দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অবলোপনের হিসাব বাদে খেলাপি ঋণের পরিমাণ লাখো কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা।
ফলে গত মার্চ পর্যন্ত খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকায়। তবে অবলোপনসহ এর পরিমাণ আরও অনেক বেশি।
জানা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫৪ হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সব মিলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের এ চিত্র বাস্তবিকই উদ্বেগজনক। প্রশ্ন ওঠে, খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি কি কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়?
আমরা জানি, দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই অর্থমন্ত্রী খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ব্যাংকের টাকা জনগণের টাকা, এ টাকা নিলে ফেরত দিতে হবে।
সরকারি বা বেসরকারি যে ব্যাংক থেকেই ঋণ নেয়া হোক না কেন, ঋণের অর্থ ফেরত দিতে হবে। ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি বলেছিলেন, আজ থেকে খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না। কিন্তু এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, তিন মাসেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা।
এর কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে, ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয়ার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়ায় অনেকেই ঋণ পরিশোধ কমিয়ে দিয়েছেন। তারা ওই সুবিধা নিতে ঋণখেলাপি হয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত মে মাসের শেষদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণখেলাপিদের ছাড় দিয়ে নীতিমালা জারি করলে পরে আদালত তা স্থগিত করে দেন। কিন্তু ঋণখেলাপিদের জন্য বড় সুবিধা আসছে, তারা কম সুদে ঋণ শোধের সুবিধা পাবেন এমন ঘোষণায় অনেক নিয়মিত গ্রাহকও আর কিস্তি পরিশোধ করেননি। এছাড়া জালিয়াতির মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণগুলো এখন খেলাপি হয়ে গেছে। এসব কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
দেশে ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন ধরে নানা সমস্যা বিরাজ করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল উচ্চ খেলাপি ঋণ। মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুত খেলাপি ঋণ শুধু ব্যাংকিং খাতে নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেই ঝুঁকি তৈরি করছে।
মাত্রাতিরিক্ত খেলাপির প্রভাব পড়ছে ঋণ ব্যবস্থাপনায়। এ কারণে এগোতে পারছেন না ভালো উদ্যোক্তারা। ফলে বাড়ছে না বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। কাজেই খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। বিগত সময়ে দেখা গেছে, প্রভাবশালীরা ঋণ পুনঃতফসিল, ঋণ অবলোপন ইত্যাদির মাধ্যমে ঋণখেলাপির দায় থেকে মুক্ত থেকেছেন।
কিন্তু এর মাধ্যমে খেলাপি ঋণ সমস্যার স্থায়ী সমাধান আসেনি, বরং তাতে ঋণ আদায় প্রক্রিয়া আরও প্রলম্বিত হয়েছে। ফলে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ব্যাংকিং খাত।
এ খাত তথা সামগ্রিক অর্থনীতির স্বার্থে এমন নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে, যার মাধ্যমে ভালো গ্রাহকরা হবেন পুরস্কৃত এবং খারাপ গ্রাহক তথা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা হবেন তিরস্কৃত ও দণ্ডিত।
তাছাড়া ঋণ প্রদান ও আদায়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। বাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বন্ধ করতে হবে আইনি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা। আমরা এসব ব্যাপারে অর্থমন্ত্রীর দৃঢ় ভূমিকা প্রত্যাশা করি।