আলোকচিত্রী আশফিকা রহমানের অভিধানে ভয় শব্দটাই যেন নেই। তা না হলে আচমকা ঝড়ের মতো জীবনে আসা ক্যানসারকে হাসিমুখে সামলানো তো সহজ নয়! কম বয়সেই সাফল্যের ঝুলিতে জমেছে অনেক অর্জন। মনের জোরে জয় করেছেন ক্যানসারকেও। আশফিকার ক্যানসার জয়ের গল্প লিখেছেন তৌহিদা শিরোপা

আশফিকার ঘরের বারান্দা থেকে খোলা আকাশ দেখা যায়। বাতাসে দোল খায় জানালার সাদা–নীল পর্দা। পাঁচতলার বারান্দা থেকে বর্ষার শেষ বিকেলের ছাইরঙা আকাশ দেখতে দেখতে হঠাৎ বললেন, ‘আমার উচ্চতাভীতি আছে। উঁচু দালানের বারান্দায় দাঁড়ালে পা কাঁপে। কিন্তু পাহাড় বেশ ভালো লাগে। প্রাকৃতিক কোনো কিছুতে ভয় নেই।’

আসলেই আশফিকার জীবনের অভিধানে কোথাও ভয় শব্দটাই নেই। তা না হলে আচমকা ঝড়ের মতো জীবনে আসা ক্যানসারকে হাসিমুখে সামলানো তো কম নয়! আলোকচিত্রী আশফিকা রহমান। ৩০ বছর বয়সের আগেই সাফল্যের ঝুলিতে জমেছে অনেক অর্জন।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন মর্যাদাপূর্ণ ‘জুপ সোয়ার্ট মাস্টারক্লাস’–এর ফেলোশিপ, যা নেদারল্যান্ডসের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো ফাউন্ডেশন দ্বারা পরিচালিত হয়। বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই ফেলোশিপ পান। প্রতিবছর সারা বিশ্ব থেকে নির্বাচিত ১২ জন তরুণ সম্ভাবনাময় আলোকচিত্রী এই ফেলোশিপ পেয়ে থাকেন। দেশ–বিদেশের আরও অর্জন তো আছেই। আজকের গল্প আশফিকার জীবনের নতুন আরেকটি যুদ্ধজয়ের গল্প। যাঁরা এই মুহূর্তে নিজে বা কাছের মানুষটিকে নিয়ে ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস করছেন, আশফিকার গল্প তাঁদের জন্যই।আশফিকা রহমান। ছবি: অধুনা

চন্দ্রাহত দিনগুলো

এই তো গত জানুয়ারিতে আশফিকার অল্প সর্দি-কাশি হয়। ফেব্রুয়ারিতে ছবিমেলার কাজ। মার্চে যাবেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্ট ফেলোশিপে অংশ নিতে। তাই ভাবলেন, ‘সর্দি-কাশি হচ্ছে, সামনে এত কাজ, আবার বাইরে যাব, একটু শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নিই।’ তখন চিকিৎসকের পরামর্শে এক্স–রে, সিটি স্ক্যান করা হলো। রিপোর্ট হাতে নিয়ে ‍গুগল করে জানতে পারলেন ক্যানসারে আক্রান্ত। ক্যানসার যে রক্তে বাসা বেঁধেছে, সেটা তিনি তখনো বুঝতে পারেননি। ভেবেছেন, যেহেতু কাশি হয়েছিল, হয়তো ফুসফুসে কোনো সংক্রমণ। বায়োপসি করতে দিয়েছিলেন চেস্টে, তাই ব্যান্ডেজ করা ছিল। পরিবারের কাউকে তখনো কিছু বলেননি। একা রিপোর্ট নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন।

‘জানেন, জানুয়ারির ২২/২৩ তারিখ হবে। রিপোর্টটা নিয়ে আমি যখন রিকশায় উঠলাম ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য, হঠাৎ খেয়াল করলাম মাথার ওপরে মস্ত বড় চাঁদ। এত সুন্দর দেখাচ্ছিল চারপাশ। চাঁদের আলোয় ভেসে ভেসে যেতে ভাবছিলাম, আজকেই চাঁদটা এত সুন্দর দেখাচ্ছে কেন? তাহলে কি আমি মরে যাব। পরক্ষণেই মনে হয়েছে, আমি মরে যাব না।’প্রথম আলোর ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর িবশেষ ক্রোড়পত্র ‘তুমুল তারুণ্য’–এ ছাপা হয়েছিল আশফিকাকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদনচিকিৎসক রিপোর্ট হাতে নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন সঙ্গে কেউ এসেছে কি না? তাঁকে চমকে দিয়ে আশফিকা বললেন, ‘আমি একাই এসেছি আর জানি আমার ক্যানসার হয়েছে।’

চিকিৎসক জানালেন, কাশির কারণে মনে করা হয়েছিল ফুসফুসের কোনো সংক্রমণ, কিন্তু আসলে রক্তের ক্যানসার। তিনি আরেকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠালেন। তখনো আশফিকা তাঁর মা ও বড় বোন কাউকে জানাননি ক্যানসারের কথা। সেজেগুজে নতুন চিকিৎসকের কাছে গেলেন। আশফিকার মনে হতো, সাজগোজ করে ছিমছাম থাকলে হয়তো চিকিৎসক বলবেন যে তাঁর ক্যানসার হয়নি। সে সময় তাঁর মনে হচ্ছিল, কেউ একজন তাঁকে বলুক তাঁর রক্তে ক্যানসার নেই।

আশফিকার মনের অব্যক্ত চাওয়া বাস্তব রূপ পেল না। এই চিকিৎসকও আগের চিকিৎসকের কথাই পুনরাবৃত্তি করলেন। কলকাতার টাটা মেমোরিয়ালের একজন চিকিৎসকের নাম বললেন। সেখানে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। এই প্রথম আশফিকা তাঁর পরিবারকে জানানোর কথা ভাবলেন। চিকিৎসকের চেম্বার থেকেই প্রথম ফোনটি করলেন বড় বোন সেতুকে। পরেরটা মাকে। জীবনের নানা ঘাত–প্রতিঘাতে এই পরিবারের তিন সদস্যই মানসিকভাবে বেশ শক্ত। তাই ক্যানসারকেও তাঁরা স্বাভাবিকভাবে নিতে পেরেছিলেন। এক দিন পর আশফিকা একাই চলে গেলেন কলকাতায়। যাওয়া হলো না হার্ভার্ডে। ছবিমেলার জন্য কাজ জমা দিলেন। সেই কাজ প্রদর্শিত হলো ফেব্রুয়ারিতে।বড় বোন সেতুর সঙ্গে এভাবেই হেসেখেলে কেমোর দিনগুলো পার করেছেন তিনি

ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস

কলকাতায় প্রথম দিন কেটে গেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে করাতেই। রাতে হোটেলে ফিরে এই প্রথমবারের মতো কষ্ট চেপে ধরল আশফিকাকে। ‘সেদিনই মনে হয় প্রথম ও শেষবারের মতো আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল, কান্না পাচ্ছিল। বারবার মনে হয়েছে, কেন আমার সঙ্গেই কেন এমন হলো? আমি কেন?’

তবে কষ্ট ও ক্যানসার কোনোটাই আশফিকাকে কাবু করতে পারেনি। নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন। আশফিকা নিজেকে এভাবে বোঝাতেন, ‘কষ্ট পেলে তো আমি দুই দিন বেশি বাঁচব না। যত দিন বাঁচব আনন্দের সঙ্গে বাঁচব। এখানে দুঃখী হয়ে, কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। তখন মনে পড়ত, কার কার সঙ্গে শুধু কথা না বলে থেকেছি, রাগ করেছি। মনে হতো, সবাইকে ফোন করে কথা বলি। অন্যকে কষ্ট দেওয়া ও নিজে কষ্ট পাওয়ার জন্য এই জীবন খুব ছোট। লাইফ ইজ টু শর্ট টু বি স্যাড।’ গত ছয় মাসে আশফিকা যেন এই কথাকে মন্ত্রের মতো জপেছেন।

শুরু হলো কেমো নেওয়া আর নিজের কাজ করে যাওয়া। কেমোথেরাপির দিনগুলোতে এক দিনও বসে থাকেননি। প্রতিদিনই কাজ করেছেন। পিএইচএমের (ফটোগ্রাফিক মিউজিয়াম অব হিউম্যানিটি) সেরা ১২ জন নারী আলোকচিত্রীর তালিকায় ছিলেন। সামদানি আর্ট অ্যাওয়ার্ড ২০২০–এর জন্য নির্বাচিত তালিকায় এসেছেন। এখনো চূড়ান্ত তালিকার ফল আসেনি। এর মধ্যে প্যারিসের প্যালাইস ডি টোকিও গ্যালারিতে চলেছে আশফিকার প্রদর্শনীও।

আন্তর্জাতিক সাময়িকী জিও জামার্নিরজুন ২০১৯ সংখ্যায়, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নেদারল্যান্ডসের পাবলিকেশনে ও প্যালাইস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে আশফিকার লেখা, কাজের কথা। এমনও হয়েছে, দুটি কেমো দেওয়ার পরে ঢাকা আর্ট সামিট ২০২০–এর এই গবেষককে এক দিনের জন্য ঢাকায় আসতে হয়েছে। বিদেশি একটি দলের সঙ্গে সভা করে আবার কলকাতা। আবার কেমো। হাসতে হাসতে আশফিকা জানালেন গোপন একটি তথ্য, ‘গত ছয় মাসে আমি সবচেয়ে বেশি আয় করেছি। কাজের মধ্যেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। টাটা মেমোরিয়ালে আমার ক্যানসারের চিকিৎসক বলেছেন, ক্যানসার সারাতে ৫০ শতাংশ দরকার সঠিক চিকিৎসা ও ৫০ শতাংশ মনের জোর। আমার তো মনে হয় মনের জোরই আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। সব সময় মনে করেছি ক্যানসার তো আমার শরীরে, যা চিকিৎসা করলে সারবে, মনে তো ক্যানসার বাসা বাঁধেনি। সেখানে প্রবেশ নিষেধ এর।’ক্যানসারে আক্রান্তদের কাছে আশফিকা যেন দৃষ্টান্ত, এমনই বলেছেন চিকিৎসকেরা

আশফিকা যখন লেডি গাগা

কেমোথেরাপির সময় সারাক্ষণ তাঁর পাশে ছিলেন মা ও বোন। মা সমাজকর্মী ও বড় বোন মুম্বাইভিত্তিক মেকআপ আর্টিস্ট। ক্যানসার ধরা পড়ার সময় থেকে ক্যানসারকে বিদায় করা পর্যন্ত পুরো সময়টুকুতে কোনো দিন মা ও বোনকে কাঁদতে দেখেননি আশফিকা। এমনকি কেমোর সময়েও না। কেমোর পরে বেশির ভাগ মানুষ শকড হয়ে যায় যখন তাদের চুল পড়ে যায়। আশফিকাকে সেটি সহজ করে নিতে সাহায্য করলেন বড় বোন। বললেন, চুল পড়ে যাওয়ার পর পপতারকা লেডি গাগার মতো করে সাজিয়ে দেবেন তাঁকে। আশফিকা অপেক্ষায় থাকলেন কবে তিনি লেডি গাগা সাজতে পারবেন। এমন কেমোর রোগী সচরাচর দেখা যায় না। ব্যথাবোধ হয়েছিল কি না, আশফিকা ঠিক মনে করতে পারেন না। এই আলোকচিত্রীর ভাষায়, ‘আমি তো কেমোর সময় ভিডিও ইন্টারভিউ দিয়েছি। টানা পাঁচ দিনও চলত আমার কেমো। দুই বোন মিলে সাজগোজ করে মজা করেছি। নাচানাচি করেছি। আর আমি একসময় থিয়েটারে কাজ করেছি, নাচও করতাম। ফলে অভিনয় করে, নেচে বোনের সঙ্গে আনন্দ করতাম প্রচুর। যে নার্স বা ডাক্তারই আসুন না কেন, আমি হেসে বলতাম, গুড ডে। চুল পড়ে যাওয়ার পরও শাড়ি পরে সেজে ছবি তুলতাম। জীবনের অর্থ নতুন করে বুঝেছি। সবকিছুর একটা ভালো দিক থাকে, এই পৃথিবীতে কীভাবে বাঁচা উচিত, ক্যানসার আমাকে সেই শিক্ষা দিয়েছে।’ চালর্স বুকাওস্কির ‘অল দ্য ওয়ে’ কবিতাটি সারাক্ষণ পড়তেন। এটা পড়লে একাকিত্ববোধ হয় না আশফিকার। এই পুরো সময়ে আরেকটি জিনিস সঙ্গী ছিল, তা হলো অলটারনেটিভ ফিলোসফির বই চাক ক্লস্টারম্যানের বাট হোয়াট ইফ উই

আর রং?

ছয়টি কেমোর পর আশফিকা যখন ক্যানসারমুক্ত হলেন, টাটা মেমোরিয়ালের চিকিৎসকেরা আশফিকাকে বললেন অন্য ক্যানসারের রোগীদের সামনে নিজেকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করতে। যাতে তাঁরা অনুপ্রাণিত হন।

ছবি তোলা, প্রদর্শনী করা—সবকিছু ছাপিয়ে আশফিকা আরেকটি ব্যতিক্রম উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন। ময়মনসিংহে একটি বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করছেন, যেখানে এতিম ছেলেমেয়েরা বৃদ্ধদের দেখাশোনা করবেন—যে বৃদ্ধরা সব হারিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকেন অসহায় নিঃস্বভাবে। কিন্তু এটা পরিচালনার জন্য অনেক টাকা দরকার, কারও মুখাপেক্ষী হয়ে যেন বৃদ্ধদের থাকতে না হয়, তাই তিনি একটি রেস্তোরাঁ চালু করেছেন দুই বছর হলো। রেস্তোরাঁর লাভ থেকে পরিচালিত হবে বৃদ্ধাশ্রম। আশফিকা ভাবনায়–কাজের চিন্তায়, সব সময়ই অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি বলেন, ‘আমি বেঁচে থাকি বা না থাকি, এই বৃদ্ধাশ্রম চলবে। পৃথিবীতে যে কটা দিন বাঁচব, পৃথিবীকে, দেশকে, মানুষকে কিছু একটা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।’

আশফিকার একটা ছোট সুন্দর নাম আছে—শুভ। তাঁর নামের মতোই শুভ করে তুলবেন চারপাশকে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews