ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ফেসবুকে ৪৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিও শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে পাকিস্তান ইরানিদের জন্য তাদের স্থল সীমান্ত খুলে দিয়েছে। এটি একটি সম্পাদন করা ভিডিও। প্রকৃত তথ্য হলো, ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ শুরুর পর পাকিস্তান তাদের স্থল সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। এই ভিডিওটি বর্তমান সময়ের নয়। এটি পাকিস্তানের আরবাইন নামে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর ইরানের মধ্য দিয়ে ইরাকের কারবালার উদ্দেশ্যে পদযাত্রার ভিডিও। উল্লেখ্য, ইরাকের কারবালায় ইমাম হোসেনের মাজারে প্রতিবছর আরবি সফর মাসে যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়, তাতে পাকিস্তানের আরবাইন ধর্মীয়গোষ্ঠী অংশগ্রহণ করে থাকে।

গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যথা কমানো ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের একটি ওষুধ নিয়ে ব্যাপক ভুয়া প্রচার শুরু হয়। জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে ওষুধের প্রচারে প্রথম আলোর ওয়েবসাইট ও লোগো নকল করে অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহার নামে ভুয়া সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে সেঁজুতি সাহা সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন।

সম্প্রতি ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক লক্ষ্যবস্তুতে ইসরাইলের বিমান হামলার পর ফেসবুকে একটি ভিডিও শেয়ার করে দাবি করা হয়, এটি ইসরাইলের বিমান বাহিনীর পাইলটদের বিদ্রোহের দৃশ্য। এটি একটি ভুয়া ভিডিও। প্রকৃত তথ্য হলো, ২০২৪ সালের ৫ নভেম্বর সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সময় তেল আবিবের হাইওয়েতে বিক্ষোভকারীরা আগুন লাগিয়ে দেয় এবং সেই আগুন নেভাতে সীমান্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের এগিয়ে যেতে দেখা যায়।

উপরের তিনটি ঘটনাই সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। এর ভিউ ও শেয়ারের সংখ্যা ছিল প্রচুর। অপতথ্য এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। অপতথ্য এখন একটি ‘ইন্ডাস্ট্রি’ হয়ে উঠেছে। গণমাধ্যমের যেকোনো প্ল্যাটফর্মে অপতথ্য ঘুরে বেড়াতে থাকলে একসময় মানুষ ভাবতে শুরু করে, এর মধ্যে কিছু সত্যতা আছে এবং তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে। মানুষ দিন দিন প্রথাগত গণমাধ্যমের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে এবং সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে তথাকথিত ইনফ্লুয়েন্সাররা। সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে সবাই যেন সাংবাদিক হয়ে উঠেছে; সবাই নিজ নিজ মতামত পোস্ট করছে। এখানে গণমাধ্যমের যে দায়িত্ব বা নীতিমালা আছে, তা মানার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

অপতথ্য সব সময়ই খুব দ্রুত ছড়ায় এবং সঠিক তথ্যকে প্রভাবিত করে। যাদের হাতে ক্ষমতা ও অর্থ আছে, তারাই মূলত অসৎ উদ্দেশ্যে মানুষকে প্রভাবিত করতে অপতথ্য ও ভুল তথ্য ছড়িয়ে থাকেন। পরিকল্পিতভাবে অপতথ্য ছড়ানোর জন্য অর্থ বিনিয়োগ করা হয় এবং পেশাদার সংস্থা ভাড়া করা হয়। কারা এসব বিনিয়োগ করে এবং এর মাধ্যমে কী পরিমাণ আর্থিক বা সামাজিকভাবে লাভবান হয়, তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। সামাজিক বা রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে মানুষ দ্রুত তথ্য জানতে চায়। এই সুযোগে মানুষের পছন্দ-অপছন্দ, আবেগ-অনুভূতির সুযোগ নিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে অপতথ্য বা গুজব ছড়ানো হয়। আর যদি ওই অপতথ্য ব্যক্তির মতের সঙ্গে মিলে যায়, তবে সে দ্রুত সেটিকে বিশ্বাস করে এবং অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করে। গণমাধ্যমগুলো এখন ‘সেনসেশন’ খোঁজে, ফলে তারা দ্রুত ব্রেকিং নিউজ প্রচারে নেমে পড়ে। তথ্য যথাযথভাবে যাচাই না করেই অনেক সময় নিউজ প্রকাশ করে, ফলে অপতথ্য ছড়িয়ে পড়ে। নির্বাচন, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা ধর্মীয় কোনো ইস্যুর সময় এ ধরনের অপতথ্যের প্রবণতা বেড়ে যায়। বর্তমানে অপতথ্য ও ভুল তথ্যকে সারা বিশ্বেই বড়ো সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর ২০২৪-২৫ সালের ‘বৈশ্বিক শিক্ষা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে’ বলা হয়েছে, অনলাইনে পাওয়া তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করতে পারেন, এমন তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হার বাংলাদেশে ৫ শতাংশের বেশি নয়। অর্থাৎ, প্রতি ২০ জনে মাত্র একজন অনলাইনের তথ্য যাচাই করতে পারেন। ইরান ও ভিয়েতনামের অবস্থাও বাংলাদেশের মতোই। অপরদিকে, উন্নত দেশগুলোতে ৩৮ শতাংশ তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্ক অনলাইন তথ্য যাচাইয়ে সক্ষম।

তরুণদের তুলনায় বয়স্কদের মধ্যে ভুয়া তথ্য শেয়ারের প্রবণতা বেশি। ‘রিউমার স্ক্যানার’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত অভ্যুত্থানের পূর্বে গণমাধ্যমকে ঘিরে ১৯৯টি এবং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অভ্যুত্থানের পরে ১২৫টি ফ্যাক্টচেকের মাধ্যমে অপতথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। বিদেশি তিনটি ও দেশের ২৫টি, মোট ২৮টি গণমাধ্যমে এসব ভুয়া তথ্য প্রচারিত হয়েছে।

প্রযুক্তি সম্পর্কে স্বল্পজ্ঞান থাকায় অনেকে ভুল তথ্য বা অপতথ্য যাচাই করতে পারেন না। তবে ভুল তথ্য বিশ্বাস করার আগে কিছু সহজ কৌশলে যাচাই করা সম্ভব। যেমন—অখ্যাত বা ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তথ্যের পরিবর্তে মূলধারার গণমাধ্যমের ভেরিফায়েড পেজে গিয়ে খোঁজ নেওয়া, নিউজফিডে ভুয়া তথ্য দেখলে ‘না দেখানোর’ অপশন ব্যবহার করা এবং ফ্যাক্টচেকিং প্ল্যাটফর্মের সহায়তা নেওয়া।

অপতথ্য ছড়ানোর কিছু সাধারণ কৌশল রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মূলধারার সংবাদ এডিট করে প্রচার, যাতে মানুষ সহজে বিশ্বাস করে। যেমন, ২০২৩ সালের ৪ আগস্ট ‘দেশ রূপান্তর’ পত্রিকায় ‘সভা-সমাবেশে ভাড়াটে কর্মীদের রেট: পুরুষ ৪০০, নারী ৬০০’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই শিরোনামের আগে ‘বিএনপির’ শব্দটি যুক্ত করে তা সামাজিক মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছড়ানো হয়, ‘বিএনপির সমাবেশে ভাড়াটে কর্মীদের রেট: পুরুষ ৪০০, নারী ৬০০’। এ ছাড়া ভুয়া স্ক্রিনশট, গ্রাফিক কার্ডে কারসাজি, মিথ্যা উদ্ধৃতি, জনপ্রিয় ব্যক্তির নামে ভুয়া সাক্ষাৎকার প্রচার, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নেতার নাম ও ছবি ব্যবহার এবং টিভি সংবাদের টেক্সট সম্পাদনা করে অপতথ্য ছড়ানো হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় সংবাদ পাওয়ার প্রবণতা বাড়ায় প্রতারকরা এসব কৌশল কাজে লাগিয়ে লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম তাদের প্রতিবেদন সোশ্যাল মিডিয়ায় ফটোকার্ড আকারে প্রচার করে, যেখানে শিরোনাম বা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও উদ্ধৃতির সঙ্গে ছবি যুক্ত থাকায় তা সহজে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। মানুষ সাধারণত ভিজ্যুয়াল যুক্ত পোস্টকে টেক্সটভিত্তিক পোস্টের তুলনায় বেশি বিশ্বাস করে। এ সুযোগে প্রতারকরা বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে ছবি ও ভিডিও এডিট করে তাতে অডিও সংযুক্ত করে অপতথ্য ছড়িয়ে দেয়।

মিডিয়ায় মিসইনফরমেশন, ডিসইনফরমেশন বা ম্যালইনফরমেশন শনাক্ত করার কিছু কার্যকর পদ্ধতি রয়েছে। প্রথমেই যেকোনো সংবাদের তথ্য যাচাই করতে হবে। পুরো প্রতিবেদন পড়তে হবে, শুধু শিরোনাম দেখে বিশ্বাস করা যাবে না। শিরোনাম ও প্রতিবেদনের সামঞ্জস্য আছে কি না, তা খেয়াল করতে হবে। তারিখ দেখতে হবে; অনেক সময় পুরোনো খবর আবারও ফিডে চলে আসে। ভাষা ও বানান লক্ষ্য করতে হবে, কারণ অনেক ভুয়া পোর্টাল বা পেজে অসংলগ্ন ভাষা ও ভুল বানান থাকে। ইউআরএল (টজখ) পরীক্ষা করতে হবে, কারণ জনপ্রিয় সাইটের নামে এক বা একাধিক অক্ষর জুড়ে দিয়ে ভুয়া সাইট তৈরি করা হয় (যেমন নফহবংি২৪.পড়স এর স্থলে নফংহবংি২৪.পড়স)। সোশ্যাল মিডিয়া বা ইউটিউবের সংবাদের চেয়ে মূলধারার গণমাধ্যমে গুরুত্ব দিতে হবে। সংবাদ একাধিক সূত্র থেকে যাচাই করতে হবে। লেখকের পরিচয় ও ছবির ক্যাপশন খেয়াল করতে হবে। ভুয়া ভিডিও ও ছবিও যাচাই করা সম্ভব; এ জন্য কিছু পেইড ও ফ্রি অ্যাপস ও ওয়েবসাইট রয়েছে।

মিডিয়ায় মিসইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশন ছড়ানোর ফলে শুধু পাঠক বা দর্শক নয়, গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তাহলে এর থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী? বর্তমান বাস্তবতায় এর সহজ সমাধান নেই। প্রথমেই জনগণকে মিডিয়া সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিটি তথ্য যাচাই করে বিশ্বাস করতে হবে। বিশেষ করে স্পর্শকাতর তথ্যের ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। অপতথ্য মোকাবিলায় গণমাধ্যমের পাশাপাশি নাগরিক সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে স্কুল পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি ও ফ্যাক্ট চেকিং সংক্রান্ত পাঠ্যক্রম চালু করা যেতে পারে। অপতথ্য রোধে নাগরিক সমাজ ও সংশ্লিষ্ট প্ল্যাটফর্মগুলোকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, খাদ্য মন্ত্রণালয়।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews