১৯৮৭ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গঠিত ব্রান্টল্যান্ড কমিশন ‘আমাদের সাধারণ ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করলে বিশ্ববাসী ‘টেকসই উন্নয়ন’ নামক এক নতুন ‘উন্নয়ন ধারণার’ সঙ্গে পরিচিত হয়। যে অগ্রগতি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা ও পরিবেশ সংরক্ষণ নিশ্চিত করে এবং ভারসাম্য বজায় রাখে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকারের মধ্যে, কেবল তাকেই বলা যায় টেকসই উন্নয়ন। প্রকৃতপক্ষে ‘টেকসই উন্নয়ন’ অর্জনের জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত ও সামগ্রিক বৈশ্বিক উদ্যোগ; যা উন্নয়নের প্রতিটি খাত-উপখাতকে যেমন সম্পৃক্ত করবে, তেমনি বিস্তৃত হবে বিশ্বজুড়ে। আর তা অবশ্যই সমভাবে বাস্তবায়নযোগ্য হবে ধনী-দরিদ্র সব রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে।এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বৈষম্যমুক্ত পৃথিবী বিনির্মাণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ শীর্ষক এক যুগান্তকারী উন্নয়ন পথযাত্রার সূচনা করে। এসডিজিতে উন্নয়ন-সংশ্লিষ্ট ১৭টি লক্ষ্য এবং এসব লক্ষ্য-সংশ্লিষ্ট মোট ১৬৯টি টার্গেট নির্ধারণ করা হয়। উল্লেখ্য, ২০০০ সালে জাতিসংঘ গৃহীত ১৫ বছর মেয়াদি সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই প্রণীত হয় এসডিজি। বাংলাদেশের এমডিজি অগ্রগতি প্রতিবেদন-২০১৫ বিশ্লেষণে দেখা যায়, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ টার্গেট অর্জনে বাংলাদেশ যেমন তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য দেখিয়েছে, তেমনি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও দেশটি অগ্রবর্তী দেশগুলোর কাতারে শামিল হতে ইচ্ছুক। আর এ উদ্দেশ্যে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন ছাড়াও সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন সংক্রান্ত একটি বিশেষ অনুচ্ছেদ (অনুচ্ছেদ ১৮ক) সংযোজন করা হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮ক-তে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ কিন্তু অনুচ্ছেদ ১৮ক বাংলাদেশের সংবিধানের ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ ভাগে অন্তর্ভুক্ত। সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদের দফা-২-এ বর্ণিত বিধান অনুসারে ‘এই ভাগে (রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ভাগ) বর্ণিত নীতিগুলো বাংলাদেশ পরিচালনায় মূল সূত্র হইবে, আইন প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন, ...তবে এসব নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না।’ ফলে রাষ্ট্রের জীবনবিধানে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নকে প্রাধিকার প্রদানের পরও বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন পথযাত্রা অমসৃণ রয়ে গেছে।দুইসপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও এসডিজি বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস (বিবিএস) প্রকাশিত ‘Setting Priorities for Data Support to 7th FYP and SDGs: An overview' শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী এসডিজির ১৬৯টি টার্গেটের মধ্যে কেবল ৪৮টির বিষয়ে বিবিএসের কাছে সম্পূর্ণ বা আংশিক তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে ৬, ৯, ১১ ও ১৬নং এসডিজি সংশ্লিষ্ট সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ টার্গেট সম্পর্কিত প্রাথমিক তথ্য বিবিএস কর্তৃক সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। এবং ৭, ১২, ১৪, ১৫ ও ১৭নং এসডিজি সংশ্লিষ্ট টার্গেটগুলোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ থেকে বিবিএস কোনো তথ্যই সংগ্রহ করতে পারেনি। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী এসডিজি ৯ (শিল্পায়ন, উদ্ভাবন ও অবকাঠামো) ও এসডিজি ১২ (টেকসই উৎপাদন)-এর মতো তাৎপর্যপূর্ণ লক্ষ্যগুলো এখন পর্যন্ত জাতীয় অগ্রাধিকার প্রক্রিয়ায় যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের মতো অত্যন্ত জনবহুল এবং দ্রুত উন্নয়নকামী দেশের কাক্সিক্ষত টেকসই উন্নয়ন লাভের ক্ষেত্রে ওই লক্ষ্যগুলোর বাস্তবায়ন অপরিহার্য। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাস্তবতা বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে ভিন্ন। বাংলাদেশ একদিকে যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ, অপরদিকে ঘনবসতির দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। উপরন্তু, বাংলাদেশ বর্তমানে ‘তারুণ্য স্ফীতির’ (Youth Bulge) মতো একটি স্পর্শকাতর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। তারুণ্য স্ফীতি হচ্ছে এমন একটি অবস্থা, যখন একটি দেশের জনসংখ্যা কাঠোমোতে নির্ভরশীল মানুষের তুলনায় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা কাঠামোতে তরুণ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর (১৫-৬৪ বছর বয়সী) আধিক্যের এ ধারা শুরু হয়েছে ১৯৮০ সাল থেকে এবং চলবে ২০৩৫ থেকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত। এ তারুণ্য স্ফীতি জাতির সামনে একটি স্পর্শকাতর উন্নয়ন ক্ষেত্র উন্মুক্ত করেছে। সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিবেদনগুলোয় এ বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ যদি এ তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য যথোপযুক্ত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি সর্বোৎকৃষ্ট কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারে, তবে এ ‘তারুণ্য স্ফীতি’ রূপান্তরিত হবে ডেমোগ্রাফিক ডেভিডেন্ডে, যা দেশের জন্য বয়ে আনবে প্রভূত অর্থনৈতিক উন্নয়ন। অপরদিকে, এ তরুণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের ব্যর্থতা মারাত্মক বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতার বহুমাত্রিক কারণ সৃষ্টি করবে। তারুণ্য স্ফীতির এ ধারায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যে তিন দশক অতিক্রম করেছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, শিক্ষাক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণের আনুপাতিক ব্যবধানও অনেক হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু ‘শিক্ষার মান’ এখন শিক্ষার সর্বস্তরেই মারাত্মক প্রশ্নের সম্মুখীন।আমাদের শ্রমবাজারও সুসংগঠিত নয়। জাতীয় শ্রমশক্তি জরিপ-২০১৩ অনুযায়ী দেশের শ্রমবাজারে প্রতি আটজনে মাত্র একজন প্রাতিষ্ঠানিক কর্মে নিয়োজিত আছেন। তাই সার্বিক বিবেচনায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রত্যাশিত উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের পাশাপাশি শ্রমঘন ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের সম্প্রসারণ দেশের জন্য বরাবরই অত্যাবশ্যকীয় একটি বিষয়। তাই বাংলাদেশ তার প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা থেকেই শ্রমঘন ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের বিকাশের প্রতি জোর দিয়ে আসছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী ১৯৭২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সময়ে উৎপাদন শিল্পে গড়ে প্রায় ৫ শতাংশ হারে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে এবং ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধির হার ১০.৩২ শতাংশে পৌঁছেছে; কিন্তু উৎপাদন শিল্পের বিকাশকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যথেষ্ট কাঠামোগত সংস্কার সাধনে সক্ষম হয়নি। তাছাড়া, টেকসই উৎপাদনের বিষয়টিও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়নি। ফলে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন দেশে বহুমাত্রিক পরিবেশগত সমস্যার জন্ম দিয়েছে। উৎপাদন শিল্পের বিষাক্ত বর্জ্য আমাদের পানির প্রায় প্রতিটি উৎসকে দূষিত করে চলেছে। যদিও বিদ্যমান আইন অনুযায়ী রাসায়নিক বর্জ্য উৎপাদনে সক্ষম প্রতিটি শিল্প প্লান্টের জন্য Effluent Treatment Plant (ETP) স্থাপন বাধ্যতামূলক, তথাপি অধিকাংশ কারখানাই তাদের অপরিশোধিত বর্জ্য নদী বা অন্য কোনো জলাশয়ে নিক্ষেপ করছে। এভাবে অপরিকল্পিত শিল্পায়নের ফলে দেশের দুই শতাধিক নদী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শিল্প বর্জ্যরে দ্বারা দূষিত হচ্ছে, যা স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন এবং বিভিন্ন জলজ প্রাণীর অস্তিত্বকে করছে হুমকির সম্মুখীন।কিন্তু পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিপন্ন করে অধিক বাণিজ্যিক মুনাফা অর্জন কোনো যুক্তিতেই কাম্য হতে পারে না। অতএব আমাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিবেশগত দায়বদ্ধতা সৃষ্টির মাধ্যমে কাক্সিক্ষত সবুজ শিল্পায়ন বা টেকসই শিল্পায়নের প্রচেষ্টা এখন সময়ের দাবি। এ ক্ষেত্রে এসডিজি ৯-এর টার্গেট ৯.২-এর বক্তব্য অত্যন্ত সময়োপযোগী। কারণ এতে নিবিড় টেকসই শিল্পায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অপরদিকে পরিবেশবান্ধব শিল্পায়ন ক্ষেত্রে ‘পরিবেশ তথ্য প্রকাশ পদ্ধতির’ (Environmental Reporting/Sustainability Reporting) চর্চা যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশের বিষয়টি এসভিজি ১২-এর টার্গেট ১২.৬-এ বিশেষভাবে উল্লেখ করা হলেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তা অধিকাংশ এসডিজির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। প্রকৃতপক্ষে পরিবেশ তথ্য প্রকাশ পদ্ধতি হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পরিবেশ সংক্রান্ত কার্যাবলি তথা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কাঁচামাল, পানি ও জ্বালানির ব্যবহার, অপচয় এবং অপচয় রোধকল্পে গৃহীত উদ্যোগ, কর্মী নিরাপত্তা, পণ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর উৎপাদন প্রক্রিয়া ও উৎপাদিত পণ্যের প্রভাব এবং মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কাছে প্রকাশ করে থাকে, যা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ সংক্রান্ত কার্যাবলির প্রভাব সম্পর্কে জবাবদিহিতা বা দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করে। ফলে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ তথ্য প্রকাশ পদ্ধতির ব্যবহার ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নরওয়ে, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও চীনসহ বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যেই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পরিবেশ তথ্য প্রকাশ পদ্ধতির চর্চাকে বাধ্যতামূলক করে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করেছে। পরিবেশ তথ্য প্রকাশ পদ্ধতি সম্পর্কিত পলিসি ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক পরিস্থিতির ওপর UN Environment Program, KPGM International Ges Global Reporting Initiatives (GRI)-এর যৌথ উদ্যোগে ২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘Carrots & Sticks’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে বিশ্বব্যাপী ৬৪টি দেশে এ সংক্রান্ত ৩৮৩টি আইন বা বিধির উদ্ভব হয়েছে, যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই বাধ্যতামূলক।কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে পরিবেশ তথ্য প্রকাশ এখনও পর্যন্ত একটি ঐচ্ছিক বিষয়। কারণ দেশে বিদ্যমান পরিবেশ ও বাণিজ্যিক আইনগুলো এবং প্রচলিত হিসাবমানগুলোতে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে বা পর্যাবৃত্তভাবে (Periodically) পরিবেশ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশের বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ২০১৫’ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যে কোনো সময় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পরিবেশ সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য চাইতে পারে; কিন্তু এ আইনের মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যাদি নির্দিষ্ট সময় অন্তর বা পর্যাবৃত্তভাবে যেমন প্রকাশিত হয় না, তেমনি সাধারণ মানুষের জন্যও সহজলভ্য নয়। ফলে দেশের অতি অল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠান তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে যৎসামান্য পরিবেশ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে থাকে।সুতরাং বিদ্যমান বাস্তবতায় দেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘বার্ষিক প্রতিবেদন’ প্রকাশ পদ্ধতির সংস্কার প্রয়োজন। এ প্রেক্ষাপটে জাতীয় সংসদে ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে জনস্বার্থ সংস্থাগুলোর ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কার্যক্রমকে একটি সুনিয়ন্ত্রিত কাঠামোর আওতায় আনয়ন, হিসাব ও নিরীক্ষা পেশার স্ট্যান্ডার্ডস প্রণয়ন এবং এতদসংক্রান্ত অন্যান্য কার্যাবলি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে ‘দ্য ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল’ (এফআরসি) শীর্ষক একটি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং আইন ২০১৫’ গৃহীত হয়েছে, যা দেশে হিসাবরক্ষণ ও নিরীক্ষা পেশাগত কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা ও আর্থিক প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। যদিও এফআরসির গঠন কাঠামো, ক্ষমতা ও কার্যপরিধি নিয়ে এখন পর্যন্ত দেশের হিসাব ও নিরীক্ষা পেশা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)-এর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ রয়েছে। সরকারের উচিত হবে, আইসিএবির আমলযোগ্য পর্যবেক্ষণগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনী সাপেক্ষে দ্রুততম সময়ে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘বার্ষিক প্রতিবেদনে’ দেশের বিদ্যমান বাণিজ্যিক ও জাতীয় সংস্কৃতির বাস্তবতায় শিল্পভিত্তিক পৃথক পৃথক স্ট্যান্ডার্স প্রণয়ন নিশ্চিত করা। এসব স্ট্যান্ডার্স প্রণয়নকালে ‘পরিবেশ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের’ বিষয়বস্তু ও সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেশে কর্মরত পরিবেশবিদ, শিক্ষাবিদ এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের মতামত গ্রহণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পরিবেশ তথ্য প্রকাশ পদ্ধতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গাইডলাইন যেমন- ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন (আইএসও) ও জিআরআইয়ের স্ট্যান্ডার্ডগুলো বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। অবশ্য এ সংক্রান্ত ‘ব্যয়-মুনাফার’ (Cost-benefit) বিষয়টিও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। তাছাড়া বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশিতব্য পরিবেশ সংক্রান্ত তথ্যাবলির সঠিকতা ও নির্ভুলতা যাচাইয়ের জন্য এফআরসির উচিত হবে ‘পরিবেশ তথ্য নিরীক্ষা’ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় স্ট্যান্ডার্ড প্রণয়ন করা। আশা করা যায়, দেশের বর্তমান বাস্তবতায় বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশ তথ্য প্রকাশ পদ্ধতি চর্চার সংস্কৃতি সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে, যা টেকসই শিল্পায়ন তথা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও অত্যাবশ্যকীয়ভাবে প্রাসঙ্গিক।ড. মোহাম্মদ ফজলুর রহমান খান : সহকারী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, গাইবান্ধা সরকারি মহিলা কলেজ