ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল মলে জাঁকজমকপূর্ণ এক সামরিক কুচকাওয়াজে ২৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করছে মার্কিন সেনাবাহিনী। একই দিনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৭৯তম জন্মদিনও। সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ প্রধান হিসেবে তিনি কনস্টিটিউশন অ্যাভিনিউতে নির্মিত একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে কুচকাওয়াজের সালাম গ্রহণ করবেন।
অনেকে একে তার অহংকারের বহিঃপ্রকাশ বললেও, এই আয়োজন নিছক ভ্যানিটি প্রজেক্ট নয়। কারণ ইতিহাস ট্রাম্পের জন্য সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে অনিচ্ছাকৃতভাবে হোয়াইট হাউজ ছাড়ার আগে তার একটি শেষ উদ্যোগ ছিল “১৭৭৬ কমিশনের” রিপোর্ট প্রকাশ, যার লক্ষ্য ছিল “আমেরিকার প্রতিষ্ঠার মহানতা সম্পর্কে সঠিক বোঝাপড়া ফিরিয়ে আনা”। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে “আমেরিকাবিরোধিতা, অপবাদ ও সেন্সরের আঁতুড়ঘর” হিসেবে চিহ্নিত করে এই কমিশনে ইচ্ছাকৃতভাবে খুব অল্প সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ইতিহাসবিদকে রাখা হয়েছিল।
কমিশনটি দাবি তোলে “দেশপ্রেমমূলক শিক্ষা” ফিরিয়ে আনার, ঘোষণায় বলা হয়: “আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমাদের দেশের সঠিক ইতিহাস শেখাতে হবে, যাতে আমরা আবারও আমাদের প্রতিষ্ঠাকালীন নীতিগুলিকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারি। আমাদের এই আশ্চর্যজনক জাতির প্রতি গর্ব ও কৃতজ্ঞতা নবায়ন করতে হবে।”
এই চিন্তারই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ২ মে ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে ৮ মে ও ১১ নভেম্বর দিনদুটি তিনি যথাক্রমে “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয় দিবস” হিসেবে নামকরণ করছেন। কারণ তার মতে, “এই দুটি যুদ্ধে আমরাই বিজয়ী হয়েছি, শক্তি, সাহস বা সামরিক কৌশলে আমাদের ধারেকাছে কেউ ছিল না। এখন সময় এসেছে আমাদের বিজয়গুলো উদযাপন করার।”
১৪ জুনের কুচকাওয়াজ দিয়েই শুরু হচ্ছে স্বাধীনতার ২৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া এক বিশাল আয়োজন, যার চূড়ান্ত পর্ব হবে ৪ জুলাই ২০২৬। হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, এর একটি অংশ হবে ভিডিও সিরিজ, যাতে দেখানো হবে কীভাবে “একটি ছোট, অগোছালো বাহিনী বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যকে হারিয়ে সবচেয়ে মহান প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল”।
ইতিহাস মঞ্চে হাজির – তবে প্রশ্ন থেকে যায়
ট্রাম্প প্রায়ই একটি যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে শুরু করেন। ২০১৭ সালে ফ্রান্সে বাস্টিল দিবসের কুচকাওয়াজে ফরাসি ও মার্কিন সেনাদের একসঙ্গে মার্চ করতে দেখে তিনি নিজেও এমন আয়োজন করতে চান। এতে আপত্তি করার কিছু নেই (যদি খরচ নিয়ে সমস্যা না থাকে)। কিন্তু দ্যা গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়,
গর্বের ভিত্তি হওয়া উচিত সততায় – বিশেষ করে যখন ইউরোপে ন্যাটো একটি প্রক্সি যুদ্ধ চালাচ্ছে ইতিহাস বিকৃতিকারী ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে। আর সততার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বোঝা যায়, বিশ্বযুদ্ধগুলো বিশ্ব সিরিজের মতো কোনো একক দেশের জয় নয়, যেখানে “আমরাই সব করেছি” এমন দাবির জায়গা নেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: কে কী ভূমিকা রেখেছিল?
চলতি বছরের ৩ মে ট্রাম্পের দাবিকে রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ “আতিশয্যপূর্ণ বাজে কথা” বলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, “বিজয় দিবস আমাদের – এটা ৯ মে, ছিল, আছে, থাকবে।” মেদভেদেভ বর্তমানে পুতিনপন্থী হলেও, রাশিয়া ১৯৪১-৪৫ সালে যে ২৭ মিলিয়ন মানুষ হারিয়েছিল, তা ভুলে যাওয়ার উপায় নেই।
জুন ১৯৪১ থেকে জুন ১৯৪৪-এর মধ্যে, অর্থাৎ নাৎসি বাহিনীর সোভিয়েত আক্রমণ থেকে শুরু করে নরম্যান্ডির ‘ডি-ডে’ অবধি সময়ে জার্মান সেনাবাহিনীর মোট ক্ষয়ক্ষতির ৯০ শতাংশ ঘটেছিল রেড আর্মির হাতে। এই পরিসংখ্যান এল আলামেইন, তিউনিস, আনজিও, কিংবা রোম মুক্ত করার মতো পশ্চিমা বিজয়গুলোর তাৎপর্য ভিন্ন করে তোলে।
তবে সত্য যে, আমেরিকা ছিল এক “সুপারপাওয়ার” – এই শব্দটি ১৯৪৪ সালে জন্ম নেয় “অত্যন্ত শক্তিশালী ও বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ করার ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ” বোঝাতে। তাদের বিশাল B-17 ও B-24 বোমারু বিমান এবং C-47 পরিবহন বিমানের মাধ্যমে তারা সারা পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধ করেছে। প্যাসিফিক যুদ্ধের শেষ পরিণতি আসে টোকিওতে আগুনঝরা বোমাবর্ষণ এবং হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক বিস্ফোরণের মাধ্যমে।
নরম্যান্ডি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের বিস্ময়কর অগ্রগতি দেখে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিলেন: “তাদের রসদ কোথা থেকে আসছে?” মার্কিন জেনারেল ওমর ব্র্যাডলি উত্তর দেন, “ফোর্ড কোম্পানি থেকে। আমরা ২৪ ঘণ্টা ট্রাক চালাচ্ছি, একেবারে বাম্পার টু বাম্পার।”
তবে ব্রিটেনকেও বাদ দেওয়া যায় না
১৯৪০ সালে যদি ব্রিটেন ফ্রান্স, স্ক্যান্ডিনেভিয়া বা বেলজিয়ামের মতো নাৎসিদের দখলে চলে যেত, তাহলে হিটলার হয়তো সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে পুরো শক্তি দিয়ে আক্রমণ চালাত, আর আমেরিকাও হয়তো আত্মমুখী হয়ে পড়ত।
কিন্তু চার্চিলের নেতৃত্ব, অত্যাধুনিক ফাইটার জেট ও রাডারভিত্তিক “চেইন হোম” সিস্টেম এবং RAF পাইলটদের সাহসে হিটলার আটকে পড়ে। পরে ব্রিটেনই হয়ে ওঠে ইউরোপে মিত্রশক্তির আক্রমণের প্রধান ঘাঁটি।
১৯৪৪-৪৫ সালে মিত্রবাহিনী পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ – তিন দিক থেকেই জার্মানির দিকে অগ্রসর হয়। যদিও তাদের উদ্দেশ্য ও মূল্যবোধ ছিল ভিন্ন, তবু নাৎসিবাদের বিনাশ তাদের একটি অভিন্ন লক্ষ্য ছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধও ছিল একটি বিশ্বযুদ্ধ
আমেরিকার সবচেয়ে গৌরবময় বিজয় – স্বাধীনতা অর্জনের কথাও একপাক্ষিকভাবে দেখলে চলবে না। অবশ্যই জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্ব ও তার সৈন্যদের সাহসের তাৎপর্য অস্বীকার করা যায় না (বিশেষ করে তিনি যখন সৈন্যদের গুটি বসন্তের বিরুদ্ধে টিকাদানে জোর দেন)। তবে সেটিও ছিল এক ধরনের বিশ্বযুদ্ধ, যেখানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়েছিল ফ্রান্স, স্পেন ও ডাচদের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী নৌশক্তিগুলি।
ফরাসি নৌবাহিনীর অবরোধেই লর্ড কর্নওয়ালিসকে ১৭৮১ সালে ইয়র্কটাউনে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হয় এবং আমেরিকার স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়।
দইতিহাসের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ঘটনা ও সাফল্যগুলিকে প্রসঙ্গসহ ব্যাখ্যা করা – শুধু জাতীয় গর্বে গদগদ হয়ে তা তুলে ধরা নয়। আমেরিকার জন্ম কিংবা হিটলারের পতন – দুটো ইতিহাসই বলে দেয়, মিত্রদের গুরুত্ব কতটা। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ – সব সময়েই এই শিক্ষা প্রযোজ্য। আর সেটিই মনে রাখা উচিত যখন ইতিহাস আবার কুচকাওয়াজে মঞ্চস্থ হয়।