ছবির ক্যাপশান,
মাইলস্টোনের ঘটনায় যারা সন্তান হারিয়েছেন, যারা আহত বা দগ্ধ হয়েছেন, যারা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তাদের শোক-আতঙ্ক কবে কাটবে বা আদৌ পুরোপুরি কাটবে কিনা সেই শঙ্কা রয়ে গেছে
Author,
সজল দাস
Role,
বিবিসি নিউজ বাংলা
৩ ঘন্টা আগে
"স্কুলের গেট পর্যন্ত গিয়েছিল আমার বাচ্চাটা। কিন্তু ওকে আর ভেতরে নিয়ে যেতে পারিনি। ওই দিনের পর থেকে স্কুলে আসার কথা শুনলেই ও কেমন যেন করে, ভয় পায় মনে হয়," এই কথাগুলো বলছিলেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক।
কথা হচ্ছিল মাইলস্টোন স্কুলে সামরিক বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সায়মার বাবা শাহ আলমের সঙ্গেও। নিহতদের স্মরণে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ শনিবার ডেকেছিল তাদের।
স্কুলে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি মি. আলম। স্কুল চত্বরে যেতেই প্রিয় সন্তানের নানা স্মৃতি ভেসে উঠেছিল তার চোখের সামনে।
"ডাকছিলো তো অনেকরেই, কিন্তু মাত্র নয়টা ফ্যামিলি আইছে," বলেন তিনি।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এই দুর্ঘটনার শোক এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে। কেউ হারিয়েছেন প্রিয় স্বজনকে, কেউ হারিয়েছেন দীর্ঘদিনের সহকর্মীকে, আবার অনেকে এই দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।
বিশেষ করে শিশুদের মনের ওপর এর প্রভাব মারাত্মক এবং দীর্ঘস্থায়ী বলেই মনে করেন মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞরা।
"এক অনিশ্চয়তা আর ভয়ের মধ্যে থাকবে এই বাচ্চাগুলো। অনেক ক্ষেত্রে কারো কারো হয়তো এই স্কুলটাই পরিবর্তন করা লাগতে পারে," বিবিসি বাংলাকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তানভীর রহমান।
অবশ্য ওই স্কুলটির শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসায় কাউন্সিলিংয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। স্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প বসিয়েছে বিমান বাহিনী।
এছাড়া রবিবার থেকে ধাপে ধাপে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালুরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
"প্রথম দিনেই সরাসরি ক্লাস-পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে বিষয়টি এরকম না", পর্যায়ক্রমে সবকিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছেন স্কুলটির জনসংযোগ কর্মকর্তা।

ছবির উৎস, Family Handout
ছবির ক্যাপশান,
নাজিয়া (১২) ও নাফি (৮) উত্তরা মাইলস্টোন স্কুলের ক্লাস সিক্স ও ক্লাস টুয়ের শিক্ষার্থী ছিল
উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সামরিক বিমান বিদ্ধস্তের ঘটনার পর ১২ দিন পেরিয়েছে। এই সময়ে কেবলই লম্বা হয়েছে মৃত্যুর মিছিল।
এখন পর্যন্ত ৩৪ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আহত হয়েছিলেন শতাধিক যাদের মধ্যে ৪১ জন এখনো চিকিৎসাধীন আছে বলে সরকারি তথ্যে জানানো হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সবশেষ তথ্য অনুয়ায়ী, মাইলস্টোন দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১৮ জন, ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ১৪ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং ইউনাইটেড হাসপাতালে একজন করে মারা গেছেন।
জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. নাসির উদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, মাইলস্টোন দুর্ঘটনায় আহত ২৮ জন এখনো হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে ২৪ জনই শিশু।
এখনো একজন আইসিইউতে রয়েছেন, তবে আহত আর কেউ ভেন্টিলেটরে নেই বলেও তিনি জানান তিনি।
মি. উদ্দিন বলেন, "আমরা সিভিয়ার ক্যাটাগরিতে যে ১০ জনকে রেখেছিলাম তার মধ্যে তিনজনকে ইন্টারমিডিয়েট ক্যাটাগরিতে নিয়েছি। তারা যথেষ্ট ইমপ্রুভ করেছে, আমরা তাদের ব্যাপারে এই মুহূর্তে একটু পজিটিভ রেজাল্ট আশা করতেছি।"
ঝুঁকি থাকায় এখনো সাত জনকে সিভিয়ার ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে যাদের প্রত্যেকের শ্বাসনালিতে প্রদাহ বা ইনহেলেশন বার্ন রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজনের শরীরের ৩০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেছে বলেও জানান তিনি।
এখন পর্যন্ত মোট ১৮৯ দফা অপারেশন করা হয়েছে বলেও জানান মি. উদ্দিন। তিনি বলেন, "আমরা যে ড্রেসিংগুলো করি ওটিতে তো, এটা আসলে কোনো না কোনো অপারেশন হয়েই থাকে।"
এই দুর্ঘটনায় কেবল জাতীয় বার্ন অ্যান্ডপ্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটেই ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
হাসপাতালটির পরিচালক জানান, একজনকে মৃত অবস্থায়ই আনা হয়েছিল। আর যারা এখানে মারা গেছে তাদের মধ্যে ১২ জনই ছিল গুরুতর দগ্ধ। ৮৫ শতাংশ এবং তার বেশি পোড়া অবস্থায় তাদেরকে আনা হয়েছিল।

ছবির ক্যাপশান,
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ঘটনায় শোকেরআবহ এখনো তাজা (দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থী বাপ্পির বাবার ছবি)
গত ২১শে জুলাই সামরিক বিমান বিদ্ধস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনার পর থেকেই বন্ধ মাইলস্টোন স্কুল
অ্যান্ড কলেজের উত্তরা দিয়াবাড়ি শাখা। দুর্ঘটনার পর থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে শোকের আবহ।
অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনা এখনো মেনে নিতে পারেননি শিক্ষক, শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবকদের কেউই।
প্রতিদিনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির বাইরে ভিড় করছেন অসংখ্য মানুষ। বিভিন্ন জায়গা থেকে স্কুলটি দেখতেও এসেছেন অনেকে। পরিদর্শন করছেন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও।
তবে ওই দুর্ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পর স্কুলটি কবে খুলবে এবং শিক্ষার্থী, শিক্ষকদের দুঃসহ মানসিক পরিস্থিতি কীভাবে সামলে নেওয়া যায় এই বিষয়গুলোও সামনে আসছে।
গত সপ্তাহে স্কুলটি খোলার বিষয়ে আলোচনা হলেও সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে কর্তৃপক্ষ।
তবে এই রবিবার, তেরসা অগাস্ট থেকে পর্যায়ক্রমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি আবারো খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল বিবিসি বাংলাকে জানান, রবিবার নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য কলেজ সেকশন চালু করা হবে। এরপর ধাপে ধাপে অন্য শ্রেণির জন্যও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম শুরু হবে।
"প্রথম দিনেই সরাসরি ক্লাস পরিক্ষা শুরু হয়ে যাবে বিষয়টি এরকম না। শোকসভা হবে মিলাদ মাহফিল হবে, সবাই সবার জন্য দোয়া করবে। কুশল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে পার হবে। শুরুতে যে আহামরি লেখাপড়া হবে তা নয়, লেখাপড়ার সূচনাটা করা হবে," বলেন মি. বুলবুল।
কাউন্সিলিংয়ের মধ্য দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি আবারো কার্যক্রম শুরু করতে চায়।
"এখানে বিমান বাহিনীর ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প বসানো হয়েছে। যেখানে প্রতিদিনই মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে," বলেও জানান তিনি।

ছবির উৎস, AFP via Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
মাইলস্টোন স্কুলে বিধ্বস্ত যুদ্ধবিমানের ধ্বংসাবশেষ
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুর্ঘটনায় একদিকে বন্ধু বা স্বজন হারানোর বেদনা, অন্যদিকে ঘটনার বিভৎসতা সব মিলিয়ে মানসিকভাবে অস্বাভাবিক একটি পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা।
বিশেষ করে শিশুদের ওপর এর প্রভাব মারাত্মক হতে পারে বলেই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তানভীর রহমান।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস মেডিসিন বলছে, এরকম সমস্যায় আক্রান্ত হলে যে ঘটনার কারণে এটা হয়েছে একজন মানুষ যেন বারবার ওই ঘটনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন এমন অনুভব করেন, আবার ঘটতে যাচ্ছে এরকম আতঙ্ক বোধ করে।
ওই ঘটনার সাথে সম্পর্কিত অনেক কিছু মনে করতে পারেন না, সাময়িক স্মৃতি ভ্রম তৈরি হয়, ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখেন। ওই ঘটনা মনে করিয়ে দিতে পারে এমন যেকোনো কিছু শুনলে বা দেখলে তীব্র প্রতিক্রিয়া, আতঙ্ক, উদ্বেগ বোধ করেন, চমকে ওঠেন।
মাইলস্টোনের ওই ঘটনা যে কেবল ওই স্কুলের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদেরকেই প্রভাবিত করেছে তা নয়। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে এর প্রভাব ছড়িয়েছে অনেকের মধ্যেই।
মি. রহমান বলছেন, "দেশের বিরাট অংশের মানুষ এই ঘটনাটি অবজার্ভ করেছে, ফিল করেছে, ট্রমাটাইজড হয়েছে। বিশেষ করে যাদের এই বয়সী বাচ্চা আছে কিংবা অন্য স্কুলের এই বয়সী শিক্ষার্থীরা সাইকোলজিক্যালি অ্যাফেক্টেড হয়েছে।"
"তাই সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট অবশ্যই নেওয়া উচিত, বিশেষ করে এই ঘটনায় সরাসরি সংশ্লিষ্টদের," বলেন তিনি।
মাইলস্টোন দুর্ঘটনায় মানসিকভাবে আক্রান্তদের সহায়তায় নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিমান বাহিনীর মেডিকেল টিমের পাশাপাশি কয়েকটি সংগঠনের এগিয়ে আসার খবরও গণমাধ্যমে এসেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলছেন, যে মানসিক আঘাত এই স্কুলের সবাই পেয়েছে বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা সেটি তাদেরকে নানা ভাবে ভোগাতে পারে। তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেশিদিন বন্ধ রাখাও ঠিক হবে না বলে মনে করেন তিনি।
"কাউন্সিলিংয়ের পাশাপাশি শোকসভার মতো নানা আয়োজনের মাধ্যমে তাদেরকে শোকটা প্রকাশ করার সুযোগ দিতে হবে," বলেন মি. হোসেন।