অনেক মা বলে থাকেন, খাওয়ার সময় টিভি ছেড়ে না দিলে কিংবা মোবাইল হাতে না দিলে বাচ্চা খেতে চায় না। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
অনেক মা বলে থাকেন, খাওয়ার সময় টিভি ছেড়ে না দিলে কিংবা মোবাইল হাতে না দিলে বাচ্চা খেতে চায় না। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
শৈশব শব্দটি কানে এলেই মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে লাটিম, কানামাছি, বৌচি কিংবা বিকেলের রোদে দৌড়াতে থাকা কিশোরের ছবি। কিন্তু আজকাল ওই ছবি যেন বিবর্ণ, অস্পষ্ট। মোবাইলের স্ক্রিন আর মোটরবাইকের গর্জন যেন শৈশবের রং মুছে দিচ্ছে। শিশু-কিশোরদের জগৎ এখন কাচের পর্দায় বন্দী। সোশ্যাল মিডিয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা আর অনলাইন গেমের আকর্ষণে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের নিষ্পাপ হাসি ও কৈশোরের প্রাণবন্ততা।
এই যান্ত্রিক আসক্তির ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়ছে শিশুমনে। মানসিক অস্থিরতা, একাকীত্ব, শারীরিক দুর্বলতা, চোখের সমস্যা— এসবের পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত স্মার্টফোনে ডুবে থাকা এই প্রজন্ম ধীরে ধীরে ভুলে যাচ্ছে বাস্তব জগতের স্বাদ। এর মাঝে আরেকটি বিপদ যোগ হয়েছে— মোটরবাইক। কৈশোরের কাঁধে ভর করে ছুটে চলা বাইক যেন এক মৃত্যুর দৌড় প্রতিযোগিতা।
আজকের শিশুরা জন্মদিনে, ঈদে কিংবা ভালো ফলাফলের পুরস্কার হিসেবে মোবাইল পায়। কিন্তু ওই উপহারই একসময় হয়ে ওঠে তাদের ধ্বংসের কারণ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গেম, ইউটিউব, টিকটক— এসব তাদের বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। খেলার মাঠ, বইয়ের পাতা, পরিবারের সঙ্গে সময়— সবই হারিয়ে যাচ্ছে। তারা একাকী, অধৈর্য আর যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
গবেষণা বলছে, প্রি-স্কুলের ৮৬ শতাংশ শিশু স্মার্টফোন ব্যবহারে অভ্যস্ত, যার মধ্যে ২৯ শতাংশের রয়েছে মারাত্মক আসক্তি। গড়ে তারা দিনে ৩ ঘণ্টা স্ক্রিনে কাটায়, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশের প্রায় তিন গুণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোবাইল ও গেমের আসক্তি মাদকের মতোই মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। ভার্চুয়াল কনটেন্ট দেখার সময় ডোপামিন নিঃসরণ আসক্তি বাড়ায়। শিশুদের মস্তিষ্ক ডিভাইসের বিকিরণে অত্যন্ত সংবেদনশীল। তথ্যমতে, তাদের মস্তিষ্ক বড়দের তুলনায় দ্বিগুণ এবং অস্থিমজ্জা দশ গুণ বেশি বেতার তরঙ্গ শোষণ করে, যা টিউমারের ঝুঁকি বাড়ায়। চোখের রেটিনা ও কর্নিয়াও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
একইভাবে, কৈশোরে পা রাখতেই অনেকে মোটরবাইকের প্রতি আকৃষ্ট হয়। গতি আর রোমাঞ্চের নেশায় তারা ভুলে যায় দায়িত্বের কথা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) গবেষণা বলছে, এশিয়ার মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাংলাদেশ শীর্ষে। প্রতি ১০ হাজার বাইকে ২৮.৪টি দুর্ঘটনা ঘটে, যার ৭৪শতাংশ মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে। অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকদের বেপরোয়া গতি আর ট্রাফিক আইন না মানা এর পেছনে বড় কারণ।
প্রতিদিনের খবরের শিরোনামে থাকা ‘দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল তরুণের’, ‘স্কুলপড়ুয়া বাইক দুর্ঘটনায় নিহত’— এর পেছনে ভেঙে যাচ্ছে পরিবার, ছিন্ন হচ্ছে স্বপ্ন। অগণিত মা-বাবা আজও সন্তান হারিয়ে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেন, “বাইকটা কেন কিনে দিলাম?” অথচ তার আগেই হয়তো ওই সন্তান হুমকি দিয়েছিল— বাইক না পেলে আত্মহত্যা করবে। এই ভয়, এই জিম্মি করে চাওয়া— তা যেন অভিভাবকদের সামনে বিকল্পহীন এক চিত্র তুলে ধরে।
এই অবস্থা থেকে তাদের রক্ষা করা অসম্ভব নয়, বরং প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট, গঠনমূলক কিছু পদক্ষেপ:
প্রথমত, পরিবার থেকেই সচেতনতার সূচনা হওয়া প্রয়োজন। অভিভাবকদের উচিত শিশুর হাতে মোবাইল তুলে দেওয়ার আগে সেটির সীমাবদ্ধ ব্যবহার নিশ্চিত করা। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মোবাইল ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া এবং সময় পেরিয়ে গেলে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। বিকল্প হিসেবে শিশুদের খেলাধুলা, গল্পের বই, ছবি আঁকা, সঙ্গীতচর্চার মতো সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখা যেতে পারে। অভিভাবকরা যদি নিজেরাও প্রযুক্তির আসক্তি থেকে দূরে থাকেন, তাহলে সন্তানদের জন্য একটি ইতিবাচক উদাহরণ তৈরি হয়। স্মার্টফোন ও বাইকের মতো বিষয়গুলো নিয়ে সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করাও একান্ত জরুরি— কেন এটি ক্ষতিকর, তা যুক্তিসহকারে বোঝাতে হবে।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রযুক্তির দায়িত্বশীল ব্যবহারের বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। স্কুলে ডিজিটাল নিরাপত্তা ও প্রযুক্তি ব্যবহার বিষয়ে মাসিক সচেতনতা ক্লাস চালু করা যেতে পারে, যেখানে শিশুদের শেখানো হবে অনলাইন আসক্তির ক্ষতি, ভার্চুয়াল জগতের সীমাবদ্ধতা এবং বাস্তব জীবনের গুরুত্ব। পাশাপাশি বিদ্যালয়ে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করে বিকল্প কার্যক্রম যেমন— বিতর্ক, চিত্রাঙ্কন, নাটক, খেলাধুলা ইত্যাদি চালু রাখা দরকার, যাতে শিশুরা অফলাইনে নিজেদের প্রকাশের সুযোগ পায়।
তৃতীয়ত, কিশোরদের ক্ষেত্রে মোটরবাইক ব্যবহারের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা জরুরি। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ অভিভাবক নিজের ইচ্ছায় নয়, বরং সন্তানদের মানসিক চাপের কারণে বাইক কিনে দেন। তাদের মতে, যদি রাষ্ট্র একটি বয়সসীমার নিচে মোটরবাইক চালানোতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং প্রশাসন তা বাস্তবায়ন করে, তাহলে অভিভাবকরাও সন্তানের আবদার প্রতিহত করতে সক্ষম হবেন। রাষ্ট্রকে অবশ্যই ১৮ বছরের নিচে মোটরবাইক চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এই তো সেদিন, ১৭ মে রাজশাহী নগরীতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুই কিশোর নিহত হয়েছে। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) সংলগ্ন এলাকায় ঘটা এই দুর্ঘটনায় ঘটে বলে মতিহার থানার ওসি আব্দুল মালেক জানান। নাহিয়ান হাসান ও পিয়াসুর রহমান পিয়াস মারা যায়। ওদের দুজনেরই বয়স ছিল ১৭ বছর।
চতুর্থত, শুধু আইন করলেই চলবে না, সেটির প্রয়োগ নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। লাইসেন্সবিহীন বাইক চালালে কেবল চালক নয়, অভিভাবকদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনার নিয়ম প্রণয়ন করা উচিত। মহাসড়কে অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকদের চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে, বিশেষ করে মফস্বল অঞ্চলে, যেখানে ট্রাফিক নজরদারি প্রায় নেই বললেই চলে।
এছাড়াও রাষ্ট্রীয়ভাবে গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো যেতে পারে— টিভি বিজ্ঞাপন, নাটক বা তথ্যচিত্রের মাধ্যমে শিশু ও কিশোরদের ক্ষতির বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হলে অভিভাবকরাও সচেতন হবেন। একইসঙ্গে সমাজে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করতে হবে, যাতে শিশুদের সময় কাটানোর স্বাস্থ্যকর ও গঠনমূলক বিকল্প তৈরি হয়। স্থানীয় কমিউনিটি ক্লাব, পাঠাগার বা শিশু বিকাশ কেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে যেখানে তারা প্রযুক্তি ছাড়া নিজেরাই আনন্দ খুঁজে পাবে।
সবচেয়ে বড় কথা, শিশুকে নিয়ন্ত্রণ নয়— তাকে বোঝানো, ভালোবাসা দিয়ে তার পাশে থাকা এবং ধৈর্য ধরে সঠিক পথ দেখানোই দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে কার্যকর সমাধান। স্মার্টফোন ও বাইকের সঠিক ব্যবহার শেখানোই হবে টেকসই নিরাপত্তা— কারণ সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা নয়, সচেতনতা ও বিকল্প চর্চাই পারে শিশুদের রক্ষা করতে।
আমরা চাই না আর একটি মায়ের বুক খালি হোক। আমরা চাই না আর একটি কিশোর তার বাইকের সঙ্গে শেষ যাত্রায় রওয়ানা দিক। তাই এখনই সময় চোখ খুলে দেখার, সচেতন হওয়ার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপদ শৈশব ও কৈশোর নিশ্চিত করার। আসুন, আমরা শিশুদের হাতে হাতে তুলে দিই বই, খেলনা গাড়ি, আর মাটির গন্ধে ভরা বিকেল। কিশোরদের হাতে মোটরবাইক নয়— তাদের দিই সাহস, স্বপ্ন, আর জীবনকে উপলব্ধির বোধ।
অভিভাবক, সমাজ, রাষ্ট্র— সবাইকে একত্র হয়ে বলতে হবে: না, আর একটি জীবনও হারাতে দেব না।