‘অনেকটা ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার মতো করে হাত দুই দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখছে। ওরা আমাদের ওড়না নিয়ে নিয়েছিল, আমার গায়েও ওড়না ছিল না। আর যেহেতু জানালার দিকে মুখ করা ছিল, তাই আমাকে এভাবে দেখার জন্য অহরহ পুরুষ মানুষ যে কতজন এসেছে তা ছিল বলার বাইরে। মানে তারা এভাবে একটা মজা পাচ্ছে। বলাবলি করতেছিল যে, এতদিন এমন পর্দাই করছ যে-এখন সব পর্দা ছুটে গেছে।’

উপরের বক্তব্যগুলো গুমের শিকার ২৫ বছর বয়সি এক নারীর। ২০১৮ সালে পুলিশ তাকে অপহরণ করে ২৪ দিন গুম করে রাখে। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গুম কমিশনের দাখিল করা দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিবেদনে এমন সব ভয়াবহ ও পৈশাচিক নির্যাতনের তথ্য উঠে এসেছে। মঙ্গলবার গুম কমিশনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য রিপোর্টের কিছু অংশ শেয়ার করা হয়।

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আওয়ামী লীগ আমলে কথিত ‘সরকারবিরোধী যড়যন্ত্র’ সম্পর্কে জানতে টার্গেট করা ব্যক্তিদের বিশেষ সেলে গুম করার পর ভয়াবহ নির্যাতন করা হতো। শিফটিং সিস্টেমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন পদ্ধতিতে নির্যাতন চালানো হতো। কখনো ঝুলিয়ে পেটানো হতো, কখনো আবার আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হতো; আবার কখনো বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো। এতে অনেকে অজ্ঞান হয়ে যেতেন, বমি করে দিতেন, আবার কেউ কেউ চোখ বাঁধা অবস্থায় নিজের শরীরের মাংস পোড়ার গন্ধ পেতেন। নির্যাতনের এই ভয়াবহতা থেকে রেহাই পেতেন না গুমের শিকার নারীরাও। তাদের ঝুলিয়ে বিকৃতভাবে উল্লাস করা হতো এবং অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন গুমসংশ্লিষ্ট বাহিনীর সদস্যরা। গুম কমিশনে দেওয়া অনেক ভুক্তভোগীর বর্ণনায় র‌্যাব, সিটিটিসি ও ডিজিএফআইর সদস্যদের বিভিন্ন পদ্ধতির লোমহর্ষক এমন নির্যাতনের ভয়াবহতার চিত্র সামনে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভয়াবহ নির্যাতনের প্রমাণ ধ্বংসের চেষ্টা সত্ত্বেও কমিশন এমন কিছু উপাদান সংগ্রহ করেছে-যা ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্যের সঙ্গে মিলে যায়। বিশেষ করে র‌্যাব-২ এবং কমান্ড অ্যান্ড প্লাটুন কোম্পানি (সিপিসি)-৩ এ ব্যবহৃত ঘূর্ণায়মান চেয়ার, টিএফআই সেলে মানুষ ঝুলিয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত পুলি-সিস্টেম এবং একাধিক স্থানে শব্দনিরোধক এমন ব্যবস্থা করে রাখা হতো যার ফলে নির্যাতনের সময় ভুক্তভোগীদের চিৎকার বাইরের কেউ শুনতে পেত না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের গুম করার কোনো আনুষ্ঠানিক রেকর্ড থাকত না। ফলে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো দায়মুক্তভাবে নির্যাতন চালাতে পারত। পরবর্তীতে জনসমক্ষে হাজির করার আগে নির্যাতনের চিহ্ন লুকাতে কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের ওষুধ বা মলম দেওয়া হতো, যাতে ক্ষতচিহ্ন সহজে নজরে না আসে। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনের চিহ্ন মুছে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেই তাদের মুক্তি দেওয়া হতো। তবে অনেক ভুক্তভোগী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হয়ে স্পষ্ট নির্যাতনের চিহ্ন দেখালেও সেসব অভিযোগ উপেক্ষা করা হয়।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৮ সালে গুমের শিকার ওই নারী কমিশনকে আরও বলেছেন, ‘আমার পিরিয়ড হওয়ার ডেট ছিল অনেক লেটে।

কিন্তু আমার ওপর তারা এমনভাবে টর্চার করে যে-তাতে আমি এত পরিমাণ অসুস্থ হয়ে যাই যে, সঙ্গে সঙ্গে আমার পিরিয়ড আরম্ভ হয়ে যায়। তারপর উনাদের বলি যে, আমার তো প্যাড লাগবে-তখন এটা নিয়ে অনেক হাসাহাসি করত বাহিনীর সদস্যরা।

অপরদিকে ৩৯১ দিন গুম থাকা ৪৬ বছর বয়সি এক ব্যক্তি কমিশনকে জানিয়েছেন, পুরুষ ভুক্তভোগীদের রাখার সেলগুলো ছিল ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ। সেলে টয়লেট ব্যবহারের জন্য নিচু বিল্ট-ইন প্যান বসানো ছিল। মাঝে কোনো দেওয়াল না থাকায়, ভুক্তভোগীরা যখন শুয়ে থাকতেন, তখন তাদের শরীর প্রায়শই ওই প্যানের উপরেই পড়ে থাকত। যার ফলে তাদের ময়লা, প্রস্রাব ও মলের অস্বাস্থ্যকর অবস্থার মধ্যে থাকতে হতো। এছাড়া এসব সেলে সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে প্রতিটি কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করা হতো। ফলে ভুক্তভোগীদের সবচেয়ে ব্যক্তিগত মুহূর্তেও, যেমন প্রাকৃতিক কাজের জন্য টয়লেট প্যান ব্যবহারের সময়ও চরম অপমান ও লজ্জার মধ্যে থাকতে হতো। ঠিকমতো ঘুমাতেও দিত না নিরাপত্তা প্রহরীরা।

২০২৩ সালে সিটিটিসি কর্তৃক ১৬ দিন গুম থাকা ৪৭ বছর বয়সি এক ব্যক্তি বলেছেন, চোখ কখনো গামছা দিয়ে, কখনো যমটুপি দিয়ে বাঁধা থাকত। হাত বাঁধা থাকত কখনো সামনে, কখনো পেছনে। আর যখন বেশি মারবে, তখন হাত পেছনে দিয়ে রাখত। আর আমার এই কনুইগুলো, দুই হাঁটু এগুলোতে খুব জোরে জোরে মারত মোটা লাঠি দিয়ে। আমি মনে করতাম যে, আমার হাড়গুলো বুঝি ভেঙে যাবে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখলাম যে ফুলে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে, কিন্তু হাড় ভাঙছে এরকম বুঝিনি। একপর্যায়ে আমাকে বলল যে, তোর হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলব।

র‌্যাব-১১ কর্তৃক গুম হওয়া এক যুবক জানিয়েছেন, আমার পা বেঁধে উপর দিকে করে ঝুলিয়েছে। মাথা নিচের দিক, পা উপর দিকে। আমার শরীরে কোনো পোশাক রাখেনি তখন, একেবারে উইদাউট ড্রেস। তারপরে এলোপাতাড়ি আমাকে দুজন একসঙ্গে পেটাতে থাকে। খুব সম্ভব বেতের লাঠি দিয়ে। পরে আমাকে অসংখ্যবার টর্চার করেছে এবং মারতে মারতে আমার এমন হয়েছে যে-চোখে বাঁধা কাপড় খুলে গেছে। নাকে-মুখে চড়, থাপ্পড় তো ছিলই। এছাড়া শুধু পেছনে মেরেছে। ওই সময়ে চামড়া ছিঁড়ে, মানে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরে গেছে।

৫৬ বছর বয়সি এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, নির্যাতনের একপর্যায়ে আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়।

র‌্যাব-১০ কর্তৃক গুমের শিকার এক বক্তি জানান, গ্রিলের মধ্যে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখত। আমি যাতে বসতে না পারি। একদিন আঙুলে প্লাস দিয়ে ধরেছে। আরেকজন সুঁচ ঢুকিয়েছে।

কমিশনকে একাধিক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, মুখের ভেতর গামছা দিয়ে পানি দেওয়া, ঘূর্ণায়মান চেয়ারে বসিয়ে নির্যাতন, প্রসাবের সময় বৈদ্যুতিক শক, গোপনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।

২০১০ সালে র‌্যাব কর্তৃক ৪৬ দিন গুম থাকা এক যুবক জানিয়েছেন, পায়ে দুইটা ক্লিপ লাগিয়ে শক দেওয়া হতো। টোটাল শরীরটা ফুটবলের মতো গোল হয়ে যেত। এরকম আট-দশবার আমাকে শক দিছে। কখনো একই ক্লিপ গোপনাঙ্গে লাগিয়ে শক দিত।

এদিকে ভুক্তভোগীদের অনেকে যুগান্তরকে জানান, সবচেয়ে বড় কষ্টের বিষয় হলো-যারা এভাবে গুম করে পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়েছে তাদের বেশির ভাগ এখনো চাকরিতে বহাল আছে। গ্রেফতার করা তো দূরের কথা, তাদের কোনো শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এর চেয়েও ভয়াবহ গুম সংস্কৃতি ফিরে আসবে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews