয়া মুশকিল। আর সেসব সমিতির ফেডারেশনের নেতাদের নিয়েও ওজর-আপত্তি তোলা আরও মুশকিল। ভোট দিয়েও যে আখাম্বা লিডার বসানো সম্ভব, ভোট দিয়েই যে লোকে আখাম্বা লিডার বানিয়ে থাকেন, সেসব নতুন করে বলার কিছু নেই। আমাদের সেই নেতৃবৃন্দ তখন সচিবদের সাথে মর্যাদার একটা সরল অঙ্ক কষতে গেছিলেন। তাদের সেই ঐতিহাসিক মহাবিপর্যয়মূলক ভ্যাবদা আচরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কয়েক দশক পিছিয়ে গেছেন। এবারের লিডারেরা কবিদর্শনকেই হয়তো একটা ‘ফল’ হিসাবে ভাবতে পেরেছিলেন। তারপর মন্ত্রীর সাথে বৈঠক! কী বিরাট সাফল্য!

এইসব অসংবেদনশীল, কোমরহীন, বাস্তবতার কোনো রকম পাঠবর্জিত নেতৃবৃন্দ শিক্ষার্থীদের তো দূরের কথা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিয়েও ন্যূনতম মমতা বোধ করেন না। যদি করতেন, তাহলে আপনারা শুনতে পেতেন তারা ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়গুলোকে চাপ দিচ্ছেন যাতে অকথ্য বেতন কাঠামোর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের দিকে লক্ষ্য রাখা হয়, যাতে তাদের বাধ্যতামূলক বেতনকাঠামো থাকে; তাদের বলতে শুনতেন বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সরকারি বিদ্যালয়ের সরকারি বেতন কাঠামোর অকহতব্য নিম্নমান নিয়ে; তাদেরকে দাবি তুলতে শুনতেন বেসরকারি, বিশেষত নন-এমপিও স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের দুর্বিষহ জীবনযাপন অবসানের কথা; তাদেরকে বলতে শুনতেন একটা অভিলক্ষ্যহীন ও বৈষম্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা জিইয়ে রাখা সরকারের ব্যর্থতা, এমনকি শাসন কৌশল। আপনারা শোনেননি। আর শিক্ষার্থীদের জীবন ও যাপন! সম্ভবত, তারা পরোয়াও করেন না।

আজ যখন এতগুলো লাশ পেছনে ফেলে যে নেতৃবৃন্দ সেসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে শক্ত নিন্দা করা ছাড়া আর একটাও কোনো পদক্ষেপ নেবার কথা ভাবতে পারেন না, তারা আমার নেতা নন। আমি স্পষ্টভাবে এই নেতৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করি। আর আমি জানি, ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে এই অনুভূতি নিয়ে অগণিত শিক্ষক বসে আছেন। তারা উচ্চারণ করুন আর না করুন। তারা সংখ্যায় অনুগতদের থেকে বেশি হোন আর না হোন।

কে না জানে আনুগত্য বড় পিচ্ছিল বিষয়! দৃঢ়তা তা নয়!

মানস চৌধুরী: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews