বাংলাদেশের প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো কিন্ডারগার্টেন। অথচ দেশের শিক্ষা কাঠামোতে এর অবস্থান আজও অস্পষ্ট, অনিয়ন্ত্রিত এবং তদারকিহীন। ফ্ল্যাট, ছাদ বা দোকানঘরভিত্তিক স্কুলের ছদ্মবেশে চলছে ব্যাঙের ছাতার মতো অগণিত কিন্ডারগার্টেন। এই স্কুলগুলোর বেশিরভাগই শিক্ষা সম্পর্কিত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালার আওতায় নেই।
সরকারি মন্ত্রণালয় বা প্রশাসন এখনো এই স্কুলগুলোর তালিকাভুক্তি, নিবন্ধন বা মান যাচাইয়ের কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি। ফলে শিক্ষার নামে চলছে বাণিজ্য, শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা, নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে অযোগ্য শিক্ষক এবং শিক্ষার ছদ্মবেশে গড়ে উঠছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।
বর্তমানে বাংলাদেশের কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়েছে–বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য এমনটাই বলছে। অথচ এই বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের কোন সুনির্দিষ্ট তালিকা আজও সরকারের কাছে নেই। ২০১৬ সালে ৫৫৯টি টাস্কফোর্স গঠন করে কিন্ডারগার্টেনগুলোর তথ্য সংগ্রহ ও করণীয় নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও, গত ৯ বছরে এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি। স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং তদারকির অভাবে এই প্রক্রিয়া সফল হয়নি।
এই টাস্কফোর্সগুলো গঠিত হয়েছিল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে। উপজেলায় একটি, জেলায় একটি এবং বিভাগে একটি করে কমিটি করা হয়। তাদের কাজ ছিল প্রতিটি কিন্ডারগার্টেনের অবস্থা, পাঠ্যক্রম, শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি, সরকারি বইয়ের ব্যবহার এবং অবৈধ বেসরকারি বইয়ের প্রচলন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ। কিন্তু বছরের পর বছর চিঠি চালাচালির পরও মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদনও জমা পড়েনি। অথচ শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি মজবুত না হলে দেশের উন্নয়নের ভিত্তিও দুর্বল হয়ে পড়ে।
সরকার কিন্ডারগার্টেন বন্ধ করতে চায় না, এমনকি জনগণও তা চায় না। কেননা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা দেশের বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় খুবই সীমিত। দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী কিন্ডারগার্টেনে লেখাপড়া করে, যারা সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় না। তাই কিন্ডারগার্টেনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না, তবে সেই প্রয়োজনীয়তা নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় চলা এক অরাজক ব্যবস্থায় পরিণত হওয়াটা ভয়াবহ বিপদের ইঙ্গিত দেয়।
১৯৬২ সালের স্কুল নিবন্ধন আইনের আলোকে ২০১১ সালে সরকার একটি বিধিমালা করেছিল, যার আওতায় মাত্র ৩০২টি কিন্ডারগার্টেন স্কুল নিবন্ধন করে। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে নতুন করে উদ্যোগ নেয়া হলেও তদারকির অভাবে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। এমনকি ২০২৩ সালে সরকার ‘বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিবন্ধন বিধিমালা’ প্রকাশ করলেও, সারাদেশে মাত্র ৪০০টির মতো কিন্ডারগার্টেন পাঠদানের অনুমতি পায়। বাকিগুলোর মধ্যে অনেকেই আবেদন পর্যন্ত করেনি।
কারণগুলো আরও স্পষ্ট হয় মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের বক্তব্যে। পাবনার কিন্ডারগার্টেন স্কুল এডুকেশন সোসাইটির একজন সিনিয়র নেতা অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ কিন্ডারগার্টেন ফ্ল্যাট বাড়ি বা পাঁচ-ছয় রুমের বাড়ি ভাড়া করে পরিচালিত হয়। এসব স্কুলে নেই খেলার মাঠ, নেই শিশুদের উপযোগী পরিবেশ। শিক্ষার্থীদের বসার জায়গাটুকু পর্যন্ত পর্যাপ্ত নয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে নেই কোনো ব্যবস্থাপনা কমিটি। এছাড়া রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় গেলে প্রতিষ্ঠানকে সাধারণ ও সংরক্ষিত তহবিলে কিছু অর্থ জমা রাখতে হয়, যা তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ও জটিল বলে মনে করে তারা। তাই এই প্রক্রিয়ায় যেতে অনেকেই আগ্রহী নন।
অন্যদিকে, অনেকেই নিয়ম মেনে কাজ করতে চাইলেও সরকারি কর্মকর্তাদের গাফিলতিতে তা ব্যাহত হচ্ছে। ঢাকার কিন্ডারগার্টেন এডুকেশন সোসাইটির নেতা ফরিদ আহমেদ বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান নিয়ম মেনে চললেও, আবেদন জমা দেওয়ার পর বছরের পর বছর ফাইল আটকে থাকে। ফলে নিরুৎসাহিত হয় প্রতিষ্ঠানগুলো। পাবনার একাধিক কিন্ডারগার্টেনের প্রধান শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০১৭ সালে রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও নির্ধারিত ফিসহ আবেদনপত্র জমা দিলেও আট বছরেও কোনো অনুমতি পাননি তারা।
২০২৪ সালের ২৫ জুন তৎকালীন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহম্মদ এক বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন, দেশের অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন নিবন্ধনহীনভাবে চলছে। তিনি এক বছরের মধ্যে সব কিন্ডারগার্টেনকে নিবন্ধন ও শিক্ষাবিষয়ক স্বীকৃতির আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও এক বছর পার হতে চলছে এখনো বাস্তব কোনো অগ্রগতি নেই।
এই অব্যবস্থাপনা অবসানের জন্য প্রয়োজন বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। প্রথমত, রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া দ্রুত ও সহজ করতে হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের পরিবর্তে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের অধীনে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে। ছয় মাসের মধ্যে নিবন্ধনে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ ঘোষণা করতে হবে। পাশাপাশি রেজিস্ট্রেশনবিহীন স্কুলগুলোকে সরকারি পাঠ্যবই বরাদ্দ না দেয়া এবং প্রাথমিক সমাপনী বা বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না দেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আরও জরুরি একটি পদক্ষেপ হলো, নতুনভাবে কোনো প্রতিষ্ঠান চালু করতে হলে প্রথমে পাঠদানের অনুমতি নিতে হবে। এরপর শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি দেয়া যাবে। এভাবেই একযোগে সারাদেশে যে সমস্ত যোগ্য কিন্ডারগার্টেন রয়েছে, তাদেরকে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনা সম্ভব। পাশাপাশি অযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা যেতে পারে।
সরকার যদি এই রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াকে বাধ্যতামূলক করে এবং শিক্ষা কর্মকর্তাদের এক মাসের মধ্যে যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেয়, তাহলে কাউকে দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে না। যোগ্য প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পাবে, অযোগ্য প্রতিষ্ঠান নিরুৎসাহিত হবে।
এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে, প্রাথমিক শিক্ষার ওপর চাপ কমবে এবং শিক্ষার মান উন্নত হবে। শুধু শিশুদের ভবিষ্যৎ নয়, পুরো জাতির ভবিষ্যতের সঙ্গে যুক্ত এই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে আনতেই হবে। আর ওই দায়িত্ব নিতে হবে আজই। কারণ, কাল কাল করতে করতে অনেক দেরি হয়ে গেছে।