মার্কিন অর্থনীতিবিদ ডব্লিউ ডব্লিউ রস্টো উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে উড্ডয়ন (টেক অফ) পর্যায়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ১৯৮০ সালে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের তুলনায় সামান্য বেশি থাকলেও ২০১৬ সালে ভারত ও শ্রীলঙ্কা অনেক এগিয়ে গেছে। গণচীন ও ভিয়েতনামের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের তুলনায় ১৯৮০ সালে কম থাকলেও দেশগুলো ২০১৬ সালে বাংলাদেশকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। আবার ইথিওপিয়ার মাথাপিছু জিডিপি ১৯৮০ সালেও কম ছিল, ২০১৬ সালেও তা-ই আছে। অন্যদিকে ১৯৮০ সালে আফগানিস্তানের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশ থেকে বেশি থাকলেও ২০১৬ সালে দেশটি বাংলাদেশের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে গেছে। এখানে দেখা যাচ্ছে, উন্নয়ন উড্ডয়ন-প্রচেষ্টায় কোনো কোনো দেশ উড়াল দেয়; কেউবা কেবল নিম্নাকাশে বিচরণ করতে থাকে; আবার কেউ মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।


গত ২৬-২৯ নভেম্বর ইথিওপিয়া সরকারের জাতীয় বিদ্যুতায়ন কর্মসূচি উদ্বোধন এবং তা নিয়ে দুই দিনব্যাপী বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্কশপে যোগ দিয়ে আদ্দিস আবাবা ঘুরে এলাম। ইথিওপিয়া সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলের স্থলবেষ্টিত, জনবহুল, দরিদ্র একটি দেশ। বাংলাদেশের মানুষের কাছে ইথিওপিয়া এখনো দুর্ভিক্ষের জন্য পরিচিত। তা সত্ত্বেও ২০০৪ সাল থেকে দেশটি গড়ে প্রায় ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। সাম্প্রতিক কালে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। আমি আগেও ২০১১-১২ সালে দুবার আদ্দিস আবাবায় গেছি। এবার ফিরে এসে অনেক আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পড়া রস্টোর উন্নয়ন ও উড্ডয়ন-সংক্রান্ত ভাবনার কথা মনে এল। কেন মনে এল, তা-ই বলছি।

এক দিনেই ভিসা
আমার ভিসা ‘অন অ্যারাইভ্যাল’ হবে, নাকি আগেভাগে ভিসা নিয়ে যেতে হবে, তা নিয়ে কিছুটা গবেষণার পর স্থির হলো, আমাকে ভিসা নিয়ে যেতে হবে। যখন বিশ্বব্যাংক থেকে এই খবর পেলাম, তখন অনুষ্ঠানের আর সাত দিন বাকি, মধ্যে থ্যাঙ্কস গিভিংয়ের ছুটি। এমনিতেই পরিবার থেকে আফ্রিকায় যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহের অভাব ছিল। ভাবলাম, ভালোই হলো, এত তাড়াতাড়ি তো আর ভিসা পাওয়া যাবে না। যা-ই হোক, পরামর্শমতো ‘সেলফ-অ্যাড্রেসড এক্সপ্রেস ডেলিভারি এনভেলাপ’সহ ভিসার আবেদন ওয়াশিংটন ডিসিতে পাঠিয়ে দিলাম শনিবার, ১৮ নভেম্বর। রোববার দূতাবাস বন্ধ। সোমবার তারা আবেদনটি পাবে। বৃহস্পতিবার থ্যাঙ্কস গিভিংয়ের ছুটি। অনেকটা অসম্ভব ব্যাপার। না, কোনো তদবির ছাড়াই দূতাবাস আবেদনপত্রটি পেয়ে সেদিনই ভিসা প্রদান করে ডাকযোগে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। আমি তা মঙ্গলবার পেয়ে যাই।

ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনস
আমার টিকিট ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের ওয়াশিংটন ডিসি থেকে সরাসরি আদ্দিস আবাবা। ওয়াশিংটন ডিসি ছাড়াও উত্তর আমেরিকায় তাদের আরও তিনটি গন্তব্য আছে-নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস ও টরন্টো; দক্ষিণ আমেরিকায় গন্তব্য দুটি-সাও পাওলো ও বুয়েনস এইরেস; মোট যাত্রীগন্তব্য ৯৪টি আন্তর্জাতিক ও ১৯টি অভ্যন্তরীণ; পণ্যগন্তব্যের সংখ্যা ৩৫টি। বিমানবহরে আছে ৯৪টি সুপরিসর বিমান, যার মধ্যে সর্বশেষ বোয়িং ড্রিমলাইনার কয়েকটি। আফ্রিকার সেরা এই এয়ারলাইনস লাভজনক ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান এবং স্টার অ্যালায়েন্সের সদস্য। তাই যাওয়ার পথে ডালেস বিমানবন্দরে লুফথহান্সা ও টারকিশ এয়ারলাইনস-এ দুটির যেকোনো একটি লাউঞ্জ ব্যবহারের সুযোগ পেলাম। ইন-ফ্লাইট সার্ভিস অসাধারণ। চারজনের মধ্যে একজন বিমানবালা ঐতিহ্যবাহী ইথিওপিয়ান পোশাক পরে যাত্রীসেবা করছেন। আমাদের দেশের মতো কামিজ ও ওড়না। মেন ছাড়াও আছে ঐতিহ্যবাহী ইথিওপিয়ান রুটি ইনজেরা, সঙ্গে খাওয়ার জন্য মাংস ও সবজির তরকারি। সব মিলে যাত্রীসেবা সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের সমতুল্য। আমার পাশের সিটের যাত্রী একজন ইথিওপীয় আমেরিকান। নিজ জন্মভূমিতে পারমান্যান্ট সিটিজেন হয়ে স্বাস্থ্য খাতে ব্যবসা করছেন।

আমাদের জাতীয় এয়ারলাইনস বিমানের কথা খুব মনে পড়ল। বিমানের ভালো রুট আছে, অনুগত যাত্রী আছে এবং ভালো কিছু উড়োজাহাজ আছে। সঠিক নেতৃত্ব পেলে বিমান ঘুরে দঁাড়াতে পারে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিমান লাভের মুখ দেখেছিল।

ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস
আগে ২০১১-১২ সালে দুবার আদ্দিস আবাবায় এসেছিলাম। সেই তুলনায় বিমানবন্দরের আকার তিন-চার গুণ বেড়েছে। স্থানীয় সময় সকাল সাতটায় পৌঁছালাম। বিমানবন্দরে বেশ ভিড়। আগেরবার এসে ইমিগ্রেশনে বেশ সুবিধার মনে হয়নি। সেবার বেশ সময় লেগেছিল। এবার অবস্থা ভিন্ন। পাসপোর্ট নিয়ে ক্যামেরার সামনে ছবি তুলতে হলো। তারপর একটিমাত্র প্রশ্ন-কোথায় থাকছেন। হোটেলের নাম বলতেই পাসপোর্টে ছাপের শব্দ এবং হাসিমুখে ‘ওয়েলকাম টু ইথিওপিয়া’। সব মিলে এক মিনিট। ইমিগ্রেশন পার হয়ে কাস্টমস। এখানেও একটিমাত্র প্রশ্ন-কোথা থেকে এসেছি। যুক্তরাষ্ট্র, বলতেই হাত দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য ইশারা। কিছু কিছু ব্যাগেজ স্ক্যানারে পরীক্ষা হচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়াটিই প্রফেশনাল। ‘সরি’ ও ‘থ্যাংক ইউ’র ছড়াছড়ি সারা বিমানবন্দরে। মনে হলো আফ্রিকার ‘আদ্দিস আবাবা’ নয়, ইউরোপের কোনো নগরীতে এসেছি। পার্থক্য, কেবল স্থানীয় লোকগুলো কালো আদমি।

বিদ্যুৎ কর্মসূচি উদ্বোধন এবং বিশ্বব্যাংকের কর্মশালা
প্রধানমন্ত্রী হাইলেমারিয়াম দেসালেন কর্মসূচি উদ্বোধন করলেন। তারপর বক্তৃতা দিলেন পানি, সেচ ও বিদ্যুৎমন্ত্রী। দুটি বক্তৃতার ভাষাই ইথিওপিয়ার স্থানীয় ভাষা আমহারিক। বক্তৃতা শেষে আমার পাশে বসা ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ইয়াকব মুলুগেট্টাকে বক্তৃতাগুলোর তরজমা করতে বললাম। ইয়াকব জন্মসূত্রে ইথিওপিয়ান। তিনি আমাকে বুঝিয়ে বললেন। প্রধানমন্ত্রী তঁার বক্তৃতায় সরকারের সাফল্য নয়, বরং লক্ষ্য ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করলেন। বিদ্যুৎমন্ত্রী ড. সেলেশি বেকেলের বক্তৃতায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত সরকারপ্রধান অথবা কোনো প্রয়াত নেতার প্রশস্তি করলেন না; বরং তিনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতার কথা বললেন।

বিশাল বলরুমে অনুষ্ঠান শুরু হলো। ভাবলাম, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর নিশ্চয়ই কোনো ছোট রুমে বাকি ওয়ার্কশপ হবে। না, বিশাল বলরুমেই আলোচনা চলল। আমাদের ও অন্যান্য দেশের মতো অনুষ্ঠানস্থল শ্রোতাশূন্য, ফঁাকা নয়। সব সেশনেই উপস্থিতি ৯০ শতাংশের বেশি। ইথিওপিয়া ছাড়াও আফ্রিকার আরও ১৫-১৬টি দেশের প্রতিনিধি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আরও কিছু বিষয় লক্ষ করলাম। আফ্রিকানরা আমাদের তুলনায় বলেন কম, শোনেন বেশি এবং নিজেদের সমালোচনা শুনতে অভ্যস্ত। আমার বক্তব্যের পুরোটা সময় পানি, সেচ ও বিদ্যুৎমন্ত্রী সাধারণ শ্রোতা হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। গ্লোবাল অব গ্রিড লাইটিং অ্যাসোসিয়েশনের (গোগলা) পরিচালক জোহানা ডিকারকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আফ্রিকার অন্যান্য দেশে কাজ করলেও ইথিওপিয়ায় তঁারা কেন কাজ করছেন না? জবাবে তিনি ইথিওপিয়ার বিদেশি বিনিয়োগনীতির কড়া সমালোচনা করলেন এবং সবাই নিবিষ্ট মনে তা শুনলেন।

সাধারণ মানুষ ও পথঘাট
যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার ফ্লাইট রাত ১১টায়, তাই বিকেলে হঁাটতে বের হলাম। কিছুটা যেতেই, একটা মসজিদ পার হয়েই, চৌরাস্তায় কিছু দোকানপাট। একটা সেলুন দেখে পরিচ্ছন্ন মনে হলে চুল কাটানোর জন্য ঢুকে পড়লাম। স্থানীয় মুদ্রা না থাকায় অনুমান করে পঁাচ ডলার দিয়ে বের হয়ে এলাম। একজন আমাকে ডেকে ফেরত নিয়ে গেলেন এবং স্থানীয় মুদ্রা ১০০ ‘বিরর’-এর একটি নোট ফেরত দিয়ে ক্যালকুলেটরে বিনিময় হার দেখালেন!

ইথিওপিয়ার কফি খেতে বেশ ভালোই। ভাবলাম, কিছুটা নিয়ে যাই। পাশের মনিহারি দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের সবচেয়ে ভালো ব্র্যান্ডের কফি কোনটি? দোকানে অনেক রকম কফি আছে এবং ইথিওপিয়ার কফির ব্র্যান্ড সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই। মহিলা দোকানি আমাকে বললেন, সবচেয়ে ভালো ব্র্যান্ডের কফি তঁার দোকানে শেষ হয়ে গেছে। পাশের দোকানে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিলেন।

বিমানবন্দরে ফেরার পথে পথঘাটও কিছুটা দেখা হলো। আন্ডারপাসের দুপাশে উড়ালসড়ক। আবার আন্ডারপাসের ওপর দিয়েও আড়াআড়ি সড়ক। উড়ালসড়ক ছাড়াও মাথার ওপর দিয়ে এলআরটি যেতে দেখলাম। আমাদের দেশের তুলনায় পুরো ব্যবস্থাটি পরিকল্পিত এবং ট্রাফিক-বান্ধব বলে মনে হলো। ফেরার পথে বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা তল্লাশির সম্মুখীন হতে হলো।

কোনো দেশের একটিমাত্র শহরে তিন দিন থেকে এর অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ বোঝা সম্ভব নয়। আবার মনে রাখতে হবে, দু-তিন দিন থেকেই বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেন। ইথিওপিয়ার সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ। নীল নদের ওপর গ্রেট ইথিওপিয়ান রেনাইসান্স ড্যাম (জিইআরডি) তৈরি করে তারা এগিয়ে যেতে চাইছে। মিসর এতে বাগড়া দিচ্ছে। পরিবহন ও বিদ্যুৎ-ব্যবস্থায় বিপুল বিনিয়োগ করছে। ইথিওপিয়ার ভূরাজনীতি, একদলীয় গণতন্ত্র, সরকারি খাতের প্রাধান্য-এ ধরনের নানাবিধ সমস্যা আছে। তবু উন্নয়নের পথে উড্ডয়নের একটি সুস্পষ্ট প্রচেষ্টা ও শরীরী ভাষা এখানে দৃশ্যমান।
এম ফাওজুল কবির খান: সাবেক বিদ্যুৎ-সচিব ও উন্নয়ন অর্থনীতি বিশ্লেষক।
fouzul.khan@gmail.com



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews