তারুণ্য জীবনচক্রের একটি ধাপ। এ পর্যায়ে একটি মানব সত্তায় শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশ ঘটে। এ সময়ে মানুষ শৈশব ও কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে উপনীত হয়। ব্যক্তি হিসেবে সৌন্দর্য, সৃজনশীলতা ও সক্ষমতায় পরিপূর্ণ হয়। তারা একটি সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখেন। একজন সক্রিয় সামাজিক সদস্যরূপে সমাজ জীবনে পূর্ণমাত্রায় অংশগ্রহণ করতে চান। জীবন যাপনের লক্ষ্যে কর্মসংস্থান চান। তারা চান মর্যাদাপূর্ণ ও শোভনকর্ম।

প্রাতিষ্ঠানিক কর্মের প্রতি তরুণসমাজের চাহিদা প্রবল। যে কর্মের সামাজিক মর্যাদা আছে। কিন্তু এরূপ শোভন কর্ম আমাদের দেশে অতি সীমিত, যা দেশের বর্তমান কর্মক্ষম তরুণের চাহিদা পূরণে অক্ষম। আবার প্রতি বছর শ্রমবাজারে প্রবেশযোগ্য তরুণের সংখ্যার তুলনায় প্রত্যাশিত মর্যাদাপূর্ণ কর্মক্ষেত্রের পরিমাণ অতি সামান্য। বর্তমান তরুণের প্রত্যাশিত কর্মচাহিদা ও বিদ্যমান কর্মক্ষেত্রের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য। তারা আত্ম কর্মসংস্থান, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী চর্চায় প্রত্যয়ী। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পরিবেশ অনুকূল নয়। তাই দেশের তারুণ্য সঙ্কট ও বেকারত্ব ক্রমে বাড়ছে; যা একটি রাষ্ট্রের অগ্রগতির পথে অন্তরায়।

তারুণ্যের স্বপ্ন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ও সুন্দর আগামী। যুবশক্তি দেশের সামগ্রিক জনশক্তির অভিচ্ছেদ্য অংশ। তাই তারুণ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। তাদের সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু দেশের তরুণরা আজ কর্মহীন, হতাশ ও বেকারত্বের বোঝা নিয়ে অলস সময় অতিবাহিত করছেন। যে বেকারত্ব বিবিধ সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করছে।

বেকারত্ব বর্তমান সময়ের একটি অন্যতম আর্থ-সামাজিক সমস্যা। এ সমস্যা বিশ্বব্যাপী বিরাজমান। সাধারণ অর্থে বেকারত্ব হচ্ছে কর্মহীনতা। বেকারত্ব সমাজের এমন এক অবস্থা; যে অবস্থায় কর্মক্ষম মানুষ কাজ করতে ইচ্ছুক। কিন্তু কর্মসংস্থানের অভাবে কর্মহীন থাকেন। এরূপ কর্মহীনরা দেশে বেকার হিসেবে বিবেচিত। এমন কিছু বেকার আছেন যারা প্রত্যাশিত কর্মের অভাবে কর্মহীন থাকেন।

যে কোনো দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হিসেবে ধরা হয় ১৫-৬৪ বছর বয়সীদের। বাংলাদেশে গত এক দশক ধরে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে, যা নতুন কর্মসংস্থানের তুলনায় অতি সামান্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে ২৬ লাখ ৬০ হাজার বেকার আছে। ২০২৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৬০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বেকার সংখ্যা বেড়েছে এক লাখ ৭০ হাজার।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) পরিচালিত বিশ্বব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এক দশকে দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েছে গড়ে দেড় শতাংশ হারে। একই সময়ে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র দশমিক ২ শতাংশ।

দেশে বর্তমান বেকার সংখ্যা কত? এ বিষয়ে তথ্যগত ভ্রান্তি আছে। বিবিএসের হিসাব মতে, গত এক দশকে বেকার সংখ্যা ২৫ থেকে ২৭ লাখের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ১৭ কোটির দেশে মাত্র ২৭ লাখ বেকার, যা বেকার সংজ্ঞা অনুযায়ী সত্য বটে। তবে সুধী মহলের কাছে এ সংখ্যা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ পছন্দসই কাজ পান না। তারা জীবনধারণে কোনো কাজে যুক্ত নন। তাদের অধিকাংশ নিষ্ক্রিয় তরুণ-তরুণী হিসেবে গণ্য। তাদের গড় বয়স ১৫-২৯ বছর।

২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য, ৯৬ লাখ ৪০ হাজার তরুণ-তরুণীকে নিষ্ক্রিয় হিসেবে গণ্য করা হয়। নিষ্ক্রিয় তরুণ-তরুণীরা অধ্যয়ন, প্রশিক্ষণ ও কর্মক্ষেত্র কোথাও নেই। তারা মূলত ছদ্মবেকার হিসেবে গণ্য। গত ১০ বছর ধরে এরূপ ছদ্মবেকার সংখ্যা এক কোটির মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। এ সংখ্যার সাথে প্রকৃত বেকার ২৭ লাখ যুক্ত করলে দেশে মোট বেকার সংখ্যা দাঁড়ায় এক কোটি ২৭ লাখ, যা বর্তমানে দেশের অন্যতম সঙ্কট।

দেশে প্রতি বছর ২০-২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন। তাদের এক-তৃতীয়াংশের দেশে কর্মসংস্থান হয়। সঙ্গত কারণে দেশের বর্তমান শ্রমবাজারের অবস্থা, কর্মসংস্থান চাহিদা ও কর্মচাহিদামাফিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ সম্পর্কিত আগাম তথ্য সরকারের পক্ষে প্রচার করতে হবে কর্মপ্রত্যাশীদের কাছে। যাতে তরুণরা দেশ-বিদেশের কর্মচাহিদা অনুযায়ী নিজেদের প্রস্তুত করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কর্মচাহিদা বিবেচনায় জনশক্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে কারিগরি ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো গতিশীল করা দরকার। প্রয়োজনে বিশেষ প্রণোদনায় তরুণদের কারিগরি কিংবা প্রযুক্তিগত শিক্ষায় যুক্ত করতে হবে।

ভবিষ্যৎ শ্রমশক্তিকে জানাতে হবে, যেকোনো প্রযুক্তিগত জ্ঞান নিশ্চিত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। এতে স্ব-কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা প্রবল হয়। যেমন : ফুড প্রসেসিং, খাদ্য গুদামজাতকরণ, বহুমুখী কৃষি খামার, পোলট্রি খামার, মৎস্য খামার, গবাদি খামার, পর্যটন শিল্প ও অন্যান্য ক্ষেত্রে তরুণদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান আবশ্যক। এরূপ প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কর্মক্ষম তরুণদের সচেতন করে তুলতে হবে। সেই সাথে শিক্ষিত তরুণদের আত্মকর্মসংস্থানমূলক কর্মে সম্পৃক্ত করতে হবে। তবেই তরুণদের সমৃদ্ধ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

আমাদের তরুণরা পেশা নির্বাচনে সামাজিক অগ্রাধিকারকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। বর্তমানে তরুণদের প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি ও সরকারি কর্মের প্রতি আগ্রহ প্রবল। বিবিএস জরিপ মতে, দেশে মোট শ্রমজীবীর মাত্র ১৬ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। আর ৮৪ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরতরা কর্ম স্থায়িত্ব, ছাঁটাই ও বেতন বৈষম্যের আতঙ্কে থাকেন। আবার দেশের জনসংখ্যার তুলনায় সরকারি চাকরির সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। সরকারি খাতে মাত্র সাড়ে ১২ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত। প্রতি বছর বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে মাত্র দুই হাজার এবং অন্যান্য সব মিলিয়ে দেড় লাখের মতো কর্মসংস্থান হয়। অথচ প্রতি বছর শ্রমবাজারে প্রবেশ করছেন ২২ লাখ তরুণ। তরুণসমাজ বাঁচার তাগিদে কর্ম চায়। কিন্তু মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই চাকরির সন্ধানে তারা দীর্ঘ কালক্ষেপণ করেন, যা দেশের তরুণ শ্রমশক্তির অপচয়। শোভন কর্মসংস্থানের প্রত্যাশায় হতাশাগ্রস্ত তারা। ছায়া বা প্রচ্ছন্ন বেকার হিসেবে সময় পার করেন বিপুল সংখ্যক তরুণ-তরুণী।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজের মজুরি না পেলে তাকে বেকার হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ সংজ্ঞা প্রযোজ্য নয়। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেকারত্বের ধরন ও প্রকৃতিগুলো হচ্ছে : মৌসুমি বেকারত্ব, প্রযুক্তিগত বেকারত্ব, ছদ্মবেশী বা প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব, সঙ্ঘাতজনিত বেকারত্ব, সামঞ্জস্যহীনতাজনিত বেকারত্ব, বাণিজ্য চক্রজনিত বেকারত্ব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত বেকারত্ব ইত্যাদি। অন্য দিকে আমদানি নির্ভরতা দেশের বেকারত্বের অন্যতম কারণ। আমদানি নীতি শিল্পের বিকাশ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ধ্বংস করে। তাই কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিকাশের স্বার্থে আমদানির পরিবর্তে সংরক্ষণ নীতি অবলম্বনের কথা বিবেচনায় আনতে হবে।

বর্তমান শ্রমবাজারে শোভন কর্মচাহিদা ও বেকারত্ব পরস্পরবিরোধী। প্রশাসনিক ও ক্ষমতার চর্চার সুযোগ বিবেচনায় কর্মপ্রয়াসী তরুণরা পেশা নির্বাচন করছেন। ব্রিটিশ-শাসিত এ দেশের বর্তমান তরুণ সমাজের মধ্যে ধ্যান ও ধারণাগত সংশয় রয়েছে। তারা শুধু ক্ষমতা, প্রভাব ও রাষ্ট্র শাসন করতে চান। দেশের সেবা, সমাজকল্যাণ ও উৎপাদনশীলতায় আগ্রহ খুব নয়, যা জাতীয় প্রবৃদ্ধি ও অগ্রগতির প্রতিবন্ধক। দেশের চলমান শিক্ষাব্যবস্থা কর্মসংস্থানবান্ধব নয়। তাই রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন চর্চা বন্ধ করতে হবে। কর্মসৃজনমূলক, প্রযুক্তিনির্ভর ও বৈশ্বিক কর্মচাহিদার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অ্যাকাডেমিক কোর্স চালু করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ অগ্রাধিকার বিবেচনায় ব্যাপক কর্মসংস্থানের রূপরেখা ঘোষণা করতে হবে। অন্যথায় দেশের তরুণসমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।

দেশে বেকারত্ব দূর হোক, শোভন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হোক। তারুণ্যের শক্তি জাতীয় অগ্রগতিতে কার্যকর শক্তিরূপে আবির্ভাব হোক। তারুণ্যের জয়যাত্রায় সমৃদ্ধ হোক প্রিয় বাংলাদেশ।

লেখক : অধ্যক্ষ, জাতীয় সমাজসেবা একাডেমি, আগারগাঁও, ঢাকা।
[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews