সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) সংবাদদাতা
হাতের মেহেদির রং এখনো কিছুটা লেগে আছে—যেন জীবনের শেষ চিহ্ন হয়ে। মাত্র এক মাস আগে জীবনের নতুন অধ্যায়ে পা রেখেছিল তরুণী, স্বপ্ন ছিল—সংসার হবে। অথচ সেই নববধূই আজ নেই। খেলার ফাঁকে পুকুরে ডুবে নিঃশ্বাস হারিয়েছে একটি শিশু। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় গত দুই দিনের ব্যবধানে পাঁচটি প্রাণ ঝরে গেছে— নববধূর আত্মহত্যা, পুকুরে ডুবে শিশুর মৃত্যু, জাম গাছ থেকে পড়ে মৃত্যু, আরেকজনের গলায় ফাঁস, আরেকজন স্কুলছাত্রীও নিজেকে শেষ করে দিয়েছে। প্রতিটি মৃত্যুই আলাদা, কিন্তু সব মিলিয়ে এক অজানা অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছে পুরো জনপদকে। মানুষের মুখে এখন একটাই প্রশ্ন—এই মৃত্যুগুলোর পেছনে কি কেবল দুর্ঘটনা, না কি কোনো গভীর সামাজিক বেদনা লুকানো আছে।
বুধবার (১৮ জুন) উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ শ্রীপুর (চ্যাংমারী) গ্রামে গলায় ফাঁস দিয়ে লুৎফর রহমান (৩৫) নামের এক যুবক আত্মহত্যা করেছেন। তিনি ওই গ্রামের মৃত আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, দীর্ঘদিন ধরে মানসিক সমস্যায় ভোগার কারণে তিনি ঘরের বাঁশের সাথে বিছানার চাদর ছিঁড়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
আগের দিন মঙ্গলবার (১৭ জুন) সকালে উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নের বামনডাঙ্গা মনমোহিনী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে জাম পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে নিহত হন মো: ডেবিট মিয়া (৫০)। তিনি রামভদ্র গ্রামের মৃত শামসুল হক ব্যাপারীর ছেলে। স্থানীয়রা জানায়, স্কুলমাঠে একটি বড় জামগাছে উঠে ফল পাড়ার সময় হঠাৎ মগডাল ভেঙে নিচে পড়ে গেলে গুরুতর আহত হন তিনি। পরে হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
একই দিন বিকেলে বেলকা ইউনিয়নের পূর্ব বেলকা গ্রামে পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যায় দুই বছর বয়সী শিশু আলিফ হোসেন, সে কবির হোসেনের ছেলে। মা আয়েশা বেগম তাকে গোসল করিয়ে উঠানে রেখে ঘরে প্রবেশ করেন। কিছুক্ষণ পর শিশুটিকে খুঁজে না পেয়ে পরিবারের সদস্যরা খোঁজাখুঁজি শুরু করে। একপর্যায়ে পুকুরে ভেসে থাকতে দেখে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
গত সোমবার (১৬ জুন) রাত সাড়ে ১১টার দিকে বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মনমথ সরকারপাড়া গ্রামে নববধূ জরিনা বেগম (১৮) বিয়ের এক মাসের মাথায় আত্মহত্যা করেন। জরিনা বেগম বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মনমথ সরকারপাড়া গ্রামের মুন্নাফ মিয়ার স্ত্রী এবং উপজেলার কাপাসিয়া ইউনিয়নের লালচামার গ্রামের নুরনবী মিয়ার মেয়ে।
মঙ্গলবার, একই রাতে সর্বানন্দ ইউনিয়নের নবম শ্রেণির ছাত্রী চম্পা আক্তার (১৪) রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। নিহত চম্পা আক্তার উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নের তালুক সর্বানন্দ গ্রামের বাদশা মিয়ার মেয়ে। সে স্থানীয় খাজেমুল ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার নবম শ্রেণির ছাত্রী।
প্রেমিক শাকিল মিয়ার ধর্ষণের শিকার হয়ে ও বিয়ে না করার ঘোষণায় বিষপান করে আত্মহত্যা করে সে। মৃত্যুর আগে মোবাইলে ভিডিও বার্তায় সে ঘটনার বিস্তারিত জানায়, যা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। চম্পার মা আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে একটি মামলা করেছেন।
এ বিষয়ে সুন্দরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো: আব্দুল হাকিম আজাদ বলেন, এ ঘটনায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে মামলা নেয়া হয়েছে। আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
দুই দিনের ব্যবধানে এমন পাঁচটি মৃত্যুর ঘটনায় সুন্দরগঞ্জবাসী শোকাহত ও উৎকণ্ঠিত। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ঘটনাগুলোকে মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক বলে অভিহিত করেছেন।