পুলিশের দুই কর্মকর্তার অন্যায় কাজের জন্য বিব্রতকর অবস্থায় আছে পুলিশ বাহিনী। মিজানুর রহমান নামের ডিআইজি পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তা চল্লিশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে নির্দোষ সার্টিফিকেট নিতে চেয়েছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের কাছ থেকে। তিনি সফল হননি, কিন্তু  আলোচনায় এসেছেন। তার অতীত কীর্তিকাহিনি যা জানা যাচ্ছে, তা মোটেও পুলিশের গৌরব ও মর্যাদা বাড়ার অনুকূল নয়। আরেক পুলিশ কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেন। ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি। অপরাধ দমনের দায়িত্ব ছিল তার। তার ভয়ে অপরাধীদের পালিয়ে বেড়ানোর কথা। অথচ তাকেই গ্রেফতার এড়ানোর জন্য পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। অবশেষে আজ মোয়াজ্জেমকে শাহবাগ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মোয়াজ্জেম গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িয়েছেন। একজন মাদ্রাসাশিক্ষার্থীকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টা করেছেন মোয়াজ্জেম হোসেন।
মিজানুর এবং মোয়াজ্জেমের মতো সদস্য পুলিশ বাহিনীতে আর নেই, তেমন দাবি হয়তো পুলিশের পক্ষ থেকেও করা হবে না। তবে এমন সদস্যদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে যদি  আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা না যায়, তাহলে পুলিশের ভাবমূর্তির সংকট বাড়তেই থাকবে। দেশকে অপরাধমুক্ত রাখা, নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষা করার দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু পুলিশ সেই দায়িত্ব পালনে কতটুকু সৎ ও আন্তরিক, সে প্রশ্ন বহুদিন থেকেই উঠছে। কথা চালু হয়েছে,বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। পুলিশের বিরুদ্ধে মানুষ হয়রানির অভিযোগ কমছে না, বরং দিন দিন বাড়ছে। পুলিশ কেন দুর্নীতি ও অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে, সমস্যা কোথায় কোথায়, সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা এর জন্য কতটুকু দায়ী, তা খতিয়ে দেখা দরকার। রোগ-ব্যাধি হলে যেমন আড়াল বা গোপন করতে নেই, নিরাময়ের জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা নিতে হয়, তেমনি রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনও অঙ্গে সমস্যা দেখা দিলেও তা গোপন না করে, সমস্যা নিয়ে বসবাস না করে, তা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

পুলিশের বিরুদ্ধে মানুষের অভিযোগ আছে, ক্ষোভ-অসন্তোষ আছে। পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা-বিশ্বাস দিন দিন কমে আসছে। পুলিশের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপরাধে জড়ানোর অভিযোগ ক্রমবর্ধমান। এগুলো আর অস্বীকার করার উপায় নেই। অভিযোগ উঠলে তা ধামাচাপা দেওয়ার যে প্রবণতা চলে, তা বন্ধ করা দরকার।

পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমান দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে দুই দফায় চল্লিশ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। কেন তিনি ঘুষ দিলেন? এত টাকাই বা তিনি কোথায় পেলেন? তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন নয়। নারী নির্যাতনের অভিযোগে তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়েছিল। তারপরও তিনি কীভাবে পুলিশের উপমহাপরিদর্শকের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছেন? তার শক্তির উৎস কী? তার খুঁটির জোর কোথায়? এসব প্রশ্নের জবাব পুলিশ প্রশাসনের দেওয়া দরকার। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে যারা ‘আইনের লোক’ বলে পরিচিত, তাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, বেআইনি কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। আইন সবার জন্য সমান–এটা শুধু কথার কথা হলে চলবে না। দেশে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ, অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা যায় না বা হয় না।

ডিআইজি মিজান কেন দুদকের একজন পরিচালককে ঘুষ দিতে গেলেন? কারণ তার অবৈধ সম্পদের ব্যাপারে তদন্ত করছিল দুদক। তিনি যদি অবৈধ সম্পদের মালিক না হয়ে থাকেন, তাহলে তো তার ঘুষ দেওয়ার প্রশ্ন আসতো না। দুদক দুর্নীতিগ্রস্ত, দুদকের কর্মকর্তারা ঘুষ নিয়ে বা খেয়ে দুর্নীতিবাজদের সৎ মানুষের সার্টিফিকেট দেন–এটা প্রমাণ করার দায়িত্ব নিশ্চয়ই ডিআইজি মিজানের ওপর ন্যস্ত করা হয়নি। তিনি নিজে দুদকের কাছ থেকে সৎ মানুষের সার্টিফিকেট কেনার জন্যই টাকা দিয়েছেন দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে। কিন্তু টাকা নিয়েও তিনি ডিআইজি মিজানকে অভিযোগ থেকে রেহাই দিয়ে প্রতিবেদন না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ঘুষ দেওয়ার কথা ফাঁস করেন। দুদক যে ধোয়া তুলসিপাতা নয়–সেটাও বোঝা গেলো মিজান-বাছির কাণ্ডে। দুদকের প্রতিও নজর দিতে হবে। বেড়ায় ক্ষেত খায় বলে একটা প্রবাদ আমাদের দেশে চালু আছে। ভূতের ভয় থেকে রক্ষা পেতে হলে সরিষার ভূত আগে তাড়াতে হবে।

আমাদের সমাজে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। দুর্নীতি হয় না, এমন কোনও জায়গা এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাতারাতি এই অবস্থা তৈরি হয়নি। রাতারাতি এর থেকে মুক্তিও মিলবে না। সর্ব অঙ্গে ব্যথা হলে ওষুধ দেওয়াও কঠিন হয়। আমরা এখন সেই কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। শিক্ষাক্ষেত্রেও দুর্নীতির থাবা পড়েছে। ঘুষ ছাড়া কোনও চাকরি হয় না। পিয়ন-দারোয়ানের চাকরির জন্যও কয়েক লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। বড় বড় পদে নিয়োগ-বদলি-পদায়নের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে কোটি টাকা ঘুষ বিনিময়ের কথাও শোনা যায়। আগে দুর্নীতিবাজরা সামাজিকভাবে ঘৃণিত হওয়ার ভয়ে থাকলেও, এখন আর কোনও ভয়ডর নেই। মানুষ এখন টাকাওয়ালাদেরই কুর্নিশ করে, টাকা কীভাবে অর্জিত হয়েছে, কেউ আর সেটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দানধ্যান করে পুণ্যবান হওয়ার প্রবণতাও লক্ষণীয়। নীতিনৈতিকতার কথাও এখন বেশি উচ্চারিত হয় তাদের মুখ থেকে, যারা আকণ্ঠ অনৈতিকতায় জড়িত আছেন।

এই অবস্থাটা বন্ধ হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কথা বলেছেন। এই নীতি কার্যকর করতে হবে। কাজটা সহজ নয়। তবে অনেক কঠিন কাজই শেখ হাসিনা করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করেছেন। আত্মস্বীকৃত খুনিদের শাস্তি কার্যকর করেছেন। যারা বিদেশে পালিয়ে আছেন, তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারের আওতায় এনে কয়েকজনের দণ্ড কার্যকর করেছেন। এ কাজগুলো করা সম্ভব, এটা অনেকেই মনে করতেন না। ভারতের সঙ্গে বছরের পর বছর সীমানাবিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তিও তার দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। তার গতিশীল ও দূরদর্শী নেতৃত্বেই বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে নিজস্ব অর্থে। তার হাত ধরেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে–এটা কোনও অবাস্তব স্লোগান নয়, এটা বাংলাদেশের অগ্রগমনের অঙ্গীকারধ্বনি। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ দুর্নীতির কলঙ্কমুক্ত হতে পারবে বলে বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে।

এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হতে হবে। শরীরে ক্ষত নিয়ে বাইরে ফিটফাট থাকা কোনও ভালো লক্ষণ নয়। প্রধানমন্ত্রী নিজেও নিশ্চয়ই সেটা উপলব্ধি করেন। তাই  গত ১২ জুন জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি বলেছেন, অপরাধ করলে কেউ পার পাবে না। কোনও অপরাধে যদি তার দলেরও কেউ জড়িত থাকে, তাদেরও ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। শাসনটা ঘর থেকেই করতে হবে। কোনও দেশ যখন অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে উন্নত হয়, তখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে টাউট-বাটপাড় বা বিভিন্ন ধরনের লোক সৃষ্টি হয়। তাদের দমন করা শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে সম্ভব নয়, সামাজিকভাবেও করতে হবে। জঙ্গি, সন্ত্রাস, মাদক, যৌন নির্যাতন আর দুর্নীতি দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি শিক্ষক, অভিভাবক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান, জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের বিশিষ্টজনকে নিয়ে এলাকায় এলাকায় কমিটি করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর এসব কথার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ নেই। তবে বিতর্ক করার জন্য বিতর্কে না মেতে এখন সময় কাজ শুরু করার। টাউট-বাটপাড়দের দমন করতে হবে। কথা অনেক হয়েছে। সমালোচনা-নিন্দাও কম হয়নি। প্রধানমন্ত্রী যেমন বলেছেন—‘শাসনটা ঘর থেকেই করতে হবে’, এখন তার বাস্তবায়ন মানুষের কাছে দৃশ্যমান করে তুলতে হবে। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া আজকাল বড় কোনও অন্যায়-অনিয়ম-অপরাধ সংঘটিত হয় না। সরকারি দলের অনেকের বিরুদ্ধে নানা অপরাধের অভিযোগ আছে। তাদের বিরুদ্ধে একে একে ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হলে মানুষ আশ্বস্ত হবে। আর তা যদি না হয়, সব যদি শুধু কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে মানুষের মনে হতাশা দেখা দেবে। মানুষ হতাশ হয়ে পড়লে সরকার আর কোনও ভালো কাজে হাত দিতে পারবে না, ভালো কাজ করতে পারবে না।

লেখক: কলামিস্ট



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews