কয়েক আগে সাদাপাথরে বেড়াতে যাওয়া আমার। সিলেট থেকে জিপে করে কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ। সেখান থেকে নৌকোয় সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র। কী অপার মুৈগ্ধতা! টলটলে স্বচ্ছ নীলাভ পানির খরস্রোতা পাহাড়ি নদী ধলাইয়ের তীর ধরে দিগন্তবিস্তৃত সাদাপাথরের সমুদ্র। পা ফেলতেই পানির তলে পিচ্ছিল পাথর আর পাথর। পাথরের যে পয়েন্টে সবাই যায়, সেখানে নদীর পানিতে নেমে দূর পাহাড়ের দিকে চোখ। ঐ যে ভারত। ঐ দূর ছায়া পাহাড়ের চূড়া সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয়। সেখানের মালভূমির ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় ক্ষয়প্রাপ্ত শিলাখণ্ড। সেগুলোই বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢলে পিয়াইন ও ধলাই নদীর খরস্রোত ধরে বাংলাদেশের সমতলে নেমে আসে। খাড়া পাহাড়ি ঢাল পেরিয়ে সমতলে প্রবেশ করার পর নদীর গতি হঠাৎ কমে যায়; ভারী পাথরগুলো জমা হতে থাকে নদীর মোহনায় বা চরাঞ্চলে। ভোলাগঞ্জ, জাফলং, বিছনাকান্দি ও উৎমাছড়ার মতো স্থানগুলো এভাবেই পাথরের প্রাকৃতিক ভান্ডারে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু দুঃখজনক হলো, ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকায় গত কয়েক মাস ধরে সংঘটিত গণলুট একদিকে যেমন পরিবেশ ও পর্যটনকে ধ্বংস করেছে, অন্যদিকে স্থানীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার নগ্ন রূপ উন্মোচিত করেছে। একসময় যেখানে সাদাপাথরের স্তূপে ভরপুর ছিল, সেখানে এখন গভীর গর্ত, ঘোলা পানি ও ধ্বংসের চিহ্ন। প্রায় ৮০ শতাংশ পাথর লুট হয়ে গেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্যান্য ইস্যুতে মতপার্থক্য থাকলেও পাথর উত্তোলনের ক্ষেত্রে আশ্চর্যজনক এক ঐকমত্য গড়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ শাসন-পরবর্তী বিএনপি, এনসিপি, জামায়াত ও আরো কয়েকটি দলের প্রভাবশালী স্থানীয় নেতারা প্রকাশ্যে কোয়ারি চালুর দাবি করেছেন। তারা দাবি করেছেন-তাদের বক্তব্য, নীতিমালা মেনে পাথর উত্তোলন হলে তা জনগণের জীবিকা ও অর্থনীতির জন্য সহায়ক হবে। কিন্তু বাস্তবে তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতেই প্রকাশ্যে লুটপাট সংঘটিত হয়েছে। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর অনুসন্ধান, গণমাধ্যমের রিপোর্ট এবং স্থানীয় মানুষের অভিযোগে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে-এই লুটপাটের নেপথ্যে রাজনৈতিক নেতাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
জানা যায়, ২০২০ সালের আগে পর্যন্ত সিলেট অঞ্চলের আটটি কোয়ারি থেকে ইজারা দিয়ে পাথর উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হতো। কিন্তু পরিবেশ ও প্রতিবেশের ভয়াবহ ক্ষতির কারণে সরকার ২০২০ সালের পর থেকে আর ইজারা দেয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তর জাফলংসহ বেশ কয়েকটি এলাকা 'প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা' ঘোষণা করে এবং সেখানে উত্তোলনকে আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে।
ইদানীং নির্মাণ খাতে পাথরের ব্যাপক চাহিদা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশ থেকে প্রায় ৯৫ লাখ মেট্রিক টন পাথর আমদানি করা হয়েছে, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। তবু অভ্যন্তরীণ চাহিদার বড় একটি অংশ সিলেটের কোয়ারিগুলো থেকেই পূরণ হয়। সিলেটে প্রতি ঘনফুট পাথর ৬০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়। সে হিসাবে সাদাপাথর এলাকা থেকে যে পাথর লুট করা হয়েছে, তার বাজারমূল্য প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা!
সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পাথরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের উদ্যোগে কোয়ারি চালুর দাবিতে মানববন্ধন হয়েছে; যেখানে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির শীর্ষ স্থানীয় নেতারা প্রকাশ্যে অংশ নেন। এমনকি সিলেটের বিভাগীয় কমিশনারও এক বৈঠকে পাথর উত্তোলনের পক্ষে মত দেন। পরিবেশকর্মীরা মনে করেন, এই ধরনের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থান লুটপাটকারীদের আরো উৎসাহ দিয়েছে।
ঘটনাচক্র অনুযায়ী, জুলাই গণঅভ্যুথানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ নেতার মদতে রাতের আঁধারে অবৈধভাবে পাথর ও বালু লুট করা হতো। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সিলেটের সব কটি কোয়ারির নিয়ন্ত্রণ নেন বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতারা। পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর পুলিশি কার্যক্রমের ঘাটতির সুযোগে জেলার প্রতিটি কোয়ারিতে পাথর লুট শুরু হয়। এ সময় গোয়াইনঘাটের জাফলং, বিছনাকান্দি; কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, শাহ আরেফিন টিলা, সংরক্ষিত বাংকার এলাকা ও উৎমাছড়া এবং কানাইঘাটের লোভাছড়ার পাথর লুট শুরু হয়।
প্রকাশ্যে এই যে এমন লুটপাট, তার দায় কার? যখনই জানতে চাইবে জনগণ, তখনই উত্তর পাবে- 'আমি না তাই, উনি' এবং সেই উনি বলবেন, 'আমি কেন! ছি ছি। এসবের সব মূলে তিনি।' এভাবে 'আমি নই, উনি এবং উনি নয়, তিনি' চলতেই থাকে। কিন্তু সদুত্তর মেলে না।
রূঢ় বাস্তবতা হলো, যদি স্থানীয় প্রভাবশালীরা পাথর লুটের সহযোগী না হতো, তাহলে এই পাথর লুট হতো না। যদি রাজনীতির প্রভাবকে তারা প্রয়োগ না করতেন আর্থিকভাবে লাভবান হতেন, তবে প্রশাসনকেও দোষ দেওয়ার সুযোগ থাকত না। কেননা, সাদাপাথরের বিশাল মজুতের এই জাতীয় সম্পদ প্রশাসন লুট করতে সহায়তা করতে পারে না একতরফাভাবে। আবার, স্থানীয় প্রভাবশালীরাও লুটপাট করতে পারে না এসব প্রশাসনের নীরবতা ছাড়া। সুতরাং সব মিলিয়ে গোলকধাঁধা হলো-সিলেট অঞ্চলে পাথর ব্যবসা এক প্রকার রাজনৈতিক অর্থনীতিতে পরিণত, যা কিনা স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা নৌকা, ট্রাক, ট্রাক্টর ও ক্রাশার মেশিনের মালিক, আর এই মাধ্যমে তারা লুটপাট থেকে সরাসরি লাভবান হন। প্রশাসন, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের এই অশুভ জোটের কারণেই সাদাপাথর প্রায় নিঃশেষ। দেখা যাচ্ছে, যখন ক্ষমতাবানদের স্বার্থ একত্র হয়, তখন আইন, পরিবেশ ও জনগণের অধিকার কোনোটিই রক্ষা পায় না।
এটাই সত্য, প্রশাসন মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও সেগুলো ছিল প্রতীকী। অভিযান শেষ হলে আবার উত্তোলন শুরু হয়েছে। সীমান্ত এলাকার বিধিনিষেধের কারণে
সেনাবাহিনী মোতায়েন করা না গেলেও বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের উপস্থিতি সত্ত্বেও কার্যকর প্রতিরোধ দেখা যায়নি। এসব ঘটনায় স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর ১২টি মামলা করেছে, আসামি ১৯১ জন হলেও গ্রেফতার হয়েছে মাত্র এক জন। এ থেকেই বোঝা যায়, প্রশাসনের ভূমিকা ছিল দায়সারা।
ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর কেবল একটি অর্থনৈতিক সম্পদ নয়, এটি ভূতাত্ত্বিক ও পরিবেশগত ঐতিহ্য। একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ পাথর উত্তোলনের ফলে নদীর প্রবাহ পরিবর্তিত হচ্ছে, ভাঙন বেড়েছে, জলজ জীববৈচিত্র হুমকিতে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, সাদাপাথরের স্তূপ রাতারাতি আগের রূপ ফিরে পাবে না। পাথর তো আর লম্বা পায়ে হেঁটে হেঁটে আসে না। পানির স্রোতে নতুন কিছু পাথর আসবে বটে, কিন্তু আগের অবস্থায় ফিরতে সময় লাগবে বহু বছর, হয়তো কয়েক দশক। ফলে পর্যটন খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এখনো সময় আছে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার। প্রথমত, দায়ীদের প্রকাশ্যে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকা অপরাধীরা যদি পার পেয়ে যায়, তবে ভবিষ্যতে আর কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষিত থাকবে না। দ্বিতীয়ত, প্রশাসনিক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, জনগণকে সচেতন হতে হবে যে, সাদাপাথর শুধু নির্মাণসামগ্রী নয়, এটি আমাদের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য। পরিবেশ ধ্বংস হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষি, পর্যটন, জীববৈচিত্র্য ও স্থানীয় অর্থনীতি।
এই গণলুট শুধু পরিবেশগত বিপর্যয়ের ক্ষেত্রেই নয়, এটি রাজনৈতিক দুর্নীতি ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতীক। এই দায় কোনোভাবেই এড়ানো যাবে না। এখনই সময় কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার, দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করার এবং জনগণকে সক্রিয় করার। অন্যথায় ভোলাগঞ্জের মতো একের পর এক পর্যটনকেন্দ্র ধ্বংস হয়ে যাবে, আর আমরা হারাব আমাদের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ও ভবিষ্যৎ। মনে রাখা দরকার, সাদাপাথর কেবল ইট-পাথরের উপাদান নয়, এটি প্রকৃতির দান, সংস্কৃতির প্রতীক এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্পদ। ভোলাগঞ্জকে রক্ষা করা মানে কেবল একটি পর্যটনকেন্দ্র সংরক্ষণ নয়, বরং আমাদের ইতিহাস, ভূগোল ও আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ রক্ষা করা।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কবি এবং কথাসাহিত্যিক