আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যরা নিজেদের কর্ম ও ভাবনার মাধ্যমে মাঝেমধ্যে নয়, বছরের পর বছর ধরে পত্রপত্রিকার শিরোনাম হয়ে চলেছেন। মনে পড়ে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৯ সালে ক্ষমতার হাতবদলের অব্যবহিত পরবর্তী সময়ের কথা।

এমনই এক পরিস্থিতিতে সৈয়দ আবুল মকসুদ (সম্পতি প্রয়াত, তার বিদেহী আত্মা শান্তি পাক) উপাচার্যদের নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে নিবন্ধ লেখেন আজ থেকে অন্তত পাঁচ-সাত বছর আগে। সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখা এমনিতেই বেশ সুখপাঠ্য ও তথ্যসমৃদ্ধ, তার ওপর বিষয়বস্তুটি আমাকে খুব তাড়া করায় লেখাটি নিমেষে পড়ে ফেলি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়কার ছাত্র ছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদের এক জ্যেঠা। প্রিয় জ্যেঠার মুখ থেকে শোনা কিছু ঘটনা ও বিষয়ের আলোচনা করেন তিনি তার লেখাটিতে। আলোচনায় আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন খ্যাতনামা উপাচার্যের নাম। তাদের একজন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (১৮৬৪-১৯২৪) আর অন্যজনের নামটি আমি মনে রাখতে পারিনি (হতে পারেন তিনি দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী (১৮৬২-১৯৩৫)। দুজন উপাচার্যের মধ্যে স্বাস্থ্য-চেহারা, পোশাক-পরিচ্ছদ, আহার-বিশ্রাম, অভ্যাস-রুচি, মিল-অমিল অনেক কিছুই উল্লেখ করেছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ তার বর্ণনায়।

খুবই সংক্ষেপে সাবেক দুজন উপাচার্যকে নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে মিলের চেয়ে অমিলটাই বেশি চলে আসে। যেমন উভয়ের খাবার-দাবার ও স্বাস্থ্য-চেহারা। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের যেমন সুঠাম দেহ, ঠিক তেমনই তার খাদ্যাভ্যাস। ‘আশুতোষ মার্কা গোঁফ’ নিয়ে আরও নানা গল্প প্রচলিত আছে। খেতে পারতেন প্রচুর। সকালের খাবারের তালিকায় পরোটা, পাঁঠার মাংস, দুটো ডিমের ওমলেট, সবজি ও ডিম।

দুপুরে বাসমতি চালের ভাত, খাসির মাংস, মুরগির দুটো রোস্ট, পদ্মার ইলিশের গাদা-পেটির দুটো চাক ও রুইয়ের অন্তত ৫০০ গ্রাম ওজনের বড় দুটো পেটি এবং মসুরের ডাল। এর পর আবার দুধ। রাতের খাবারের তালিকাতেও দুপুরের মতোই চিকন চালের ভাত, মাংস, কৈ মাছ। ভাতের পরে আবার ফলফলারি। মোটামুটি এই ছিল আশুতোষ মূখোপাধ্যায়ের দৈনন্দিন খাবার।

অন্যদিকে অপর উপাচার্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখেন, শরীরের গড়ন খুবই পাতলা। বেশভূষার মধ্যে অদলবদল করে দুটো খদ্দরের ফতুয়া ও ধূতি। দুটো আটার রুটি সবজি ও পাতলা ডাল দিয়ে প্রতিদিন সকালের খাবার সারতেন, সঙ্গে এককাপ লিকার চা। দুপুরবেলা মাপা দুই কাপ ভাত, সঙ্গে ছোট মাছের চচ্চরি ও ঝোল। সবজি আর ডালও থাকত তালিকায়। আর রাতে সকালের চেয়ে সামান্য কম- দেড়টা রুটি, সবজি ও সামান্য মিষ্টি- ব্যস।

চেহারা ও খাদ্যাভ্যাসে এমন পার্থক্য থাকলে কী হবে, এ দুই উপাচার্যের মধ্যে একটি বিষয়ে ছিল অবিশ্বাস্য রকমের মিল। তারা দুজন কেবল মেধাবী হিসাবে পরিচিত নন, উভয়েই ছিলেন পড়ুয়া। তাদের বাসায় ছিল দেশি-বিদেশি বিভিন্ন লেখকের বিশাল গ্রন্থরাজির সমাহার। সারি সারি আলমারি ভর্তি বই আর বই। আশুতোষ ৪ মেয়াদ (১৯০৬-১৯১৪) আর দেবপ্রসাদ দুই মেয়াদ (১৯১৪-১৯১৮) দায়িত্ব পালন করেন।

দুজন উপাচার্যই মেয়াদ পূরণ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা ছাড়ার সময় তাদের আসবাবপত্র যেমনই হোক, বইভর্তি একের পর এক ট্রাক যাওয়ার দৃশ্যটি হাজারো শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী বেশ বিস্ময়ভরে অবলোকন ও উপভোগ করে বলে লেখক উল্লেখ করেছেন।

মহাজনদের উক্তি-উপলব্ধি যে, জ্ঞানের অভাব থাকলে তা আর কোনোকিছু দিয়ে পূরণ করা যায় না। আর জ্ঞানের অভাবের সঙ্গে লোভ-লালসা, কর্তৃত্বপরায়ণতা ও ক্ষমতার দম্ভ যুক্ত হলে তো কথাই নেই। পদের লোভ, পদে নিরাপদে টিকে থাকার বাসনা, পদোন্নতির লোভ- মূলত এসব কারণেই একেকজন উপাচার্য আজকাল একের পর এক বিতর্ক ও সমালোচনার জন্ম দিয়ে চলেছেন। অথচ জ্ঞান-গরিমায় ঋদ্ধ, সৎ ও দক্ষ দায়িত্ববান যে কোনো ব্যক্তিকে সমাজের সচেতন মহল, এমনকি রাজনীতিকরাও সবসময় সমীহ করে চলেন।

অবশ্য নষ্ট আর ভ্রষ্টদের কথা আলাদা। উপাচার্যদের পাঠাভ্যাস কিংবা জ্ঞান-গরিমা কীভাবে বোঝা যাবে? সাধারণভাবে তা বোঝাটা খুবই সহজ। নিজেকে একদম লুকিয়ে বা গুটিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই- লেখা, বক্তৃতা ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই তা প্রকাশ পায়। একজন মা প্রায় নিরক্ষর হলেও সন্তানের হাতের লেখাটি ভালো নাকি মন্দ তা বুঝতে পারেন। যেমন সঙ্গীত বিষয়ে অজ্ঞ হয়েও শিল্পীর গাওয়া গানের কোথায় তাল বা লয় কাটা গেঝে বোঝা যায়।

‘জ্ঞানই শক্তি’- এই আপ্তবাক্যের বদলে যখন থেকে এমনসব ব্যক্তির মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, তোষামোদি ও চাটুকারিতা করে সহজে বিখ্যাত হওয়া এবং ভাগ্যের উন্নয়ন করা যায়, তখন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখা দিয়েছে রাহুর দশা। এর নেতিবাচক প্রভাব ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে কেবল শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, সমাজের সর্বত্র।

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews