চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রথম মাস জুলাইতে কিছুটা বাড়লেও আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে কমছে রপ্তানি আয়। এই অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এটি আগের বছরের একই সময়ের চেয়েও কমেছে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

বৃহস্পতিবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

রপ্তানির সার্বিক পরিস্থিতিকে ‘খুবই খারাপ’ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন উদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদরা। তারা রপ্তানি আয় বাড়াতে ডলারের দাম বাড়ানো, নগদ প্রণোদনা বাড়ানো ও নতুন নতুন বাজার খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন। একই সাথে বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম কমানো ও পণ্য পরিবহন ব্যয় ও ঋণের সুদ হার কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যথায় সামনে আরো বড় ধাক্কা খাবে রপ্তানি আয়।

ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথম ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সব ধরনের পণ্য রপ্তানিতে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয় ১ হাজার ৮০৫ কোটি ডলার। কিন্তু এ সময়ে আয় হয়েছে ১ হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ কম। একই সঙ্গে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি অর্জিতের হার ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ কম।

একক মাস হিসাবে চলতি বছরের নভেম্বরে রপ্তানি আয় হয় ৩০৫ কোটি ৫৮ লাখ ডলার, কিন্তু লক্ষ্য ছিল ৩৭২ কোটি ২০ লাখ ডলার। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় নভেম্বরে রপ্তানি আয় কমেছে ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ। এ ছাড়া একক মাস হিসাবে প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে ১৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। গত বছরের নভেম্বরে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৩৪২ কোটি ১৯ লাখ ডলার।

রপ্তানি আয় আশঙ্কাজনক হারে কমছে উল্লেখ করে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমএইর সভাপতি রুবানা হক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পোশাক খাতে রপ্তানি আয় প্রবৃদ্ধি কমেছে ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এর মধ্যে নিটওয়ারে ৬ দশমিক ৭৯ এবং ওভেনে ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কমেছে। এছাড়া নভেম্বরে পোশাক রপ্তানি কমেছে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস থেকে নভেম্বর মাস পর‌্যন্ত টানা কমেছে পোশাক রপ্তানি আয়। এর আগে এইভাবে টানা ৪ মাস পোশাক রপ্তানি কমেছিল ২০১১-১২ অর্থবছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত। এটি চিন্তার বিষয়।

“চলতি অর্থবছরে সরকার রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ১১ দশমিক ৯১ শতাংশ নির্ধারণ করে। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার মানে হলো- এই শিল্পের প্রতিযোগিতা সঙ্কটাপন্ন। বিশ্বের অন্যান্য প্রতিযোগী দেশগুলোর সাথে পেরে উঠতে পারছি না।”

বিশেষ করে প্রতিযোগী দেশগুলো ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান কমালেও ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমানো হয়নি। গত বছরের ডিসেম্বরে শ্রমিকদের মুজরি বাড়ানোর পর অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান তিনি।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারের সর্বশেষ তথ্য তুলে ধরে রুবানা হক বলেন, এই দুটি বাজারের অভ্যন্তরীণ তথ্যমতে, চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জলাই-সেপ্টেম্বর) প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে। এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৭০ শতাংশ; যেখানে ভিয়েতনামের ১৪ দশমিক ২৩, ভারতের ৩ দশমিক ৯৩, কম্বোডিয়ার ১৫ দশমিক ৫৬, পাকিস্তানের ৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নেও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ভাল হয়নি; মাত্র শুন্য দশমিক ৯০ শতাংশ। অথচ এই বাজারে তুরস্কের প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৯৮, ভিয়েতনামের ২ দশমিক ৮৮ এবং শ্রীলঙ্কার ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে জানান তিনি।

রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ডলারের দাম বৃদ্ধি, নগদ প্রণোদনাসহ এখনি সরকারকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে হবে বলে মনে করেন এই পোশাক খাতের এই নেতা।

ইপিবির তথ্যমতে, এই সময়ে মোট রপ্তানি আয়ে পোশাকের অবদান প্রায় ৮৩ শতাংশ। তবে হোমটেক্স, টেরিটাওয়েলসহ এ খাতের অন্যান্য রপ্তানির উপখাত হিসাব করলে তৈরি পোশাক খাতের অবদান ৮৫ শতাংশে দাঁড়াবে। তাই তৈরি পোশাকের রপ্তানি কমলে তার প্রভাব পড়ে পুরো রপ্তানি খাতে।

রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশই আসে পোশাক খাত থেকে। কিন্তু নভেম্বর শেষে এই খাতে আয় হয়েছে ১ হাজার ৩০৮ কোটি ৮৬ লাখ ৯০ হাজার ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ কম। এই সময়ে রপ্তানি প্রবৃদ্ধিও কমেছে ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। পোশাক রপ্তানি কমায় মোট রপ্তানিতে এর প্রভাব পড়েছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ও বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কেন্দ্রীক। কিন্তু ইইউ’র অর্থনৈতিক অবস্থা এখন মন্দা। ইইউ’র দেশগুলোতে পণ্যের চাহিদা কিছুটা কমেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি কিছুটা ভাল রয়েছে এখনো। সেখানে প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক কিন্তু শেয়ারের পরিমাণ অনেক কম। কাজেই কম শেয়ারে প্রবৃদ্ধি ভাল হলেও খুব বেশি সুবিধা হয় না রপ্তানিতে।

তিনি বলেন, পণ্যের দাম কমে গেছে। বাংলাদেশে রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনা হয়নি। বলতে গেলে একটা (তৈরি পোশাক) পণ্যের রপ্তানি আয় নির্ভর করে। এতে দেখা গেছে, পণ্যটির আন্তর্জাতিক বাজারের গতির ওপর আমাদের এই পণ্যটির গতি নির্ভর করে। দেশের পণ্যে তো বৈচিত্র্য নেই, বাজারেও বৈচিত্র্য নেই। একটা বাজারের ওপর ভর করে বেশি দূর এগুনো যায় না।

ডলারের বিনিময় হার অর্থাৎ দাম কমকে সবচেয়ে বেশি সমস্যা উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এক ধরনের অনমনীয় অবস্থায় রয়েছে ডলার। যে কারণে রপ্তানিকারকরা সুবিধা পাচ্ছেন কম। অন্যদিকে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। কারণ বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ছে, পরিবহন ব্যয় বাড়ছে। উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত সব ধরনের খরচ বাড়ছে। কিন্তু পণ্যের দাম বাড়ছে না বরং কমছে। এর প্রভাব পড়ছে রপ্তানি আয়ে।

আহসান মনসুর বলেন, ব্যয়ের চাপে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অদৃশ্যভাবে শত শত শ্রমিক চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ছেন।

অদৃশ্যের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, কারখানা থেকে কোনো শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হলে কিংবা শ্রমিক চাকরি ছেড়ে দিলে বা কোনো কারণে তার চাকরি ছাড়তে হলো তখন ওই শুন্যস্থানে নতুন করে শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছে না কারখানা মালিক। ব্যয় কমাতেই এই নিরব কৌশল নিচ্ছে মালিকেরা। কিন্তু যেই শ্রমিক বের হয়ে যায় দেখা গেছে, সে আর চাকরি পায় না। এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে শ্রমিকরা বেকার হচ্ছে। হয়ত এক সাথে কোনো কারখানা থেকে বড় সংখ্যক শ্রমিক বের হয় না বলে শ্রমিকদের চাকরি হারানোর এই সংখ্যাটা দৃশ্যমান নয়। কিন্তু মূলত এটা অদৃশ্যমান ছাঁটাই।

রপ্তানি আয় বাড়াতে কয়েকটি পরামর্শ দিয়ে ব্র্যাকের চেয়ারম্যান বলেন, ডলারের দাম বাড়াতে হবে। এছাড়া বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো থেকে সরকারকে বিরত থাকতে হবে। বিদ্যুতের কারণেও পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। এখন বিদ্যুতের দাম বাড়লে উৎপাদন ব্যয় আবার বাড়বে। সেটা রপ্তানি আয় আরো কমিয়ে ফেলবে। এছাড়া বন্দরে খরচ বেশি পড়ছে। শোনা যায় ঢাকা থেকে পণ্য চট্টগ্রামে নিতে যে খরচ হয়, প্রায় একই খরচ হয় সেই পণ্য চট্টগ্রাম থেকে আমেরিকা পৌঁছাতে। এই ব্যয়ের মধ্যে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন খরচ রয়েছে। রপ্তানি আয় বাড়াতে মোটা অংকের এই ব্যয় কমানোর বিকল্প নেই। এছাড়া পণ্য পোঁছানোর সময় বা লিড টাইম অনেক বেশি। এ কারণে টাকা আটকে থাকে। কিন্তু রপ্তানিকারককে ঋণের সুদ দিতে হচ্ছে। তাই আয় না বেড়ে ব্যয় বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।

তৈরি পোশাক

তথ্যমতে, বড় খাতগুলোতেও রপ্তানি আয় কমেছে। কৃষিপণ্য আয় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৬৯ শতাংশ কমে ৪৪ কোটি ৬৩ লাখ ডলার হয়েছে। প্লাস্টিক পণ্যে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ১৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ৫ মাসে এ খাতে আয় হয়েছে ৪ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি আয় প্রবৃদ্ধি কমেছে; অর্জন হয়নি লক্ষ্যমাত্রাও। ৫ মাসে চামড়াজাত খাত থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ৩৯ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ কম। প্রবৃদ্ধিও কমেছে ১০ দশমিক ০৩ শতাংশ। পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি বেড়েছে। এ খাত আয় করেছে ৪০ কোটি ৪৭ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেশি। প্রবৃদ্ধিও গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ১৬ শতাংশ বেড়েছে।

চলতি অর্থবছরে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৫৪ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে পণ্য খাতে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৪৫ বিলিয়ন এবং সেবা খাতে সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার ধরা হয়, যা গত অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews