গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেনের উদ্যোগ-প্রচেষ্টায় নির্বাচনের মাস কয়েক আগে যখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়, তখন অনেকে আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন এটা ভেবে যে, রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন এবার আসলেও আসতে পারে। ড. কামাল হোসেনের সুনাম ও খ্যাতির ওপর যাদের আস্থা অনেক বেশি, তাদের কেউ কেউ তাকে দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতিও ভাবতে শুরু করেছিলেন। কামাল হোসেনকে নেতা মেনে বিএনপি যে ঐক্যফ্রন্টে শামিল হয়, সেটাও ছিল অনেকের কাছে খুশির খবর। কারণ, বিএনপি বড় দল। তাদের শক্তি কামাল হোসেনের দলের চেয়ে অনেক বেশি। কামাল হোসেন, আ স ম আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ যারা ঐক্যফ্রন্ট গঠনের বড় উদ্যোক্তা তাদের সবারই দল ছোট। সব জেলায় এসব দলের কমিটিও নেই। ছোটদের বড় উদ্যোগে বিএনপির মতো বড় দলের একাত্ম হওয়াটা রাজনীতি-আগ্রহীদের উৎসাহী করে তুলেছিলো।

কাদের সিদ্দিকীর ঐক্যফ্রন্টে থাকা না-থাকা নিয়ে সংশয় ছিল। কারণ, তিনি আওয়ামী লীগের নৌকায় চড়ার চেষ্টাও চালাচ্ছিলেন বলে খবর ছড়িয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে বোঝাপড়া না হওয়ায় কাদের সিদ্দিকী ঐক্যফ্রন্টেই এসে নোঙর করেন। আবার ঐক্যফ্রন্ট গড়ার আরেক কারিগর ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপির সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ঐক্যফ্রন্ট থেকে ছিটকে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে আওয়ামী লীগের সহযাত্রী হন। রাজনীতিতে শেষ কথা নেই বলে যে চরম সুবিধাবাদী বক্তব্য চালু আছে, এবার নির্বাচনের আগে জোট, ঐক্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে তার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা গেছে।

ড. কামাল হোসেন অতি সৌভাগ্যবান এই কারণে যে, দেশের গণমাধ্যমগুলো তার ওপর সবসময় বেশি আলো ফেলে থাকে। তার যেকোনও উদ্যোগের ব্যাপারেই গণমাধ্যমের ব্যাপক আগ্রহ দেখা যায়। গণফোরাম গঠনের সময়ও এটা দেখা গেছে। শুরুতে এমন ধারণা হয়েছিলো যে, গণফোরামই বুঝি হতে চলেছে দেশে মূলধারার প্রধান রাজনৈতিক দল। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই জোয়ার কেটে ভাটার টান গণফোরামকে শুষ্ক করে ফেলে। এবারও ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে কি কম মাতামাতি হলো?

বিএনপি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে খুব অসুবিধায় আছে। তাদের পথচলায় একটি সাদা ছড়ি দরকার ছিল। কামাল হোসেন হলেন বিএনপির সেই সাদা ছড়ি।

কামাল হোসেন বলেছিলেন, আর যাই হোক, বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে হবে। কিন্তু বিএনপি তা ছাড়েনি। বিএনপি জামায়াতেও আছে, কামাল হোসেনেও আছে। বিএনপি নাকি বলেছিলো, তারেক রহমানকে নির্বাচনের আগে সামনে আনা হবে না। কিন্তু কথা রাখেনি। তাদের দলীয় প্রার্থী মনোনয়নে তারেক প্রকাশ্যে পালন করেন নিয়ামক ভূমিকা। ড. কামাল এসবে আশাহত হন। কিন্তু ততদিনে তিনি যে ট্রেনে উঠে বসেছেন, সেটা প্ল্যাটফরম ছেড়ে দিয়েছে। জামায়াতকে না ছাড়া, তারেককে সামনে আনা ইত্যাদি ঘটনায় কামাল হোসেন মনঃক্ষুণ্ন হলেও বিএনপির সঙ্গ তিনিও ত্যাগ করতে পারেননি। বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে এমন সব কথাবার্তা বলা হতে থাকে, যাতে মনে হয় তারা বুঝি ক্ষমতায় এসে গেছে। দায়সারা গোছের নির্বাচনে গিয়েও তাদের হাঁকডাকে অন্যদের পিলে চমকানো অবস্থা। আওয়ামী লীগ ৩০টার বেশি সিট পাবে না, ৩০ ডিসেম্বর ভোটের পর আওয়ামী লীগ পালানোর পথ পাবে না, দেশে ভোট বিপ্লব হবে, খালেদা জিয়াকে জেল থেকে বের করে আনা হবে এই রকম সব কথা বলে বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট এক ধরনের উত্তেজক পরিবেশ তৈরি করে। ড. কামাল হোসেনের মতো একজন বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদও হুমকি দিয়ে কথা বলতে আরম্ভ করেন। দেখে নেওয়া, পালানোর পথ পাবে না ইত্যাদি উসকানিমূলক কথাবার্তা বলে তারা আর কী লাভ করেছেন সেটা বোঝা না গেলেও আওয়ামী লীগ এবং সরকারকে কঠোর অবস্থানের দিকে ঠেলে দিতে পেরেছেন। আওয়ামী লীগ নির্বাচন করেছে ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য। সে জন্য তারা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। দল গুছিয়েছে, প্রশাসন সাজিয়েছে। আর ঐক্যফ্রন্ট বিএনপির প্রভাবে পড়ে নির্বাচনকে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করার কৌশল খুঁজেছে। সেদিক থেকে দুই পক্ষই সফল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরেছে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। বিএনপি-ঐক্যজোট মাত্র আটটি আসন লাভ করে গভীর খাদে পড়েছে। নির্বাচনে নানা অভিযোগ উত্থান করে বিএনপি-ঐক্যজোট আবার নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানাচ্ছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এই দাবিকে ‘মামার বাড়ির আবদার’ বলে উল্লেখ করেছেন।

বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে রেখেছে। মানুষ ভোট দিতে পারেনি ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হলো, এভাবে ঢালাও অভিযোগ উত্থাপন করে এই পর্যায়ে কোনও লাভ আছে কি? আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরা হলে ভোট পাহারা দেওয়ার লোকেরা কী করলো? কামাল হোসেন, মির্জা ফখরুলরা তো আগের রাতেই ভোটকেন্দ্র দখল করে পাহারা দেওয়ার কথা বলেছিলেন। ভোট বিপ্লবের কথা বলেছিলেন। তাদের এসব ফাঁকা বুলি এক ধরনের মুখোমুখি অবস্থান তৈরি করেছিলো। আওয়ামী লীগে অতি সতর্কতা দেখা দিয়েছিলো। মানুষের মধ্যেও শঙ্কা তৈরি হচ্ছিলো।

ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত করার চেয়ে তাদের নিরুৎসাহিত করার জন্য কিছু প্রচারণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। প্রথমদিকে ছড়ানো হয়েছিলো ভোট সুষ্ঠু হলে বিএনপি জিতবে। আবার যখন দেখা গেলো বিএনপির পক্ষে কোনও জোয়ার তৈরি হচ্ছে না, তখন প্রচার করা হলো, ভোট যেমনই হোক, আওয়ামী লীগই জিতবে। এই দুই প্রচারণাই কার্যত আওয়ামী লীগের পক্ষে গেছে। বিএনপি যেহেতু ধরে নিয়েছিলো যে, নির্বাচনে তাদের হারিয়ে দেওয়া হবে, সেহেতু তাদের একমাত্র চেষ্টা ছিল সরকারের বিরুদ্ধে, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে একটি শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের গায়ে কালির দাগ ছিঁটিয়ে দেওয়া। বিএনপির উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে।

আপনার শক্তি নেই অথচ কেন্দ্র দখল, পাহারা, ভোটবিপ্লব ইত্যাদি কথা বলে তাওয়া গরম করেছেন। যাদের শক্তি আছে, তারা ভোটকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গরম তাওয়ায় রুটি ভাজার কাজ সম্পন্ন করেছে। এখন যত বিতর্ক বা প্রশ্নই উত্থাপন করা হোক না কেন, বাস্তবতা হলো, নির্বাচন হয়েছে এবং নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আবার মন্ত্রিসভা গঠন করে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পালনও শুরু করেছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় এবং বিএনপির পরাজয় ছিল অনিবার্য। তবে আওয়ামী লীগ যত ভোট এবং আসন পেয়েছে, সেটা অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত মনে হয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগও হয়তো প্রায় সব আসনে তাদের জয় আশা করেনি। কিন্তু যখন দু’কূল প্লাবনী বন্যার পানির তোড় আসে তখন অনেক কিছুই ভেসে যায়। এবারের নির্বাচন অনেকটা সে রকমই হয়েছে। অনেকেই ভোট দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ ভোট দিতেও পারেননি। যারা ভোট দিতে পারেননি, তারা সবাই বিএনপির ভোটার ছিলেন, সেটা বলা যাবে না। ফলে নির্বাচন ভালো-খারাপের বিতর্ক খুব জমবে না। কেউ যদি নির্বাচনকে খারাপ বলেন তাহলে ভালো বলার লোকও কম নেই। তাই নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বিএনপি আন্দোলন জমাতে পারবে বলে মনে হয় না।

বিএনপিকে এটা মেনে নিতে হবে যে, তারা এবার পরাজিত হয়েছে। নতুন করে তাদের সংগঠিত হতে হবে এবং পরেরবার জয়ের জন্য তৈরি হতে হবে। আওয়ামী লীগ দীর্ঘ একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল বা তাদের ক্ষমতার বাইরে রাখা হয়েছিলো। বিএনপিকে এখন ধৈর্য ধরতে শিখতে হবে। অস্থিরতা এবং হঠকারিতা বিএনপিকে সামনে অগ্রসর হওয়ার বদলে পেছনেই ঠেলে দেবে। সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে বিএনপি সরে না এলে তারা আবার পেছনে পড়তে হবে। সংসদে বিরোধী দলের সংখ্যা ছোট হলেও তারা গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারে। জামায়াতের ব্যাপারেও তাদের দোদুল্যমানতা পরিহার করতে হবে। জামায়াত আর বিএনপির রাজনীতিতে সম্পদ হয়ে উঠবে না, বোঝা হয়েই থাকবে। মার্চ মাসে অনুষ্ঠিতব্য উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশ না নেয় তবে তারা মারাত্মক ভুল করবে। সংসদের ভেতরে-বাইরে লড়াই করেই আবার মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য এবং আস্থাভাজন হয়ে উঠতে হবে। ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বিরোধ না বাড়িয়ে বিএনপি যদি তার পরামর্শ অনুযায়ী চলতে পারে, তাহলে রাজনীতির নতুন যাত্রায় বিএনপি ভূমিকা রাখতে পারবে।

গণতন্ত্রের স্বার্থেই দেশে শক্তিশালী বিরোধী দলের দরকার। বিএনপিকে সেই শূন্যতা পূরণের উপযুক্ত হয়ে উঠতে হবে।

শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতির বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিবেচনার বাইরে আছে বলে মনে হয় না। বিএনপি শেষ পর্যন্ত কী করবে সেটা যেহেতু অনিশ্চিত, সেহেতু এবার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে উৎসাহিত করা হয়েছে। গতবারের মতো সরকারেও আছে, বিরোধী দলেও আছে- এই দ্বৈত অবস্থান থেকে জাতীয় পার্টিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। জাতীয় পার্টির কেউ এবার মন্ত্রিসভায় নেই। জাতীয় পার্টির সব সংসদ সদস্য বিষয়টি হৃষ্টচিত্তে মেনে না নিলেও তাদের এই অবস্থা মেনে না নিয়ে উপায় নেই।

অন্যদিকে ১৪ দলের শরিকদের মধ্য থেকেও এবার কাউকে মন্ত্রী করা হয়নি। শেখ হাসিনার আগের তিন আমলেই মন্ত্রী ছিলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তিনি জেপির প্রধান। এবার তিনি মন্ত্রিসভায় নেই। মন্ত্রিসভায় নেই ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন এবং জাসদের হাসানুল হক ইনু। এদের যে এবার মন্ত্রিসভায় রাখা হবে না, এ নিয়ে আগে কোনও আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। ফলে ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে যে কিছু অসন্তোষ ও হতাশা তৈরি হয়নি তা নয়। সম্ভবত নির্বাচনের অভূতপূর্ব ফলাফল, আওয়ামী লীগের একচেটিয়া জয় শেখ হাসিনাকে নতুন চিন্তায় প্রভাবিত করে থাকতে পারে। বিরোধী দলের শূন্যতা পূরণের বিষয়টি মাথায় রেখেই হয়তো ১৪ দলের শরিকদের বিরোধী দলের ভূমিকায় দেখতে চেয়েছেন তিনি। ১৪ দলের শরিকদের শক্তিবৃদ্ধির ওপরও জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। শরিকরা এই অবস্থানে খুব খুশি না হলেও তাদের সামনে বিকল্প তেমন একটা নেই। সরকারের সঙ্গে জোটে থেকে নির্বাচনে জিতে সংসদে কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা পালন সম্ভব কিনা সেটা দেখার বিষয়। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিতে যে একটি নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে এবং তার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে একটু সময় লাগবে। তবে রাজনীতিতে শূন্যতা থাকে না।

লেখক: গ্রুপ যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক আমাদের নতুন সময়, আমাদের অর্থনীতি, ডেইলি আওয়ার টাইম ও আমাদের সময় ডটকম



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews