কড়া নাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আগামী ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচনী লড়াই। এ লড়াইয়ে একদিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প। অপরদিকে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেন। নির্বাচনের এই লড়াইয়ের মাঝেই শুরু হয়েছে নানা হিসাব-নিকাশ। তার মধ্যে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চারবছর সময়কালের কর্মকাণ্ডের হিসাবটা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।

বিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কেবল সেদেশের নেতা নন, তিনি সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি। তিনি যেসব কাজ করেন তার মধ্যদিয়ে পৃথিবীর অনেক কিছুই বদলে যায়। কম-বেশি সবার জীবনে প্রভাব পড়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্পও তার ব্যতিক্রম নন। প্রশ্ন হলো, ট্রাম্প তার সময়ে ঠিক কীভাবে বিশ্ব প্রেক্ষাপট বদলে দিয়েছেন?

আমেরিকাকে কীভাবে দেখে বিশ্ব?
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বারবার দাবি করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দেশ। কিন্তু সম্প্রতি পিউ রিসার্চ সেন্টারের ১৩ দেশের ভোটের জরিপে বলা হচ্ছে, ট্রাম্প বিদেশে ভাবমূর্তি রক্ষার মতো তেমন কিছু করতে পারেননি। অনেক ইউরোপীয় দেশে ট্রাম্পের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গত ২০ বছরে মধ্যে সর্বনিম্নে চলে গেছে।

বিজ্ঞাপন

জরিপে দেখা যায়, এসব দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যের মনোভাব সর্বোচ্চ ছিলো- ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে ফ্রান্সে ছিল ৩১ শতাংশ, যা ২০০৩ সালের পর সর্বনিম্ন এবং জার্মানিতে মাত্র ২৬ শতাংশ। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় আমেরিকার ভূমিকা সম্পর্কে ‍উত্তরদাতাদের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ মনে করেন, জুলাই ও আগস্টে ভাইরাস মোকাবেলায় কিছুটা ভালো পদক্ষেপ নিতে পেরেছে। এরপর পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল না। যার ফলে ভাইরাসের শীর্ষস্থান দখল করে যুক্তরাষ্ট্র। এরজন্য প্রধানত দায়ী মনে করা হয়- প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে।

জলবায়ু পরিবর্তনে হতাশাজনক পদক্ষেপ
জলবায়ু পরিবর্তনরোধে পদক্ষেপ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিশ্বাস কী তা অনুধাবন করা কঠিন। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনরোধে পদক্ষেপকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বিশ্বের ২০০ দেশের স্বাক্ষরিত প্যারিস চুক্তিকে তিনি ‘ব্যয়বহুল ফাঁকিবাজি’ বলে অভিহিত করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেই চুক্তিতে অসমর্থনের কথা ঘোষণা দেন।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ছয় মাসের মাথায় তিনি প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহার করে নেন। যা সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের হতাশ করে। প্যারিস চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ানোর পক্ষে ট্রাম্পের যুক্তি ছিল, এটি মার্কিন স্বার্থবিরোধী। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষাকারী একটি পরিবেশ চুক্তি করতে তিনি আগ্রহী। তবে সেটা যদি সম্ভব না হয়, তা নিয়ে প্রশাসনের কোনো উদ্বেগ নেই। সর্বাধিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমণকারী দেশগুলোর মধ্যে প্রথম চীন। আর তারপরই  দ্বিতীয় অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র।

গবেষকরা সর্তক করে বলেছেন যে, ট্রাম্প যদি দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তবে বৈশ্বিক উষ্ণতারোধ অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। তবে জো বাইডেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এই চুক্তিতে পুনরায় যোগদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বিধিনিষেধ ও সীমান্ত বন্ধ
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে সিরিয়া থেকে শরণার্থী আগমন এবং সাতটি মুসলিম দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আগমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে নির্বাহী আদেশ জারি করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এরপরই শুরু হয় নানা বিশৃঙ্খলা। আকাশপথে যুক্তরাষ্ট্রগামী বহু যাত্রীকে বাইরের বিমানবন্দরেই আটকে দেওয়া হয়। মুসলিম প্রধান সাতটি দেশের যাত্রীদের জন্য সীমানা বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমানে ১৩টি দেশ কঠোর ভ্রমণ বিধিনিষেধের শিকার যুক্তরাষ্ট্রে। যদিও ট্রাম্প এটাকে ভুল সংবাদ হিসেবে প্রচার করেন। তবে ২০১৯ সালের শেষের দিকে কঠোর অভিবাসন নীতি ট্রাম্পকে বিশ্ববাসীর কাছে আরেক ধাপ নেতিবাচক লোাকে পরিণত করে। বরাবরই অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর কথা বলেছেন ট্রাম্প৷ তাদের বিপজ্জনক ও হিংস্র অপরাধীও বলেছেন৷ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপকে তিনি অ্যামেরিকাকে শক্তিশালী করার পথ হিসেবে ব্যাখা করেছেন৷ তিনি এই পথে মহান আমেরিকা গঠনের স্লোগান দিয়েছেন৷ যুক্তরাষ্ট্রকে শক্তিশালী করে তুলতে দেশকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চান ট্রাম্প৷ এই নমুনা তার অনেক সিদ্ধান্তে মিলেছে৷ ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হ্রাস পায়। ২০১৬ অর্থবছরে ৮৫ হাজার শরণার্থী নিয়েছিল দেশটি। যা পরের বছর ৫৪ হাজারে নিচে নেমে আসে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ হাজার হয়ে যাবে। যা ১৯৮০ সালের পর সবচেয়ে কম।

বিজ্ঞাপন

সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষোদগার
মার্কিন প্রেসিডেন্টের মধ্যে সম্ভবত ট্রাম্পই প্রথম সংবাদ মাধ্যমের প্রতি প্রতিনিয়ত বিষোদগার করে গেছেন। তিনি প্রায়ই ‘ফেক নিউজ’ টার্ম ব্যবহারের মাধ্যমে সংবাদ মাধ্যমের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়েছেন। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ট্রাম্প অন্তত ২ হাজার বার ‘ফেক নিউজ’ টার্মটা ব্যবহার করেছেন বলে এক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জরিপে উঠে এসেছে। সংবাদ মাধ্যমে তার এ ধরনের বিষোদগার বিশ্ব গণমাধ্যমে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স, সৌদি আরব, বাহরাইনসহ বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যমে ‘ফেক নিউজ’ আসছে বলে সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ-অনুযোগ আসে ও আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়।

সিভিল সোসাইটিগুলো বলছে যে, বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদদের এই টার্মটির ব্যবহার গণতন্ত্রের পরিবেশ ক্ষুণ্ন করে।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্তহীন যুদ্ধনীতি ও মধ্যপ্রাচ্যে চুক্তি
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ট্রাম্প সিরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন যে, ‘মহান জাতি অন্তহীন যুদ্ধে লিপ্ত থাকে না’। তিনি সিরিয়ার তেলখনি রক্ষার জন্য শুধু ৫০০ সেনা রাখার সিদ্ধান্ত নেন। এছাড়াও আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। তালেবেনের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু করেন। যদিও সেনাবাহিনী ছাড়াই তিনি মধ্যপ্রচ্যে প্রভাব বিস্তারে পথ বেছে নিয়েছেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ট্রাম্প তেল আবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরিত করেন এবং অধিকৃত শহরটিকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন। গত মাসে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তি চুক্তির মধ্যস্থাতার মাধ্যমে ‘মধ্যপ্রাচ্যে নতুন ভোর’- বলে প্রশংসা করেন। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা এটিকে ট্রাম্প প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক অর্জন হিসেবে দেখছেন।

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য চুক্তি ও সংঘাত
চীন-যুক্তরাষ্ট্র বানিজ্যযুদ্ধ একাবিংশ শতাব্দীর আলোচিত ঘটনা। তীব্র বাক্যবাণে পরস্পরকে জর্জরিত করা, চরম উত্তেজনা কিংবা পিছু হটে ‘যুদ্ধবিরতি’র নরম সুর – এসব কিছুই দেখা গেছে দুই বছরের আমেরিকা-চীন বাণিজ্যযুদ্ধে। তবে দুই দেশের নেতারা এই যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প  যে চুক্তিকে বলেছেন, মার্কিন অর্থনীতিতে ‘পরিবর্তন ঘটানোর’ চুক্তি।

কিন্তু দুদেশের এই সম্পর্কের বেশিদিন টিকেনি। করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়লে তার জন্য চীনকে সরাসরি দায়ী করেন ট্রাম্প। করোনাভাইরাসকে চীনা ভাইরাস বলে প্রচারণা চালান তিনি এবং সরাসরি চীনকে আক্রমণ করেন। কথার বাণে বিদ্ধ করেন। আমেরিকায় চলমান বিভিন্ন চীনা অ্যাপস যেমন- টিকটক ও উইচ্যাটের বিরুদ্ধে তথ্য চুরির অভিযোগ এনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় এবং আরোপ করা হয় নানা শর্ত। শুধু এখানেই থেমে নেই। ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের ভাষণেও অভিযোগ আনেন। আর প্রতিপক্ষ জো বাইডেনকে চীনা লিডার বলে কটাক্ষ করেন।

ইরানের সঙ্গে যুদ্ধাবস্থা
ইরানকে বড় রকমের মূল্য দিতে হবে বলে হুমকির পরপরই ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানের সর্বাধিক শক্তিশালী জেনারেল কাসেম সুলাইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র।এরপর ইরানও পাল্টা হামলা চালায়। ইরাকে অবস্থিত আমেরিকান দুটি সেনা ঘাটিঁতে ২২টি ব্যালস্টিক মিজাইল নিক্ষেপ করে। এতে ১০০ এর বেশি মার্কিন সেনা আহত হয় । দুদেশের মধ্যে প্রায়ই ভয়াবহ যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করেছে সেসময়।

এরপর ট্রাম্প বলেন, কোনো রকম যুদ্ধ চায় না আমেরিকা। ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওসহ শীর্ষ জেনারেলদের নিয়ে নির্ধারিত সময়ের ৩০ মিনিট পর ট্রাম্প বক্তব্য শুরু করেন তিনি। বলেন, ইরাকে সামরিক ঘাঁটিতে হামলার পর বোঝা যাচ্ছে যে, ইরান তার অবস্থান থেকে সরে আসছে। ইরানের হামলায় কোনো মার্কিনি হতাহত হয়নি।

ট্রাম্প বলেন, গত সপ্তাহে আমরা বিশ্বের শীর্ষ এক সন্ত্রাসীকে সরিয়ে দিয়েছি। আমরা চাই ইরান সংঘাতের পথ পরিহার করে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নজর দেবে। যদি তারা শান্তির পথ বেছে না নেয় তাহলে দেশটির ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান এর শত্রুতা নতুন নয়। ১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লবের পর থেকে তার শুরু। সেসময় ইরানে মার্কিন সমর্থিত শাহকে সরিয়ে নতুন সরকার আসে ইরানে। এরপর থেকে শত্রুতা শুধু বেড়েছে। এর মধ্যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ শুরু করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার হুমকি দিয়েছে ইরানকে। অর্থনৈতিক অবরোধও জারি রেখেছে। কিন্তু ইরান নিজেদের পথ থেকে সরে দাঁড়ায়নি। তবে করোনাভাইরাস আঘাত করার পর উভয় দেশের রাজনৈতিক হুমকি-ধমকি হ্রাস পেয়েছে। এখন উভয় দেশই করোনার হুমকি সামলাতে ব্যস্ত। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতার লড়াইয়ে মরিয়া। আগামী নভেম্বরে ট্রাম্পের জয়-পরাজয়ই বলে দেবে, আগামীর বিশ্ব প্রেক্ষাপট কোন পথে চলেছে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews