টেকসই উন্নয়নে সমবায়ে জোর দিতে হবে এমনটি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, খাদ্য উৎপাদনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। কৃষির উন্নয়নে সমবায় পদ্ধতি চালুর তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা করতে পারলে জীবনেও কোনো খাদ্যের অভাব হবে না। সরকার বছরে কৃষিতে ২৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, জাতির পিতার দেখানো পথে সমবায় কৃষি নিশ্চিত করা হলে দেশে কখনো খাদ্যের অভাব হবে না। এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে, নিজেদের খাদ্য নিজেরাই উৎপাদন করব। উদ্বৃত্ত থাকলে অন্যকে সাহায্য করব। গত ১৯ এপ্রিল কৃষক লীগের ৫২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গণভবনে শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

কৃষি উন্নয়নে সমবায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। কৃষিক্ষেত্রে সমবায় পদ্ধতি যুগান্তকারী অবদান রাখতে পারে। কৃষকরা সমবায়ী হলে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। একতার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হলে কৃষক সমাজ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। সমবায় হলো অনেকে মিলে বা যৌথভাবে কাজ করা। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন, সমবায় হলো একটি জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে রয়েছে গণতন্ত্র, উৎপাদন, সুশাসন, আন্দোলন, চেতনা ও আদর্শ। ১৯৭২ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন কর্তৃক আয়োজিত সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত ভাষণ একটি মাইলফলক।

সমবায়ভিত্তিক কৃষিনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে সকল শ্রেণির কৃষক ও উদ্যোক্তার চাহিদাভিত্তিক প্রযুক্তি ও তথ্যসেবা দেওয়ার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘাত সহনশীল, পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ, টেকসই ও পুষ্টিসমৃদ্ধ লাভজনক ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করা। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, অনেক যন্ত্রপাতি  আছে যেগুলোর দাম ২০/২২ লাখ টাকা। সেক্ষেত্রে কয়েকজন কৃষক তিন মাসের জন্য একটা কিনলে তাদের জন্য লাভজনক হয় না। সেজন্য সমবায়ভিত্তিতে সবাই মিলে যদি এটা কেনা যায় তাহলে সবাই সেটা ব্যবহার করতে পারবে। বাজারজাতকরণটাও যদি সমবায়ভিত্তিতে হয় তাহলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবে। যেমন– ছোট জায়গায় হঠাৎ করে ভিন্ন একটি ফসল বাজারজাতকরণে বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়। এমন পরিস্থিতিতে একসঙ্গে বড় একটি জায়গায় সমবায়ভিত্তিতে চাষ থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করা গেলে সুফল মিলবে বেশি। সবাই যদি একই জায়গায় একই টাইপের ফসলে যায় তাহলে কম্বাইন্ড পদ্ধতিতে চাষ করে একসঙ্গে ফসল কাটতে সুবিধা হবে, একসঙ্গে ফসল তুলে নেওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে মার্কেটিংয়ে সুবিধা হবে। যারা ফসল কেনে তারা এক জায়গা থেকে ফসল নিয়ে যেতে পারলে পরিবহন খরচও সাশ্রয় হবে। সমবায়ভিত্তিক চাষে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। এ বিষয়ে একটি পাইলট প্রজেক্টের তথ্যমতে এতে দুই গুণ, আড়াই গুণ পর্যন্ত বেশি লাভ হওয়ার প্রমাণ মেলে।

ওয়ার্ল্ড কো-অপারেটিভ মনিটরের তথ্যমতে প্রায় ৩ মিলিয়ন সমবায় সমিতির মাধ্যমে বিশ্বের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষ সমবায়ের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছেন। বিশ্বে কর্মরত জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশের সমবায়ের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর মাঝে শীর্ষ ৩০০ কো-অপারেটিভ সোসাইটির বার্ষিক টার্নওভারের পরিমাণ ২০৩৪.৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সমবায়ের সব খাত মিলিয়ে শীর্ষ ৩০০ সমবায় সমিতির মাঝে কৃষি সমবায় সমিতির অবদান হচ্ছে ৩১.৭ শতাংশ। এ পরিপ্রেক্ষিতে এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সমবায় সমিতির মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী কৃষকরা সংগঠিত হচ্ছে, উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

বাংলাদেশের প্রায় সব পেশার লোকের সমিতি রয়েছে। অথচ কৃষকদের সংগঠন বা সমিতি এখনো বেশ কম পরিলক্ষিত হয়। সমবায় সমিতি কম হওয়ার বহুবিধ কারণ রয়েছে। সমিতি টেকসই না হওয়া, কতিপয় সদস্যের অতিশয় প্রভাব বিস্তার, অসাধুতা, অব্যবস্থাপনা, সমবায়ের প্রতি নেতিবাচক ধারণা এবং সমবায় নীতি না মানা ইত্যাদি। সমবায় খামার গড়ে তোলার প্রবণতা ও মানসিকতার পরিবর্তন আনতে পারলে কৃষির আধুনিকায়ন ও কৃষির যান্ত্রিকীকরণের প্রসার আরও বাড়বে। কৃষকদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলার জন্য সমবায়ভিত্তিক খামার গড়ে তোলা দরকার। সমবায়ের নীতি অনুসারে যার জমি তারই থাকবে, কেবল সকলে একত্রে কাজ করবে এবং উৎপাদিত ফসল প্রত্যেকের জমি অনুপাতে ভাগ করে নেবে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে ভূমির খ--বিখ-তা হ্রাস পাবে এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়বে। সমবায় পদ্ধতিতে কৃষকরা স্বেচ্ছায় নিজেদের জমি একত্রিত করে যৌথভাবে চাষাবাদ করেন। জমির উর্বরতা ও পরিমাণ অনুসারে কৃষক উৎপাদিত ফসলের অংশ পাবেন। সমবায়ের মাধ্যমে কৃষি যন্ত্রপাতি, সার, কীটনাশক, উত্তম বীজ প্রভৃতি সংগ্রহ এবং প্রয়োজনমতো সেচ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে উন্নত চাষাবাদ করা যায়। সরকার সমবায় খামারের ওপর বেশ গুরুত্বারোপ করেছে। ২০১৮ সালে প্রণীত জাতীয় কৃষিনীতিতে কৃষি সমবায় ব্যবস্থাপনাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছে। ইতোমধ্যেই অনেক জায়গায় সমবায় খামার স্থাপনের মাধ্যমে অত্যন্ত সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।

জাপানের জেন-নোহ কৃষি সমবায় সমিতির ফেডারেশনটি হতে পারে সমবায়ভিত্তিক কৃষির অন্যতম একটি বৈশ্বিক উদাহরণ। ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরু করে সারাদেশে ৯৪৫টি সমবায় ইউনিয়নের মাধ্যমে পরিচালিত এ ফেডারেশনের বর্তমান মূলধনের পরিমাণ ১০৮ কোটি মার্কিন ডলার। বার্ষিক টার্নওভারের পরিমাণ ৪৩০০ কোটি ডলার। জেন-নোহর ব্যবসাগুলোর মধ্যে রয়েছে চালসহ দানাশস্য উৎপাদন, টাটকা ফলমূল ও শাক-সবজি উৎপাদন, কৃষি ব্যবসা কার্যক্রম, কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ, প্রাণিসম্পদ উৎপাদন কার্যক্রম, ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ ও গুণগতমানসম্পন্ন দ্রব্যাদি সরবরাহ, কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি কার্যক্রম ইত্যাদি।

সমবায়ের অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো জনতার সামনে বলেছেন, ‘নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি আমি। গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল করবেন না।

আমি আপনাদের জমি নেব না। ভয় পাবেন না যে, জমি নিয়ে যাব, তা নয়। পাঁচ বছরের প্ল্যানে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে একটি কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে গ্রামে কো-অপারেটিভে জমির মালিকের জমি থাকবে। এগুলো বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ফার্টিলাইজার যাবে তাদের কাছে, টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল টাউটদের বিদায় দেওয়া হবে। তা না হলে দেশকে বাঁচানো যাবে না। এজন্যই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘোষণা করছি আজকে যে, পাঁচ বছরের প্ল্যানে প্রত্যেকটি গ্রামে পাঁচশ’ থেকে হাজার ফ্যামিলি পর্যন্ত নিয়ে কম্পালসারি কো-অপারেটিভ হবে। আপনার জমির ফসল আপনি নেবেন, অংশ যাবে কো-অপারেটিভের হাতে, অংশ যাবে গভর্নমেন্টের হাতে।’ বঙ্গবন্ধু সমবায় সম্পর্কে যে নির্দেশনা প্রদান করেছেন সেই নির্দেশনা অনুযায়ী সমবায় কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার।

বিদ্যমান সমবায় আইনকে যুগোপযোগী করে কৃষি সমবায়কে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করে সমবায় অধিদপ্তর ও সমবায় ব্যাংককে যদি কার্যকর করা যায় এবং তথ্যপ্রযুক্তিগত জ্ঞান ব্যবহার করে সমবায়ের মাধ্যমে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যায় তাহলে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল ফসলের জাত ও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তিসমূহ সমবায়ভিত্তিক কৃষির মাধ্যমে বিস্তার ঘটানো গেলে টেকসই হবে বেশি। এর জন্য নির্দিষ্ট গ্রামে বা উৎপাদন এলাকায় সমবায়ভিত্তিক স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি ভিলেজ গড়ে তোলা যেতে পারে, যেখানে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তিসমূহ একত্রে স্থান পাবে এবং সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ও স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে একটি জোরালো সমন্বয় বা লিংকেজ থাকবে। কৃষি সম্প্রসারণ সেবার বর্তমান অবস্থা, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য এবং পরিকল্পনাগুলো সমবায় নীতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় ও পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো গেলে কৃষি উন্নয়ন আরও টেকসই হবে।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বারি, সাবেক ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট,

এফএও, জাতিসংঘ

[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews