'ঘুরি যদি তাকাস, তাইলে গুলি মাইরব'- ভারতীয় নাগরিককে 'পুশ' করার আগে 'বিএসএফ'

ছবির উৎস, Prabir Kundu

ছবির ক্যাপশান,

"ঘুরি যদি তাকাস, তাইলে গুলি মাইরব" - বলছিলেন মিনারুল শেখ

৩ ঘন্টা আগে

"ঘুরি যদি তাকাস, তাইলে গুলি মাইরব" - পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলীয় কোচবিহার জেলার মাথাভাঙ্গায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের দফতরের সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন মিনারুল শেখ।

তার দাবি, তাকে এবং তার সঙ্গে আরও কয়েকজনকে কাঁটাতারের বেড়া পার করে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়ার আগে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের সদস্যরা এই কথাগুলো বলেছিলেন।

এর পরে মিনারুল শেখ, নাজিমুদ্দিন মণ্ডলসহ এরকমই কয়েকজনকে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের 'নো ম্যানস ল্যান্ডে'।

যাদের সেদিন বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্তত চারজন যে ভারতেরই নাগরিক, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ এবং মাত্র একদিনের মধ্যেই বিএসএফ ওই চারজনকে ফিরিয়ে এনেছে।

কোচবিহার জেলার পুলিশ এই কয়েকজনকে সোমবার হাজির করেছিল স্থানীয় টিভি সাংবাদিকদের সামনে।

ভারত থেকে বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে সম্প্রতি যে পুশ-ব্যাক করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে অনেকেই যে ভারতের নাগরিক, এমনটা অভিযোগ করে আসছিলেন মানবাধিকার কর্মীরা।

এর আগে আসাম থেকে একই ভাবে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া অনেক মানুষকে ফিরিয়ে এনেছে সরকার।যদিও তাদের এক সময়ে ওই রাজ্যের 'বিদেশি ট্রাইব্যুনাল'গুলো বিদেশি বলে ঘোষণা করেছে তবে তাদের অনেকেই ওই 'ঘোষণার বিরুদ্ধে' উচ্চতর আদালতে আপিল মামলা করেছেন।

যে ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল  বিএসএফ, তাদেরই তিনজন কোচবিহারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের সঙ্গে

ছবির উৎস, Rakibul Islam

ছবির ক্যাপশান,

যে ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল বিএসএফ, তাদেরই তিনজন কোচবিহারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের সঙ্গে

মুম্বাই থেকে আটক

পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ যাদের বিএসএফের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে এনেছে, তাদের মধ্যেই একজন মেহবুব শেখ।

মুর্শিদাবাদ জেলার পুলিশ নিশ্চিত করেছে যে মি. শেখের বাড়ি ভগবানগোলা থানা এলাকায়।

সোমবার গভীর রাত পর্যন্ত মি. শেখের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় নি, কারণ তার কাছে নিজের ফোন নেই।

তার ছোট ভাই মুজিবর শেখ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন যে কীভাবে মুম্বাই থেকে তার বড়ভাইকে আটক করা হয়েছিল।

তিনি বলছিলেন, "আমার বড় ভাই রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গত মাসে মুম্বাই গিয়েছিল। জুলাইয়ের নয় তারিখে রাত সাড়ে আটটার দিকে ভাইকে পুলিশ ডেকে নিয়ে যায়। আমরা এসব জানতাম না। পরের দিন থানা থেকে কোনভাবে আমাদের খবর দেয় সে।

কোচবিহারের স্থানীয় সাংবাদিকদের সামনে কথা বলতে গিয়ে পূর্ব বর্ধমান জেলার মূল বাসিন্দা মুস্তাফা কামাল শেখ জানাচ্ছিলেন তাকেও জুলাইয়ের নয় তারিখেই পুলিশ আটক করে।

তার কথায়, "রাত প্রায় দুটো নাগাদ আমি কাজ থেকে ফিরি। রাত তিনটে নাগাদ আমার ঘরে পুলিশ আসে। তারা বলে যে আমাদের কাছে খবর আছে যে তোমরা বাংলাদেশি। তোমরা যে ইন্ডিয়ার, তার যা প্রুফ আছে সেসব নিয়ে তোমরা পুলিশ চৌকিতে এস।

"আধার কার্ড, প্যান কার্ড – আমাদের যা প্রমাণ আছে সব নিয়ে পুলিশের কাছে যাওয়ার পরে সেগুলো ভাল করে চেকও করে নি। তারা খুঁজছিল যে ফোনে বাংলাদেশি কোনও নম্বর আছে কী না। এরপর সেখান থেকে আমাদের মীরা রোডে নিয়ে যায় ভেরিফিকেশন করার জন্য," জানাচ্ছিলেন মি. শেখ।

মি. শেখ যদিও বলছিলেন আধার কার্ড আর প্যান কার্ড দেখিয়েছিলেন নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে, তবে প্যান কার্ড আয়কর বিভাগের পরিচয় পত্র এবং আধার কার্ড জাতীয় পরিচয় পত্র। এই দুটির কোনোটি নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়।

আবার এই সব নথিই যে অর্থের বিনিময়ে অবৈধ পথে পাওয়া যায়, সেটাও ঘটনা। সেজন্যই সম্প্রতি অবৈধ ভাবে ভারতে বসবাসকারী বাংলাদেশি নাগরিকদের যখন আটক করা হচ্ছে, অনেক সময়েই পুলিশ ওই সব নথি জাল হতে পারে বলে মনে করছে এবং আরও প্রমাণ চাইছে।

মুর্শিদাবাদের যে কয়েকজনকে মহারাষ্ট্রের পুলিশ আটক করেছিল, তাদের বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনিক স্তরে যোগাযোগ করছিল পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ নামের সামাজিক সংগঠনের প্রধান আসিফ ফারুক।

তিনি বলছিলেন, "মীরা রোড থানায় যে পুলিশ কর্মকর্তা এদের বিষয়টি দেখছিলেন, তার সঙ্গে আমরা বার বার যোগাযোগ করেছি, তাদের সব নথি দিয়েছি। হঠাৎই শুক্রবার রাতে খবরই পাই যে এদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমরা সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছিলাম যাতে বিএসএফের সঙ্গে কথা বলে সীমানা পরা করানোটা বন্ধ করা যায়।

"শনিবার সকালে জানতে পারলাম ততক্ষণে এদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়ে গেছে," জানাচ্ছিলেন আসিফ ফারুক।

নো ম্যানস্ ল্যান্ডে তিন ভারতীয় নাগরিক - মুস্তাফা কামাল (বাঁয়ে), মিনারুল শেখ (মাঝে), নাজিমুদ্দিন মন্ডল (ডানে)

ছবির উৎস, Rakibul Islam

ছবির ক্যাপশান,

নো ম্যানস্ ল্যান্ডে তিন ভারতীয় নাগরিক - মুস্তাফা কামাল (বাঁয়ে), মিনারুল শেখ (মাঝে), নাজিমুদ্দিন মন্ডল (ডানে)

নো ম্যানস্ ল্যান্ডে কান্নাকাটি

এরপরেই একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে নাজিমুদ্দিন মণ্ডল এবং মিনারুল শেখ নামে দুজনকে দেখতে পাওয়া যায়। এই নামগুলো আগেই বিবিসির হাতে এসেছিল – যারা মীরা রোড থানায় আটক হয়েছিলেন এবং এদের পরিচয় পত্রও পাওয়া গিয়েছিল।

ওই ভিডিওতে মি. শেখ এবং মি. মণ্ডলরা অভিযোগ করেন যে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়ার আগে তাদের মারধর করা হয়েছে।

ওই ভিডিওতে অবশ্য এটাও দেখা গেছে যে একজন নারী স্বীকার করেই নিচ্ছেন যে তার বাড়ি বাংলাদেশে।

যারা ভারতে ফিরে এসেছেন, তারা বলছেন যে তাদের মতো কয়েকজন ভারতীয়দের সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিকরাও ছিলেন, যারা সম্ভবত অবৈধ ভাবেই ভারতে গিয়েছিলেন। এই দফায় প্রায় ১৫০ জনকে মুম্বাই থেকে প্রথমে পুণে, তারপরে বিমানে চাপিয়ে শিলিগুড়ি নিয়ে আসা হয়।

সেখানেই বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করা হয় সবাইকে – পুশ ব্যাকের জন্য।

মেহবুব শেখও যে ভারতীয় নাগরিক, তা নিশ্চিত করেছে মুর্শিদাবাদের পুলিশ

ছবির উৎস, Asif Faruk

ছবির ক্যাপশান,

মেহবুব শেখও যে ভারতীয় নাগরিক, তা নিশ্চিত করেছে মুর্শিদাবাদের পুলিশ

'বাংলাদেশে আটক'

পুশ ব্যাকের পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে বিএসএফ কখনই কোনও আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করে না, এবারেও করে নি।

কিন্তু কোচবিহারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সন্দীপ গড়াই বলছেন যে বিএসএফই বাংলাদেশের বিজিবির সঙ্গে পতাকা বৈঠক করে এই চারজনকে ফিরিয়ে এনেছে।

তার কথায়, "বাংলাদেশি সন্দেহ করে মুম্বাই পুলিশ উনাদের গ্রেফতার করে এবং তারপরে বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আমাদের কোচবিহার জেলায় নিয়ে এসে বিএসএফকে বলা হয় বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য।

"আমরা খবর পাই যে বিএসএফের ১৫৬ নম্বর ব্যাটালিয়নের অধীন রতনপুর সীমান্ত চৌকির কাছাকাছি জিরো পয়েন্টে এরা বাংলাদেশের বিজিবির কাছে এরা আটক ছিলেন," বলছিলেন মি. গড়াই।

এরপরে মুর্শিদাবাদ ও পূর্ব বর্ধমান জেলা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে ধৃতদের নাগরিকত্ব প্রমাণের যাবতীয় নথি বিএসএফের কাছে আনুষ্ঠানিক ভাবে তুলে দেয় পুলিশ।

মি. গড়াইয়ের কথায়, "আমরা বিএসএফকে অনুরোধ করি যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই ভারতীয় নাগরিকদের যেন ফিরিয়ে আনা হয়। কোচবিহার জেলা পুলিশের চাপে পড়ে বিজিবির সঙ্গে ফ্ল্যাগ মিটিং করে বিএসএফ।"

পতাকা বৈঠকের পরে ওই ভারতীয় নাগরিকদের কোচবিহারের পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হয়।

নাজিমুদ্দিন মন্ডল ঘরে না ফেরা পর্যন্ত স্ত্রী পিঙ্কি খাতুনের উদ্বেগ কাটছে না

ছবির উৎস, Rakibul Islam

ছবির ক্যাপশান,

নাজিমুদ্দিন মন্ডল ঘরে না ফেরা পর্যন্ত স্ত্রী পিঙ্কি খাতুনের উদ্বেগ কাটছে না

'বাংলা ভাষায় কথা বললে বাংলাদেশি'?

পশ্চিমবঙ্গের অন্তত চারজন বাসিন্দাকে বাংলাদেশি বলে পুশ ব্যাক করে দেওয়ার ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীও মুখ খুলেছেন।

সোমবার বিধানসভায় তিনি বলেন, "বাংলা ভাষায় কথা বললে বাংলাদেশি বলা হচ্ছে। বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।"

রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপিরই সরকার রয়েছে মহারাষ্ট্রে। তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, "লজ্জা করে না আপনাদের! আধার কার্ড, প্যান কার্ড এবং অন্য পরিচয়পত্র থাকার পরেও শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণে মহারাষ্ট্রে বিজেপি সরকার এই কাজ করেছে। আমি তাদের ধিক্কার জানাই।"

তিনি এও বলেন যে সব রাজ্যে বিজেপির সরকার রয়েছে, সেখানেই এই ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

পহেলগামের হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র ও আসামে বিশেষ অভিযান চালিয়ে অবৈধ বাংলাদেশিদের আটক করে পুশ-ব্যাক করা শুরু হয়েছে।

আর ভারতে যেসব বাংলাদেশের নাগরিক বৈধ নথি ছাড়াই বসবাস করছিলেন, এমন ব্যক্তিদের আটক করতে গিয়ে ভারতীয় বাংলা ভাষী অনেককেও আটক করে পুশ ব্যাক করে দেওয়া হচ্ছে বলে বার বার অভিযোগ তুলছে মানবাধিকার সংগঠনগুলি।

বিবিসি জানতে পেরেছে যে ভারতীয় নাগরিকত্ব নিশ্চিত হওয়ার পরে পুশ ব্যাক করে দেওয়া অনেককেই ফিরিয়েও আনা হচ্ছে। তবে কতজন ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করা হল বা কতজনকে ফিরিয়ে আনা হল, সে ব্যাপারে কোনও তথ্য জানা যাচ্ছে না।

সমাজকর্মী আসিফ ফারুক ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে 'তথ্য জানার অধিকার আইন' অনুযায়ী প্রশ্ন করেছিলেন যে পশ্চিমবঙ্গে কতজন পরিযায়ী শ্রমিককে গুজরাত, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র আর ওড়িশায় আটক করা হয়েছে এবং কেন?

এই প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সংশ্লিষ্ট দফতর জবাব দিয়েছে যে তাদের কাছে এই তথ্য নেই। নির্দিষ্ট রাজ্যগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছে তারা।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews