যত্রতত্র চায়ের কাপে বাতাস তুলছে সম্প্রতি সংগৃহীত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বাংলাদেশের পাওয়া শর্তযুক্ত ঋণ সুবিধা। মোট পরিমাণ ৪৫০ কোটি ডলার। তুম ভি খোশ, হাম ভি খোশ– তুমি আর আমি নাচি আনন্দে। আইএমএফ খুশি, আমরাও খুশি । এক সময় ছিল যখন আইএমএফ কিংবা বিশ্বব্যাংকের শর্তযুক্ত ঋণ সুবিধা চায়ের কাপে রীতিমতো ঝড় তুলত– মিছিলমিটিং তো ছিলই। এখন তেমনটি নেই আছে উশখুশ- একটুআধটু আলোচনা -সমালোচনা । তবে শেষ কিস্তিতে কিস্তি দিয়ে বাজিমাত করলো আই এম এফ – আপাতত বাংলাদেশ ধরাশায়ী। কারণ , সরকারি কথাবার্তায় মনে হচ্ছে এ যেন জোর করে ঢেঁকি গেলানো ।
গল্পটা অবশেষে অরিন্দম কহিলা বিষাদের মতোই – বাংলাদেশ আইএমএফ এর শর্ত গিলতে বাধ্য হল। শর্ত দুটো হল (ক) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে আপেক্ষিক সুবিধার ভিত্তিতে আলাদা করা এবং (খ) বৈদেশিক বিনিময় হারকে বাজার-ভিত্তিক করা। তার মানে, ডলারের দাম নির্ধারিত হবে বাজারে ডলারের চাহিদা এবং যোগানের সেতুবন্ধনে। অবশ্য কদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আমাদেরকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, দরকার হলে আই এম এফ এর ঋণের কিস্তি নেব না তবুও কঠিন শর্তের কাছে মাথা নোয়াবো না। তারও আগে বলেছিলেন টাকা ছাপিয়ে ব্যাংক বাঁচাবো না কিন্তু তাই করতে হয়েছে বা করা ছাড়া উপায় ছিলও না গোলাম হোসেন!
প্রথম শর্তের প্রেক্ষাপট জানা দরকার। অভিযোগ আছে যে, প্রায় পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠিত এনবিআর কখনোই তাদের রাজস্ব লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। বর্তমানে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত প্রায় ৭ দশমিক ৪ শতাংশ, যা এশিয়ায় সর্বনিম্নের মধ্যে , বৈশ্বিক গড় ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ এর অর্ধেকেরও কম । শুধু তাই নয়, এই অনুপাতটি গেল এক দশক কিংবা তারও বেশি সময় ধরে একই অবস্থানে অথচ এরই মধ্যে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশের মধুচন্দ্রিমা উপভোগের জন্য আয়োজনের তোড়জোড়। যাই হোক, অর্থনীতির বিজ্ঞজন বিশেষত ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটি বলছে দেশের উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণে এই অনুপাত কমপক্ষে ১০ শতাংশে উন্নীত করা জরুরি।
কিন্তু গোল বাঁধায় রাজস্ব বোর্ডের প্রশাসনিক ও বাস্তবায়ন ক্ষমতা একই বিন্দুতে থাকবার ফলে এক ধরনের অদক্ষতার জন্ম দিয়ে দুর্নীতিকে আলিঙ্গন করা। বর্তমান, কিছুটা বিতর্কিতও, সিদ্ধান্তের মূল উদ্দেশ্য নাকি কর নীতিনির্ধারণ ও কর প্রশাসনকে আলাদা করা যাতে দক্ষতা বাড়ানো যায়, স্বার্থের সংঘাত কমানো যায় এবং দেশের করভিত্তি বিস্তৃত করা যায়। “এনবিআরের কাঠামোগত সংস্কার এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে গুরুত্বপূর্ণ। একটি প্রতিষ্ঠানকে একই সঙ্গে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিলে স্বার্থের সংঘাত ও অদক্ষতা তৈরি হয়। এটি একটি প্রতিষ্ঠিত মত।”
দুই.
এ বিষয়ে মতামত দেবার পূর্বে জাগো নিউজ এক প্রতিবেদনে রাজস্ব বোর্ডের সমস্যা চিহ্নিত করেছে যা হুবহু পাঠকদের জন্য পেশ করা যায়-
(ক) দীর্ঘদিনের সমস্যা
স্বার্থের সংঘাত
নীতিনির্ধারণ ও কর আদায় একই ছাতার নিচে থাকায় নীতিগুলো অনেক সময় দুর্বল হয়েছে এবং অনিয়ম ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে যারা কর আদায় করছেন, তাদের জন্য কোনো কার্যকর জবাবদিহি নেই। কর ফাঁকি দেওয়া করদাতাদের সঙ্গে তারা অনেক সময় ব্যক্তিগত স্বার্থে সমঝোতায় যান। কর কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতা পরিমাপের কোনো নিরপেক্ষ ব্যবস্থা নেই এবং তাদের পদোন্নতি বা মূল্যায়নও কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে হয় না।
অদক্ষ রাজস্ব আদায়
একই সংস্থার নীতি ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকায় দুই ক্ষেত্রেই মনোযোগ বিঘ্নিত হয়েছে। ফলে করের আওতা সংকীর্ণ রয়ে গেছে এবং সম্ভাবনা মতো রাজস্ব আদায় সম্ভব হয়নি।
দুর্বল শাসনব্যবস্থা
এনবিআরের এনফোর্সমেন্ট ছিল খামখেয়ালি, বিনিয়োগ সহায়তায় ছিল ঘাটতি এবং পুরো ব্যবস্থায় ছিল শাসনসংক্রান্ত ত্রুটি। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে এবং আইনের শাসন দুর্বল হয়েছে।
বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের প্রধান, একই সঙ্গে এনবিআরের প্রধান হওয়ায় দায়িত্ব বিভাজন পরিষ্কার ছিল না। এতে করনীতি তৈরিতে ও বাস্তবায়নে কার্যকারিতা ব্যাহত হয়েছে।
(খ) সংস্কারে কী ধরনের উন্নয়ন হবে
দায়িত্বের স্পষ্ট বিভাজন
রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন প্রণয়ন, হারে নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক চুক্তি নিয়ে কাজ করবে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ কর আদায়, অডিট ও অনুগততা নিশ্চিত করবে। এতে যারা করের নীতি ঠিক করবেন, তারা আর তা আদায় করবেন না। ফলে স্বার্থের সংঘাত ও দুর্নীতির সুযোগ কমবে।
দক্ষতা ও শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন
প্রতিটি বিভাগ নিজের দায়িত্বে মনোযোগ দিতে পারবে ফলে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে।
করভিত্তি প্রসারণ ও প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহ জোরদার
এ সংস্কার প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহে দক্ষ পেশাজীবীদের নিযুক্ত করার মাধ্যমে করের আওতা বাড়াবে এবং পরোক্ষ কর নির্ভরতা কমাবে।
উন্নয়নমুখী নীতি
একটি বিশেষায়িত নীতিনির্ধারণ বিভাগ প্রমাণভিত্তিক, দীর্ঘমেয়াদি ও উন্নয়নবান্ধব কর নীতি প্রণয়ন করতে পারবে।
বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি
স্বচ্ছ, পূর্বানুমেয় করনীতি ও পেশাদার প্রশাসন ব্যবসার পরিবেশকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলবে।
তিন.
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার দাবি দীর্ঘদিনের এবং তা যে অত্যন্ত জরুরি এতে কোনো সন্দেহ নেই। গেল দশকগুলোতে বাংলাদেশের উন্নয়নের কথা চিন্তা করলে কর- জিডিপি অনুপাত আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল। আবার কর- জিডিপি অনুপাতকে স্বীকার করে নিলে উন্নয়নকে অস্বীকার করা হয় যা নিতান্তই পাগলের প্রলাপ বই কিছু নয়। বাংলাদেশে
যে দেশ থেকে বছরে দুই লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়, ঋণ খেলাপি আরও দুই লক্ষ কোটি টাকা , যতজনের অন্তত একটা গাড়ি আছে ঠিক ততজনের টিন নাম্বার থাকার কথা, সে দেশের কর- জিডিপি অনুপাত এতো নিম্নে থাকে? সমস্যা দুটো- এক, মোট রাজস্ব যা হবার তা হয় না, দুই , রাজস্ব আহরণের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি যার সাথে কর দাতাও জড়িত । সুতরাং , একটা বৈপ্লবিক সংস্কারের পথে এই পদক্ষেপ বলে অনেকের বিশ্বাস।
কিন্তু কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। প্রথমত, এই সংস্কারের আগে রাজস্ব বিভাগের সাথে জড়িতদের মতামত নেয়া উচিত ছিল; দ্বিতীয়ত, আগে এক আমলার জায়গায় এখন দুই আমলা দুটো বিভাগ চালাবেন ফলে, কর-অভিজ্ঞ দক্ষতার ঘাটতি থাকতে পারে। তৃতীয়ত, দীর্ঘদিনের সুপারিশ অটোমেশন যথাযথ কার্যকর না হলে সমস্যা থেকেই যাবে এবং সবশেষে, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির অভাব যেন প্রতিফলিত না হয় এবং এ ক্ষেত্রে রাজস্ব বোর্ড সরাসরি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে না রেখে আলাদা এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাতে রূপান্তরিত করা যায় কিনা।
আমরা চলমান সংস্কারের সাফল্য কামনা করি এবং চাই করদাতার মধ্যে এমন ধারণা জন্মাক যে তিনি উন্নত পরিষেবার জন্য কর দিচ্ছেন কিংবা তার মঙ্গলের জন্যই তিনি কর দিচ্ছেন।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট। সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/এমএস