মাদক ব্যবসায়ে জড়িত দিনাজপুরের পার্বতীপুরে শিশুধর্ষণে অভিযুক্ত সাইফুল ইসলাম। এলাকায় পরিচিত ছিল কালা সাইফুল নামে। চলতি বছর নারী নির্যাতন মামলায় জেল খেটেছে এক মাসেরও অধিক সময়।

এলাকায় গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের জমিরহাট এলাকার তকেয়াপাড়া গ্রামের জহির উদ্দিনের ছেলে সাইফুল ইসলাম। সে ওই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি ছিল। ২০ বছর আগে সে একই গ্রামের সহির উদ্দিন মেয়ে নার্গিসকে বিয়ে করে। বিবাহিত জীবনে তার ৩ মেয়ে ও এক ছেলে জন্ম নেয়। বিয়ের আগে ও পরে সে কাঠ ব্যবসাসহ ফড়িয়া (দালালি) ব্যবসা করে সংসার চালতো। কয়েক বছর থেকে সাইফুলের ‘অচেনা-অজানা’ লোকজনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে সে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে থাকে বলে স্থানীয়রা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান।

কারণে-অকারণে লোকজনের ওপর হাত তোলা এবং  ভয়-ভীতি প্রদর্শন করায় লোকজন ক্রমশ তাকে ভয় পেতে শুরু করে। প্রায়ই সে তার তার স্ত্রী নার্গিসকে শারীরিক ও মানসিকভাবে করতো। এরই মধ্যে তার পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়ে বড় মেয়ের শাশুড়ির সঙ্গে, এমন অভিযোগও রয়েছে। এসব কারণে গত বছর স্ত্রীর সঙ্গে তার ডির্ভোস হয়ে যায়। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে নারী নির্যাতন মামলায় ১ মাস ৯ দিন হাজতে ছিল সে। হাজত থেকে বেরিয়ে সে আরও খারাপ আচরণ করতে শুরু করে- এমনটাই জানা যায়। প্রায় প্রকাশ্যেই জড়িয়ে পড়ে ফেন্সিডিল ও  গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক ব্যবসার সঙ্গে।

চলতি বছরের মার্চ মাসে সাইফুল তার বড় মেয়ের শাশুড়িকে বিয়ে করে।

এলাকাবাসীর অনেকে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, পড়াশোনায় ৫ম শ্রেণিও পেরুতে পারেনি সাইফুল ইসলাম। বিয়ের সময় তার শ্বশুর ২৭ শতক জমি দিয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হয়ে সে জমিটুকুও খুইয়েছে সে। কিছুদিন আগে সে জাহাঙ্গীর নামে এক অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা ধার নিয়ে আর ফেরত দেয়নি।

সাইফুল ইসলামের ভাই সাইদুল ইসলাম ও সফিউল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, প্রায় এক বছর ধরে সাইফুলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই। মাদকাসক্ত হওয়ায় প্রায়ই তাদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকতো। 

তারা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, সাইফুল ইসলামের সঙ্গে অচেনা কিছু লোকজনের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে। প্রায়ই তারা সাইফুলের বাড়িতে যাওয়া-আসা করতো। এই কারণে সাইফুল ক্রমে বেপরোয়া হয়ে উঠতে থাকে।

ধর্ষক সাইফুলের সাবেক শ্বশুর ও আপন চাচা সহির উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, বিকৃত মন-মানসিকতার মানুষ সাইফুল। তিন মেয়ে ও এক ছেলের জনক সে। বিয়ে দেওয়ার পরও নিজের বড় মেয়ে রেশমাকে (১৮) মারধোর করতো সাইফুল। বড় মেয়ের শাশুড়ির সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের কারণে তার মেয়ে নার্গিস সাইফুলকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয় মেয়ে সুজাতা (১৩) ও তৃতীয় মেয়ে সালমাকে (১১) নিয়ে বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছে। তাদের একমাত্র ছেলে নাজমুলকে (৫) অন্যের বাড়িতে রাখা হয়েছে। 

পূজার মাসি (খালা) বুলবুলী রানী জানায়, শিশুটি নিখোঁজের পর সবাই খোঁজাখুজি শুরু করলে অভিযুক্ত সাইফুল ইসলাম বাড়িতে এসে তাকে দেবী বা জ্বীনে লুকিয়ে রেখেছে বলে অপপ্রচার শুরু করে। পরে সে কবিরাজ নিয়ে আসে ও কবিরাজ বলে পরের দিন সকালে ওই শিশুকে পাওয়া যাবে। তিনি অভিযুক্ত সাইফুল ইসলাম ও কবিরাজের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

পূজার কাকা মদন দাস বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর সাইফুল ইসলাম মোবাইলে ওই শিশুটির বাবাকে বলে ‘বেশি বাড়াবাড়ি করিস না, আপোসে আয়। তা না হলে পরিণতি খারাপ হবে’ এই বলে মোবাইলে হুমকি দেয়। এলাকাবাসীর অনেকে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, শিশু পূজা নিখোঁজ হওয়ার পর তাকে না পেয়ে পরিবারের সদস্যরা খুঁজতে শুরু করলে সাইফুল ইসলাম ওই শিশুর মাকে বলেন, বাচ্চাটিকে হয়তো দেবী বা জ্বিনে ধরেছে। কবিরাজ নিয়ে এসে ঝাড়ফুঁক করলে পাওয়া যাবে। পরে আফজাল হোসেন নামে একজন কবিরাজকে নিয়ে আসলে কবিরাজ বলেন পরের দিন সকালে বাচ্চাটিকে পাওয়া যাবে। তার কথামতো পরদিন সকালে বাড়ির পাশের হলদি ক্ষেত থেকে অচেতন অবস্থায় শিশুটিকে পাওয়া যায়। পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এলাকার লোকজন আরও জানায়, আফজাল হোসেন ওই এলাকার একজন সুপরিচিত কবিরাজ। তাকে লোকে বিশ্বাস করতো। 

তাদের দাবি, এই ‘ভণ্ড কবিরাজকে’ গ্রেফতার করা হলে আরও অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে।

পূজার দাদা অনিল চন্দ্র দাস বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, সাইফুল নিজের অপরাধ আড়াল করতে একই গ্রামের ভণ্ড কবিরাজ আফজাল হোসেনের কাছে তার ছেলে সুবল দাসকে নিয়ে যান। সাইফুলের শিখিয়ে দেওয়া কথা মতে কবিরাজ বলেছিল আপনার মেয়েকে খোঁজার দরকার নেই। সকাল বেলা শিশুটিকে পাওয়া যাবে। পরদিন শিশুটিকে পাওয়া যায় ঠিকেই তবে তা সংজ্ঞাহীন ধর্ষিত অবস্থায়। তার পরেও সাইফুল শিশুটিকে হাসপাতালে নিতে বাধা দিয়ে বলে, কবিরাজ ঝাড়ফুঁক দিলেই ঠিক হয়ে যাবে শিশুটি। হাসপাতালে শিশুটির জ্ঞান ফিরলে ধর্ষক হিসেবে সাইফুলকে সনাক্ত করা হয়।

কবিরাজের স্ত্রী রেহেনা খাতুন বলেন, তার স্বামীর সঙ্গে জিন আছে। সে এলাকায় কবিরাজি করে। এলাকার মানুষদের তেল পড়া ও পানি পড়াসহ ঝাড়ফুঁকের কাজ করে। সাইফুল শিশুটির বাবাকে নিয়ে তার কাছে এসেছিল। তার স্বামীকে ৫০১ টাকা দিলেও সেখান থেকে গোপনে সাইফুল ৩০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তার স্বামীর ধর্ষণ কাজে জড়িত ছিল না। কবিরাজি করতে গিয়ে ফেঁসে গেছে। গ্রেফতার আতঙ্কে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে।

দিনাজপুরে আদালতে সাইফুলকে নেওয়ার সময়

উল্লেখ্য, ১৮ অক্টোবর দুপুরে খেলতে বাইরে গেলে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয় ৫ বছর বয়সী শিশু পূজা। অনেক খোঁজ করেও তাকে না পেয়ে রাতে পার্বতীপুর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন পূজার বাবা (সুবল চন্দ্র দাস)। পরের দিন সকালে পূজাকে বাড়ির পাশের হলদি ক্ষেত থেকে অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এরপর তাকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি করা হয়। পরে জ্ঞান ফিরতে শিশুটি ধর্ষক সাইফুল ইসলামের কথা বলে। ওই ধর্ষক শিশুটির গোপনাঙ্গ কেটে ধর্ষণ করে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়।

এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে পূজার বাবা পার্বতীপুর থানায় একই গ্রামের জহির উদ্দিনের ছেলে সাইফুল ইসলাম ও আফজাল হোসেন কবিরাজকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। ঘটনার ৭ দিন পর গত মঙ্গলবার পুলিশ অভিযুক্ত সাইফুলকে দিনাজপুরের ঈদগাহ বস্তি এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করে পুলিশ। বৃহস্পতিবার আদালত অভিযুক্ত সাইফুলকে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর করেন। শিশুটি বর্তমানে ঢামেক হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি রয়েছে।

/এমডিপি/এইচকে/



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews