পড়াশোনা সিটি কলেজে। কিন্তু শ্রাবণী পোদ্দার খেলেছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হয়ে। কারণ তখন সিটি কলেজে খেলাধুলার প্রচলন ছিল না। মাদারীপুরে থাকতে স্কুলের হয়ে খেলতেন। শুরুটা অ্যাথলেটিক্স দিয়ে। তিন ভাই ও চার বোনের সংসারে শ্রাবণী ষষ্ঠ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা শেষে এখন শিক্ষকতা করছেন। এখন স্কলাস্টিকা স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক।
এদেশে নারী ফুটবলের পথচলা শ্রাবণীদের হাত ধরে। বাংলাদেশে নারী ফুটবলের আজকের অবস্থানে আসার পেছনের গল্পটা শোনান শ্রাবণী, ‘সারাক্ষণ খেলাধুলা নিয়ে মেতে থাকতাম। বাবা টেনশনে থাকতেন। ইনজুরি হলে কী হবে? হাত-পা ভেঙে গেলে বিয়ে দেবে কীভাবে। দুশ্চিন্তায় বাবার দিন কাটত। তবে মা সাপোর্ট দিতেন আমাকে।’
গল্পের শুরু ২০০৪ সালে। শ্রাবণীর কথায়, ‘কিছুদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স শেষ করেছি। সৃষ্টিকর্তা যে আমাকে বাংলাদেশের ইতিহাসের রূপকথার অংশ হিসাবে নির্ধারণ করে রেখেছিলেন, তা কী তখন জানতাম। পরবর্তীতে এ অর্জন আমার জীবনের সবচেয়ে বড় চমক। বড় হয়েছি প্রকৃতির সঙ্গে, ছুটে বেরিয়েছি মাঠে-ঘাটে, গাছে চড়েছি। ওই বছর খবর পেলাম বাংলাদেশ প্রথম আয়োজন করতে যাচ্ছে আমন্ত্রণমূলক মহিলা ফুটবল টুর্নামেন্ট। ছয়টি জেলা অংশ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করল। আমি ছিলাম ঢাকা জেলা মহিলা ফুটবল দলে। আমার খুশি আর উত্তেজনার অন্ত ছিল না। চোখে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। এরই মধ্যে সমালোচনা শুরু হয়। আমরা কীভাবে শর্টস আর জার্সি পরে মাঠে দৌড়াব, তা ছিল এক প্রশ্ন। একই সঙ্গে ভয় ছিল সমাজে আমাদের অবস্থান নিয়েও। আমাদের দেখা হবে অনেক নিচু চোখে, এমনকি বলা হলো আমাদের সঙ্গে কেউ মিশবে না, আরও অনেক কথা, অনেক ঝড় বয়ে গেল। স্বপ্নপূরণের ইচ্ছেটা এতটাই প্রবল ছিল যে, সমালোচনার সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এবং বৈরী পরিস্থিতি রুখতে শুরু করলাম কঠোর পরিশ্রম।’ শ্রাবণী বলেন, ‘সেসময় আমাদের কোচ ছিলেন ইউসুফ স্যার। প্রধান আয়োজক তখনকার বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদিকা কামরুন নাহার ডানা। এত প্রতিবন্ধকতাও যখন আমাদের টলাতে পারল না, তখন টুর্নামেন্টের কাছাকাছি সময়ে বিভিন্ন মহল থেকে চাপ আসতে শুরু করে। যেন আমরা না খেলি, মাঠে না নামি। আর যদি খেলি, তাহলে আমাদের কেউ সুস্থ অবস্থায় বাসায় ফিরতে পারবে না। ভয় না পেয়ে অনুশীলন চালিয়ে যাই। ততদিনে বুঝে গেছি যদি শুরু না করি, তাহলে হেরে যাব। হয়তো বাংলাদেশে আর মহিলা ফুটবলের শুরুই হতো না। আমাদের সাহস জুগিয়ে গেছেন ডানা আপা। যার ডানায় ভর করে ফুটবলে শুরু। ডানা আপার অবদান অসামান্য।’
স্কলাস্টিকা স্কুলের এই শিক্ষিকা যোগ করেন, ‘তিনি (ডানা) বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, স্বপ্ন ছাড়া কোনো কিছু পূরণ হয় না। তেমনি যুদ্ধ ছাড়াও অর্জন হয় না। সুতরাং, আমরা একেকজন যোদ্ধা। আমাদের জয়ী হতেই হবে। এই যাত্রা থামানো যাবে না। প্রতিজ্ঞা করলাম, যা হওয়ার হবে-আমরা মাঠে নামবই। প্রথম ম্যাচ বাংলাদেশ আনসারের বিরুদ্ধে। খেলার আগের দিন খবর এলো, যে বাসে আমরা মাঠে যাব, সেটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেবে। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে কোনো খেলা হবে না। আমরা যেন মহিলা কমপ্লেক্স থেকে বের না হই। এ খবর আমাদের সংকল্প আরও দৃঢ় করে তোলে। ডানা আপার নেতৃত্ব, সাহস আর আমাদের প্রচণ্ড মনোবল নিয়ে রওয়ানা হই। তখন আমাদের নীরব প্রতিবাদ ছিল তাদের বিরুদ্ধে, যারা আমাদের স্বপ্নপূরণের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাস্তায় প্রতিটা মুহূর্ত ভয়ে কাটছিল। তারপরও সাহস হারাইনি। সংকল্প ছিল ভয় পাব না, সাহস হারাব না, পিছু হাঁটব না, যা হওয়ার হবে। তখনো বুঝিনি এ যাত্রাটা ছিল ফুটবলে এক নতুন অধ্যায়ের যাত্রা। সৃষ্টিকর্তার রহমতে তেমন বড় কোনো অঘটন ছাড়াই আমাদের দল মাঠে গেল। দেশকে সম্মান জানিয়ে, লাইনে দাঁড়িয়ে সবার সঙ্গে করমর্দন করে হাততালির মধ্যে খেলা শুরু হলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে বললাম তোমাকে ধন্যবাদ, অবশেষে শুরু। খেলা যখন শেষের দিকে সবাই ভাবল খেলা ড্র। ঠিক তখনই গোলকিপারকে ফাঁকি দিয়ে গোল করলাম। আমাদের দল জয়ী হলো। তখনো জানি না যে, আমিই হব বাংলাদেশের মহিলা ফুটবল ইতিহাসের প্রথম গোলদাতা। বুঝতে পারি খেলা শেষে, যখন সাংবাদিকরা আমার পেছনে ছুটছিলেন। ওই গোলটির জন্য আমি ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলাম। ঘটনাবহুল টুর্নামেন্টে আমি হলাম সেরা খেলোয়াড়। আমার স্বপ্ন পূরণ হলো। ভাবতেই অদ্ভুত ভালো লাগে। তারপর আর মহিলা ফুটবল দলকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’
শ্রাবণী বলতে থাকেন, ‘এখন টুর্নামেন্টের আয়োজন করছে বাফুফে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য পাচ্ছে মহিলা ফুটবলাররা। স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু একটা স্থানে আমার ক্ষোভ-দুঃখ রয়ে গেছে। আমাদের সময় বাফুফে চাইলে পারত এ ধরনের টুর্নামেন্ট করতে; কিন্তু তারা তখন নিস্পৃহ ছিল মহিলা ফুটবল দল নিয়ে। এখনো বাফুফে সিনিয়র প্লেয়ারদের অবহেলা করে যাচ্ছে। বয়সভিত্তিক মহিলা ফুটবলে সফলতা আসছে; কিন্তু জাতীয় মহিলা ফুটবল নিয়ে তেমন টুর্নামেন্ট হচ্ছে না। নিয়মিত লিগ হচ্ছে না।’
সিনিয়র ফুটবলারদের প্রতি বাফুফের অনীহা নিয়ে শ্রাবণী বলেন, ‘একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের বাদ দিয়ে এমন লোকদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, যারা কখনোই খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। জায়গা করে নিচ্ছে স্বজনপ্রীতি বা বিশেষ ব্যক্তিদের অনুরোধ। বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দল যদি সত্যিকার অর্থে বিশ্ব পর্যায়ে আরও ভালো ফল করতে চায়, তাহলে এই সমস্যাগুলো খতিয়ে দেখা উচিত। তা না হলে আমাদের মাধ্যমে যে স্বপ্নের ডানা মেলেছিল, তা গুটিয়ে যাবে। সিনিয়রদের নিয়ে আরও কাজ করা উচিত। যোগ্যদের সুযোগ দেওয়া উচিত। তাহলে ২০০৪ সালে আমরা যে গল্পের শুরু করেছিলাম, তাতে যোগ হবে আরও অনেক রূপকথা।’