‘উন্নয়নের অভিযাত্রার দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’ শিরোনামে ১ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২৩-২৪ সালের প্রস্তাবিত যে বাজেট উপস্থাপন করেন, সেখানে শিক্ষা খাত নিয়ে শুরু এ বাক্য দিয়ে : ‘সকল স্তরে শিক্ষার মান বৃদ্ধি আমাদের বিশেষ অঙ্গীকার’।





অনুচ্ছেদটির শেষাংশে গুরুত্ববহ দুটি বাক্য : ‘আমাদের চাওয়া হলো বিজ্ঞানভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষতাবর্ধক, উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা সহায়ক এবং সেবার মানসিকতা, দায়িত্ব ও বিবেকবোধ জাগ্রত করার উপযোগী শিক্ষা প্রদান।

-আজকের শিশুরাই আমাদের উন্নত-সমৃদ্ধ-স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্নকে বাস্তকে রূপ দেবে। তাই শিক্ষার্থীদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতসহ যে কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সক্ষম করে তুলতে চাই।’

অর্থমন্ত্রীর উল্লিখিত বক্তব্য নিয়ে বিরূপ সমালোচনা চোখে পড়েনি। যেমনটি হয় বাজেট নিয়ে। সংসদে বাজেট বক্তৃতা শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে স্বপক্ষীয়দের ‘এ বাজেট জনকল্যাণের, এ বাজেট দরিদ্রবান্ধব, উন্নয়ন সহায়ক’ বলে প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিরোধীপক্ষের ‘এ বাজেট গরিব মারার বাজেট, দেশ পেছনে নিয়ে যাওয়ার বাজেট’ বলে গৃহীত নানা কর্মসূচি দেখতে আমরা দশকের পর দশক অভ্যস্ত।

এ অবস্থান থেকে সরে এসে নিরাসক্ত মূল্যায়নের অথবা দল করেও দলের ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় ভূমিকা পালনের মানসিকতা অথবা আধুনিক মননশীল চর্চা, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত। তবে এ বছর একাধিক মন্ত্রীর শিক্ষা ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চারিত মতামতগুলো বাজেট নিয়ে আলোচনায় ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।

আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বলপয়েন্টের ওপর উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, শিক্ষা উপকরণের ক্ষেত্রে বলপয়েন্টের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আছে। আমি আশা করি, এ বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে প্রস্তাব থাকবে, বলপয়েন্টের দাম যেন না বাড়ানো হয়। চলমান মেগা প্রজেক্টগুলো শেষ হলে শিক্ষাই দেশের মেগা প্রজেক্ট হবে বলে মনে করেন শিক্ষামন্ত্রী।

তিনি আরও বলেন, বাজেট বরাদ্দ প্রতিবছরই বাড়ছে। একই সঙ্গে আমাদের জিডিপির আকার তুলনামূলক অনেক বেড়েছে। সে হিসাবে হয়তো শিক্ষায় বরাদ্দ কিছুটা কমেছে। আমাদের যে মেগা প্রজেক্টগুলো চলছে, এগুলো শেষ হয়ে গেলে আশা করি, শিক্ষাই হবে আমাদের মেগা প্রজেক্ট। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমাদের এখন চ্যালেঞ্জ হলো বরাদ্দ সঠিকভাবে কাজে লাগানো। আরও যেটি দরকার, সেটি হচ্ছে গবেষণা।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গত বছরে এবং বিগত দিনে তাদের বরাদ্দ কাজে লাগাতে পারেনি। এ বছর তারা বরাদ্দ কাজে লাগাবে বলে আশা করছি। এদিকে প্রস্তাবিত ২ হাজার টাকার আয়কর ও অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের পক্ষে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান মত ব্যক্ত করেছেন বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।

আবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিকের মতে, স্বাস্থ্য খাতের বাজেটে বরাদ্দ কম রাখা হয়েছে। তারা তিনজনই মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর সহকর্মী। প্রস্তাবিত বাজেটে তাদের মতামতে বৈচিত্র্য লক্ষ করার মতো এবং গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে তা উৎসাহব্যঞ্জক বলতে হবে। অবশ্য কেউ কেউ এর ভিন্ন ব্যাখ্যাও দিতে পারেন।

বিশিষ্টজনরা ইতোমধ্যে বাজেটে শিক্ষা খাত ও আনুষঙ্গিক বিভিন্ন বিষয়ে যেসব অভিমত দিয়েছেন, তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উচ্চমাত্রার মূল্যস্ফীতি।

শুধু বাংলাদেশেই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ পুরো বিশ্ব অর্থনীতিতেই বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। যদিও উন্নত দেশগুলো নিজস্ব কৌশল প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতিকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ, আমাদের ট্যাক্স জিডিপি রেশিও খুবই কম। প্রস্তাবিত বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রহিত করায় তা দুর্নীতি রোধে সহায়ক হবে।

আগামী অর্থবছর থেকে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হচ্ছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ-এসব উদ্যোগ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ রাশেদা কে চৌধুরী বলেছেন, ‘শিক্ষা খাতের বাজেটে একটুখানি ভালো লাগার জায়গা হলো, মিডডে মিল (স্কুল ফিডিং কর্মসূচি) চালু করা হচ্ছে, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে।...শিক্ষানীতি, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, রূপকল্প-২০৪১ সরকারের নিজের।

কিন্তু শিক্ষার বরাদ্দে সেগুলোর প্রতিফলন দেখা যায়নি। পরামর্শ হলো, অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় যা বলেছেন, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে স্মার্ট নাগরিক, দক্ষ এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রসর জনগোষ্ঠী তৈরি করা। সেজন্য শিক্ষায় বিনিয়োগের বিকল্প নেই। সেটি নীতিনির্ধারকরা দেখবেন এবং বরাদ্দের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবেন, ভাববেন বলে আশা করি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম তারিক আহসান বলেন, ‘টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বাড়লেও মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় এ বরাদ্দ আশাব্যঞ্জক নয়। আবার শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি খাতের বাজেট একসঙ্গে হিসাব করে দেখানো হয়েছে। শিক্ষা খাতে এখন রূপান্তর হচ্ছে, এর ফলে যে পরিবর্তন আশা করি, তার জন্য বরাদ্দ আশাব্যঞ্জক নয়।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এম আবু ইউসুফ কারিগরি শিক্ষাকে শিল্পচাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করে এগোনোর পক্ষে।

তার মতে, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাজার উপযোগী কারিগরি ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক স্বল্পমেয়াদি কোর্স চালু এবং এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ তৈরির জন্য উপবৃত্তি ও ইনসেনটিভ দেওয়া যেতে পারে।’

এবারের বাজেট প্রস্তাবে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য বহুল প্রত্যাশিত এমপিওভুক্তি খাতে আলাদা কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি বলে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ৬ জুন সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরের অনুরূপ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

তবে বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল, সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে শিক্ষকদের পদোন্নতি বঞ্চিতদের পদোন্নতি, শিক্ষাক্ষেত্রে গ্রাম-শহর, সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূরীকরণ, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য কম্পিউটার ও ট্যাবসহ ডিজিটাল প্রযুক্তি সহজলভ্যকরণ এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের মতো বিষয় বাজেটে অনুল্লেখিত থাকায় সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে বলে সংবাদমাধ্যম ও শিক্ষক সংগঠন সূত্রে জানা যায়।

এ কথা সত্য, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের শিক্ষা খাতে ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা করা হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরে ২০২২-২৩ ছিল ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। তবে জিডিপি অনুপাতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের তুলনায় কমেছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির তুলনায় ১ দশমিক ৭৬ শতাংশের কথা বলা হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরে ছিল ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। তবে এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে তরুণ জনগোষ্ঠীকে গবেষণা ও উদ্ভাবনে উৎসাহ দিতে ১০০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ও তরুণ সমাজের দক্ষতা উন্নয়নের কথা উল্লেখ থাকলেও তাদের অনুকূলে কাঙ্ক্ষিত অর্থায়ন অথবা বরাদ্দ বিষয়ে তারা নিজেরা কতটা সন্তুষ্ট অথবা সহায়ক বলে মনে করেন তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে।

তবে একটি রাজনৈতিক সরকারের অবস্থান এবং জনপ্রিয় কর্মসূচি গ্রহণের অতীত দৃষ্টান্ত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা ধরে নিলে বাজেটকে উপলক্ষ্য করে রাজনৈতিক সরকার শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়াবেন কি না, এখনই তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। অথবা বিশেষ করে শিক্ষকদের প্রত্যাশা পূরণ না হলে শিক্ষক সংগঠনগুলো কীভাবে, কী পন্থায় প্রতিকূল অবস্থাকে অনুকূলে রূপান্তর করতে সক্ষমতা অর্জন করবেন, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। আমি আশাবাদী মানুষ। বিশ্বাস করি যে, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ যথাসময় যথোচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

এ লেখার শুরুর দিকে বিশিষ্টজনদের বক্তব্যগুলো স্বব্যাখ্যাত এবং সেসব তাদের অভিমত প্রতিফলিত করে। এ ক্ষেত্রে আমার মন্তব্য সমীচীন নয়। তবে কারিগরি শিক্ষাকে শিল্পচাহিদার সঙ্গে সমন্বয় এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাজার উপযোগী কারিগরি ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক স্বল্পমেয়াদি কোর্স চালু এবং এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ তৈরির জন্য উপবৃত্তি ও ইনসেনটিভ প্রদানের আমি পক্ষে।

কিন্তু বিষয়টির স্পষ্টায়ন দরকার। উচ্চশিক্ষার স্তরে কর্মমুখী শিক্ষা স্বল্পমেয়াদি কোর্সে সীমিত থাকবে কেন? ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ডেভরাই ও রিয়ারসানসহ কর্মসংস্থান নিশ্চিতকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রচুর। আমাদের দেশেও বৃত্তিমূলক বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাধা আমাদের মন-মানসিকতায়। আশার কথা, জাপান, কোরিয়ার মতো উচ্চশিক্ষার দেশে একাডেমিয়া ও শিল্প বাণিজ্য উদ্যোগে সহযোগিতা ও সমন্বয়ের কথা এখন দেশে অনেকের মুখে মুখে।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রচলিত উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী ছেলেমেয়ের এবং অধুনা তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের কয়জন শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থান নিশ্চিতের পক্ষে, আর কয়জন দক্ষতা অর্জনবিহীন তত্ত্বীয় জ্ঞান অর্জনে অগ্রাধিকার দিতে চান, তার তথ্যনির্ভর জরিপ ও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন সময়ের দাবি।

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর অন্যতম প্রণেতা; সদস্য, এডুকেশন ওয়াচ বাংলাদেশ

principalqfahmed@yahoo.com



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews