ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না

অনেক ঢাকঢোল পিটিয়েও জাতীয় ঐক্য তো দূরের কথা একটি বৃহত্তর ঐক্যও করতে পারেননি ড. কামাল হোসেন, বিএনপি, আসম আবদুর রব এবং মাহমুদুর রহমান মান্না। ঐক্যে নেই বিকল্প ধারা। শেষ পর্যন্ত অসম্মানজনকভাবে ডা. বি চৌধুরীকে বাদ দিয়েই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হলো। সংবাদ সম্মেলনে  যে ৭ দফা এবং ১১টি লক্ষ্য ঘোষিত হলো তার সবকটিই বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোটের দাবির চাইতে আলাদা কিছু নয়। ডা. বি চৌধুরীও একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জামায়াত না ছাড়লে কোনো ঐক্য হবে না মর্মে জানিয়ে দিলেন। তবে অদূর ভবিষ্যতে কী হবে সেটি দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কেননা নির্বাচনের খুব কাছাকাছি সময়ে জোট গঠনে নানা দলের নানা হিসাব-নিকাশ ও বুদ্ধি-বিবেচনা কাজ করে। আপাতত যে ঐক্যফ্রন্ট হলো তাতে রাজনীতির নানা সমীকরণ ঘটলেও শেষ পর্যন্ত এই জোট কার্যকর কোনো দাবি আদায় করতে পারবে কিনা, তাদের তেমন কোনে সক্ষমতা আছে কিনা, সেটি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কেননা ফ্রন্টের সঙ্গে বড় দল একমাত্র বিএনপি। বিএনপি এবং ফ্রন্ট থেকে দাবি করা হয়েছে জামায়াতের সঙ্গে ফ্রন্টের কোনো ঐক্য হয়নি, তবে জামায়াত ২০ দলীয় ঐক্যজোটের শরীক দল হিসেবেই আলাদাভাবে অবস্থান করবে। এটি অনেকটাই অবুঝ শিশুদের বুঝ দেওয়ার মতন কথা। ড. কামাল হোসেন নানাভাবে পরিচিত ও আলোচিত হলেও রাজনীতিবিদ এবং সংগঠক হিসেবে তার সাফল্য নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। সে কারণে প্রশ্ন উঠেছে একেবারে শেষমুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে কেন এই অসার ঐক্যফ্রন্ট?


যেহেতু এই জোটের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেন, তাই গণমাধ্যমে বিষয়টিকে নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। সেটা এ কারণেও যে তিনি একসময় করতেন আওয়ামী লীগ, পরে তিনি গণফোরাম গঠন করে রাজনীতির মঞ্চে স্বতন্ত্র একটি ছোটখাটো ধারার জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি নিজেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন বলে দাবি করেন। ফলে তার নেতৃত্বে বিএনপির সঙ্গে ফ্রন্ট গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলে বিষয়টি সকলের কাছেই বিস্ময়কর এবং বেমানানও মনে হয়েছিল। তবে এটি বেশ গুরুত্ব পেয়েছিল ডা. বি চৌধুরী ও ড. কামালের সঙ্গে সরকারবিরোধী ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর থেকে। কিন্তু ঐক্যফ্রন্টের অন্য নেতাদের সম্পর্কে আলোচনা করার তেমন বিশেষ কিছু গণমাধ্যমের ও ছিল না, জনগণেরও আছে বলে মনে হয় না। কারণ আসম আবদুর রব কিংবা মাহমুদুর রহমান মান্না নেতা হিসেবে এই মুহূর্তে দেশকে নতুন কিছু দিতে পারবেন সেটি কেউ ভাবছেন বলে মনে হয় না। যদিও মান্না এই ঐক্যফ্রন্ট গঠনে অনেক বেশি দোড়ঝাঁপ দিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। ড. কামাল থাকার কারণে ফ্রন্টটি নিয়ে যতটা আলোচনা হচ্ছে তাতে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক অর্জন কতটা ঘটবে সেটিও দেখার বিষয়।


আগেই বলা হয়েছে যে, ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দল বিএনপি ছাড়া অন্য কোনোটিরই সাংগঠনিক ভিত্তি নেই, জনসমর্থনও নেই। ফলে বিএনপির এই ঐক্য কতটা ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারবে কিংবা আন্দোলন সংগ্রামে শক্তি জোগাবে সেটি নিয়ে সন্দেহ যথেষ্টই রয়েছে। ২০ দলীয় জোটকে বাদ দিয়ে বিএনপি ঐক্যফ্রন্টে আছে এমন ধারণা দেশব্যাপী বিএনপি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে বলে মনে হয় না। আবার ২০ দলীয় জোট ছাড়া বিএনপির শুধুমাত্র ফ্রন্টের উপর নির্ভর করে আন্দোলন সংগ্রাম কিংবা ভোট লাভে সাফল্য অর্জন করবে এমনটিও বাস্তবসম্মত নয়। ফলে বিএনপির জন্য এই ঐক্য কতটা লাভজনক হবে সেটিও দেখার বিষয়। তবে বিএনপি যে নেতৃত্ব-শূন্যতায় পড়েছে সেই দুর্বলতা প্রকাশিত হয়েছে। সেই দুর্বলতা ঢাকা দেওয়াটাও হয়ত ড. কামাল হোসেনের দ্বারস্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে। অন্যদিকে বিএনপি জামায়াতকে ছাড়া অতীতে যেমন জোটগত আন্দোলনে ছিল না, এখনও নেই। সেটি ইতোমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে। বিএনপি জামায়াতের নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোটারের হিসাবটি কখনই বাদ দেয়নি। তাছাড়া সাম্প্রদায়িক, স্বাধীনতাবিরোধী, জঙ্গিবাদী এবং আওয়ামী লীগবিরোধী সকল শক্তি বিএনপি ও জায়ামাতের ঐক্যকে যতটা আদর্শগতভাবে নিয়েছে, বিএনপি সেই হিসাবটিও বিবেচনায় রেখেছে। ফলে জনগণের মধ্যে ঐক্যফ্রন্ট গঠনে বিশেষ কোনো সাড়া পড়েছে বা সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা হয়ে উঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে— তেমনটিও মনে হয় না। ড. কামাল হোসেন গণফোরামকে দাড় করাতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন, তিনি নতুন ফ্রন্টে এসে সফল হবেন জামায়াত, বিএনপি তথা দক্ষিণ পন্থার শক্তির মাধ্যমে এটি স্বপ্নবিলাস ছাড়া আর কিছুই নয়। ড. কামাল জীবনের শেষ প্রান্তে দক্ষিণপন্থা ও উগ্রপন্থায় বিশ্বাসীদের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়ে কেন তার জীবনের এত বছরের রাজনৈতিক অর্জন বিসর্জন দিলেন সেটি অচিরেই হয়তো স্পষ্ট হতে শুরু করবে। তবে তিনি যেই জোট ও ফ্রন্টের ওপর সওয়ার হয়েছেন সেটি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান এবং জনগণের শাসনে বিশ্বাস করে না তা রাজনীতিসচেতন যেকোনো মানুষ বুঝতে পারেন। কিন্তু ড. কামাল হোসেন কেন এমন শক্তির মূল নেতা হতে গেলেন সেটি অনেকের কাছেই বোধগম্য নয়। সম্ভবত তার এতদিনের নিকট বন্ধ-ুবান্ধবও তার কাছ থেকে এখন দূরে থাকার চেষ্টা করছেন।


তবে যে বিষয়টি বাংলাদেশের রাজনীতির অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বলা যায় তা হচ্ছে, ঐক্য ফ্রন্ট গঠনের শুরুতেই যেসব নাটকীয়তা পরিলক্ষিত হয়েছে, যেসব ব্যক্তি এবং দল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ড. কামাল হোসেনকে সম্মুখে রেখে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে অনেকটা আকস্মিকভাবেই আবির্ভূত হয়েছে, তাতে বিষয়টিকে খুব সরল-সহজভাবে দেখা বা নেওয়া যাচ্ছে না। যদি জনগণের ভোটাধিকার, গণতন্ত্র এবং সুশাসন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট তিন-চার বছর আগ থেকে জনগণের কাছে যেত, কথা বলতো, প্রয়োজনে আন্দোলন ও সংগ্রামের কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকতো, সরকার যদি দমন-নিপীড়ন চালাতো তা হলে জনগণ দেখতো, বিদেশি বন্ধুরাও দেখতো তাহলে ঐক্যফ্রন্ট এখন যেসব ভালো ভালো কথা বলে সেগুলোর সঙ্গে তাদের আন্তরিকতার প্রকাশ ঘটতো। একটা রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা সকল মহলের কাছে প্রতিষ্ঠিত হতো। এটাই রাজনীতির সর্বজনীন পাঠ ও শিক্ষা। কিন্তু নির্বাচনের মাত্র তিন মাস আগে যেসব দল এবং ব্যক্তিকে পাশে বা পেছনে এমনকি নেপথ্যে রেখে ড. কামাল হোসেন ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছেন, তাতে হয় তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোনো না কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হতে যাচ্ছেন, নতুবা তিনি নিজেই সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হতে যাচ্ছেন।


সুতরাং বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার কিছু নেই, অস্বীকার করারও সুযোগ নেই। এবার সেই সব শক্তিই ড. কামাল হোসেনকে সম্মুখে রেখে হয় নির্বাচন প্রতিহত করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, নতুবা আবারও প্রশ্নবিদ্ধ কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের মহাসড়ক রচনা করার কৌশল আঁঁটতে পারে। অনেক অপশক্তিই পেছনে দাবার ঘুঁটির চাল হয়তো শুরু করে দিয়েছে। ১/১১ এর কোনো কোনো কুশীলবকেও এখন বেশ সক্রিয় ও সোচ্চার দেখা যায়। আবার কেউ কেউ রাষ্ট্রের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানকেই বিতর্কিত করতে গণমাধ্যমে বেসামাল উক্তি করছেন, লেখালেখি করছেন। চেষ্টা চালাচ্ছেন মানুষকে বিভ্রান্ত ও  বীতশ্রদ্ধ করার। এরপর হয়তো চরমপন্থার প্রয়োগও ঘটতে দেখতে হতে পারে। এবার শুধু নির্বাচনের আগেই নয়, পরের পর্বও মঞ্চস্থ করার ছক আঁটা হতে পারে। সে কারণে সবাইকে সতর্ক হতে হবে, কোনো অবস্থাতেই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ও কাঁধে ওঠা যাবে না। দেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথ হচ্ছে সংবিধানের গাইডলাইন অনুসরণ করা, সেপথে সরকার, রাজনৈতিক মহল এবং কমিশনকে চলতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে, বিতর্কে জড়ানো চলবে না। 


n লেখক :অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক





Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews