সামরিক অভিবাদনে শেষ বিদায় সম্পন্ন হলো বিউগলের লাস্ট পোস্টে। মানিক মিয়া এভিনিউয়ে তখন লাখ লাখ শোকার্ত মানুষের প্রতীক্ষা, তাদের প্রিয় মানুষের জন্য ইতিহাসের বৃহত্তম জানাজায় অংশগ্রহণের আকাঙ্ক্ষায়। সে এক অবিস্মরণীয় শোকাবহ দৃশ্য। ঢাকা আর আশপাশের শহরের কোনো সক্ষম ব্যক্তি সেদিন ঘরে বসে ছিল না।

চট্টগ্রাম। ৩০ মে ১৯৮১। রাতের চতুর্থ প্রহর। ঘড়ির কাঁটায় ২.৩০ মিনিট। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের এক কর্মব্যস্ত শুক্রবার সবে শনিবারে গড়িয়েছে, মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। চারদিকে সুনসান নীরবতা, একটু আগের মুষলধারার বৃষ্টি আর বজ্রপাত সামান্য কমলেও মে মাসের তীব্র গরমকে সেটা আরও ভ্যাপসা করে তুলেছে। প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যেই কালুরঘাট ব্রিজের কাছে লে. কর্নেল দেলোয়ারের বাসায় বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিধারা বদলে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের সভায় যোগ দিয়েছে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে আসা কয়েকজন মাঝারি সেনা কর্মকর্তা, ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের কৌশল বর্ণনা করছে সকালেই রাঙ্গামাটি থেকে আসা লে. কর্নেল মতিউর রহমান। তিনটি পৃথক দলে সার্কিট হাউজ আক্রমণের দায়িত্ব বণ্টনের নির্দেশনা তার।

সারা দেশের মতো চট্টগ্রাম শহরও সেদিন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। রাষ্ট্রপতি জিয়া সে রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের ভিআইপি কক্ষে তাহাজ্জুদ শেষ করে ফজরের প্রতীক্ষায়, পরিধানে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা। হঠাৎই চারদিক কাঁপিয়ে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ রাষ্ট্রপতির কক্ষ লক্ষ করে। লে. কর্নেল ফজলে হাসানের নিক্ষিপ্ত দুটো রকেট শেল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সার্কিট হাউজের দোতলায় তার শয়নকক্ষের নিচের কার্নিশের একটা অংশ গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ঘটনা কী দেখতে দরজা খুলে সিঁড়ির দিকে এগোতেই সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত গতিতে উঠে আসা একদল সেনার সামনাসামনি রাষ্ট্রপতি।

প্রায় অরক্ষিত সার্কিট হাউজের দোতলায় বিনা বাধায় উঠে আসা প্রথম দলে ক্যাপ্টেন মোসলেহউদ্দীনের বলা-‘আমাদের সঙ্গে যেতে হবে স্যার’-কথাগুলো পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই দ্বিতীয় দলের সামনে থাকা আকণ্ঠ মদের নেশায় টলায়মান অপ্রকৃতিস্থ লে. কর্নেল মতিউর রাষ্ট্রপতিকে লক্ষ করে সাব মেশিনগানের ম্যাগাজিনের সবকটা গুলিতে রাষ্ট্রপতির মাথা আর বুকে ২৭টি বুলেটের নির্মম প্রাণঘাতী আঘাত। এমন আকস্মিক আক্রমণে হতভম্ব লে. কর্নেল মতির সঙ্গে আসা অন্য সেনারা, কিংকর্তব্যবিমূঢ় সেনাদল একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে অধিক দ্রুততায় নেমে গেল নিচে, ষড়যন্ত্র পরিকল্পনায় রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করার কথা তো ছিল না! সিঁড়ির গোড়ায় পড়ে রইল রাষ্ট্রপতির নিথর দেহ। ২০০ কিলোমিটার দূরে ঢাকা সেনানিবাসের বাড়িতে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন দুই কিশোর তারেক আর আরাফাতের ললাট লিখনে পিতৃহারার চিরস্থায়ী চিহ্ন রচিত হলো সবার অগোচরে। ‘কাল সকালেই ফিরব ইনশাআল্লাহ’-বেগম জিয়াকে কয়েক ঘণ্টা আগে দেওয়া শেষ প্রতিশ্রুতি অপূর্ণই রয়ে গেল। এক মাতাল ঘাতকের বুলেটে তার জন্য নির্ধারিত হলো এক দীর্ঘ বৈধব্য যাত্রার-তিনি জানতেও পারলেন না। মাত্র বিশ মিনিটের এক হঠকারী অভিযানে নিশ্চিহ্ন হলো বাংলাদেশের সম্ভাবনার অগ্রযাত্রা, নিদ্রাচ্ছন্ন দেশবাসীর অগোচরে।

চট্টগ্রাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ আর শহীদ জিয়া, একসঙ্গে জড়িয়ে থাকা তিনটি অবিচ্ছেদ্য নাম। এক তরুণ মেজর জিয়া জীবনের মায়া তুচ্ছ করে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা, দায়িত্ব পালন করেছিলেন জেড ফোর্স আর এক নম্বর সেক্টর কমান্ডারের। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন চট্টগ্রাম তার দ্বিতীয় বাসস্থান। বগুড়ার বাগবাড়িতে জন্ম নেওয়া সেই ক্ষণজন্মা মানুষটি আজ নিথর পড়ে আছেন তার প্রিয় দ্বিতীয় বাসভূমিতে। সাগরের ঢেউ ছুঁয়ে, সবুজ পাহাড়ের গা-বেয়ে ভেসে আসা ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে তার প্রাণহীন দেহে। তারুণ্যের সন্ধিক্ষণে সব ভয়কে জয় করে দৃঢ়চিত্তে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেশপ্রেমের সঙ্গে সাহসিকতার যে প্রমাণ সেদিন বিশ্ববাসীকে তিনি দিয়েছিলেন, দেশের শতকোটি মানুষের ভালোবাসায় ধন্য হয়ে দেশমাতৃকার মাটির সঙ্গে নিজের উষ্ণ রক্তস্রোত একাকার করে আজ আবারও প্রমাণ করলেন দেশপ্রেমের শ্রেষ্ঠতম উদাহরণের নাম জিয়াউর রহমান।

অথচ ২৯ মে’র সকালটা ছিল অন্যরকম। চট্টগ্রাম বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মেটাতে হঠাৎ চট্টগ্রামে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন দলের চেয়ারম্যান হিসাবে। এলেন ইরান-ইরাক যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে আল-কুদস কমিটির সভা বিলম্বিত করে। চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পরিস্থিতি একটু ঘোলাটে, এ সতর্কতায় সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান জেনারেল মোহাব্বত জান চৌধুরী তাকে চট্টগ্রাম যেতে নিষেধ করেছিলেন, রাষ্ট্রপতি জিয়া অবজ্ঞা করলেন সতর্কবাণী। গোয়েন্দাপ্রধান দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাষ্ট্রপতিকে বিনয়ের সঙ্গে অন্তত রাতযাপন না করতে অনুরোধ করলেন। সতর্কতার একটিও কাজে এলো না। একজন প্রকৃত মুসলমান হিসাবে তিনি সবসময়ই বিশ্বাস করতেন, জন্ম-মৃত্যু সম্পূর্ণ পূর্বনির্ধারিত। প্রায় অরক্ষিত চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে গার্ড রেজিমেন্টের গুটিকয়েক সৈন্য আর দোতলায় দুজন দেহরক্ষী রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার জন্য মোটেও যথেষ্ট ছিল না। রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ বিমানের নিয়মিত ফ্লাইটে চট্টগ্রামে পৌঁছালেন ২৯ মে সকালে, সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির মহাসচিব অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমেনা রহমান। বিমানবন্দরের অভ্যর্থনা লাইনে অনুপস্থিত দেখলেন চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে। সেনাবাহিনী প্রধান এরশাদের পরামর্শে জেনারেল মঞ্জুর তখন স্টাফ কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে বদলির আদেশপ্রাপ্ত। রাষ্ট্রপতি জিয়া আর জেনারেল মঞ্জুরের ঘনিষ্ঠতার কথা সেনাবাহিনীতে সবারই জানা। প্রখর বুদ্ধিমত্তার জন্য সবাই মঞ্জুরকে জানে ‘পণ্ডিত’ হিসাবে। সার্কিট হাউজে পৌঁছেই চেয়ারম্যান জিয়া শুরু করলেন চট্টগ্রাম বিএনপির সাংগঠনিক সভা। মাঝে কাছেই চকবাজারের চন্দনপুরা মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করলেন, নামাজ শেষে কুশল বিনিময় করলেন মুসল্লিদের সঙ্গে। দুপুরে মধ্যাহ্নভোজে বরাবরের মতো সাদামাটা ডাল-ভাত। তারপর আবারও ম্যারাথন মিটিং রাত ১১টা অব্দি। চট্টগ্রামের বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে নির্ধারিত সভা বাতিল হলো সন্ধ্যার পর। ওদিকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বাইরে প্রণীত হচ্ছে এক হঠকারী পরিকল্পনার নকশা। রক্তপাতহীন পরিকল্পনা পর্যবসিত হলো এক নিষ্ঠুর অমানবিক হত্যাকাণ্ডে।

ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় জেনারেল মঞ্জুর হলেন খলনায়ক, পরিষ্কার দেখতে পেলেন নিয়তি আর কলঙ্কময় পরাজয়। বিচারপতি সাত্তার দায়িত্ব নিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির। সবার সমর্থন হারানো জেনারেল মঞ্জুর বান্দরবানের দিকে পালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন সপরিবারে, সঙ্গে লে. কর্নেল মাহবুব আর মোজাফফরের পরিবার। রাস্তায় গাড়ি নষ্ট হলে আশ্রয় নিলেন ফটিকছড়িতে এক পাহাড়ি পরিবারে, কিন্তু তাদের অবস্থান টের পেয়ে সেনাবাহিনীর অনুগত দলের বেষ্টনীতে পড়ে গেলেন, গোলাগুলিতে নিহত হলো লে. কর্নেল মতি আর লে. কর্নেল মাহবুব। রাষ্ট্রপতি জিয়ার মূল হত্যাকারীর শোচনীয় মৃত্যু হলো ৪৮ ঘণ্টা পেরোনোর আগেই। পালিয়ে গেল মেজর মোজাফফর। জেনারেল মঞ্জুর ধরা পড়লেন, তাকে আনা হলো হাটহাজারী থানায় পুলিশ হেফাজতে। নিজের পরিণতি আর সম্ভাব্য ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে বারবার অনুরোধ করছেন তাকে যেন সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর না করা হয়। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল কুদ্দুস থেকে শুরু করে ডিআইজি শাহজাহান সাহেব, কেউই তার অনুরোধ রাখেননি। ওসি কুদ্দুস ক্যাপ্টেন এমদাদের কাছে হস্তান্তর করল জেনারেল মঞ্জুরকে, হাত-পা বাঁধা জেনারেল মঞ্জুরকে গাড়িতে তোলা হলো চরম অপমানজনকভাবে, তারপর নেওয়া হলো চট্টগ্রাম সেনানিবাসে। সেখানে উপস্থিত দুজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার একজনের গুলিতে সেই রাতেই নিহত হলেন জেনারেল মঞ্জুর। পরদিন সামরিক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হলো, বিক্ষুব্ধ সেনাসদস্যের হাতে নিহত হয়েছেন তিনি। অন্যদিকে ডা. লে. কর্নেল তোফায়েলের পোস্টমর্টেম রিপোর্টে পাওয়া গেল ভিন্ন তথ্য-‘মঞ্জুরের মাথায় একটিমাত্র গুলি’। তড়িঘড়ি দাফন করা হলো তাকে, জীবিত বা মৃত কোনোভাবেই তাকে ঢাকায় পাঠানো হলো না। রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের অন্যতম সূত্র জেনারেল মঞ্জুরকে সরিয়ে দেওয়া হলো পৃথিবী থেকে। রাজধানীর বাইরে বিচ্ছিন্ন এক সেনানিবাসে বিদ্রোহ করে ক্ষমতা পরিবর্তন যে প্রায় অসম্ভব, মঞ্জুরের মতো একজন সেনানায়কের সেটা না জানার কথা নয়। রহস্য আর জিজ্ঞাসার এ অংশটুকু আজও অনুদঘাটিতই রয়ে গেল।

জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি আর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা যে আঞ্চলিক আর আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর গাত্রদাহের কারণ, তারাই জিয়াউর রহমানের অস্তিত্ব বিলীন করতে চাইবে এ সরল সত্য বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচিত করার প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করার জন্য জেনারেল মঞ্জুরের বিচার বা বেঁচে থাকার সুযোগ ছিল না।

এদিকে ৩০ তারিখ সকালে মেজর শওকত আলী ও মোজাফ্ফরের নেতৃত্বে রাষ্ট্রপতি জিয়ার কার্পেট মোড়ানো মৃতদেহ সার্কিট হাউজ থেকে সকাল সাড়ে ৯টায় সেনাবাহিনীর গাড়িতে নেওয়া হলো অজ্ঞাত স্থানে, লোকচক্ষুর অন্তরালে দাফনের উদ্দেশ্যে।

অসম্ভব জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় সম্ভাব্য জনরোষ এড়াতে সার্কিট হাউজ থেকে ২২ মাইল দূরে রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ের ঢালে তড়িঘড়ি করে যেনতেনভাবে জানাজা করে তার মৃতদেহ অসম্মানজনক দাফনের নামে একরকম মাটিচাপা দেওয়া হলো। বিদ্রোহের নামে সংঘটিত হঠকারী সেনা তৎপরতা থেমে গেল স্বাভাবিকভাবেই, ঘাতকের দল ধরা পড়ল অনুগত সেনাবাহিনীর হাতে, নয়তো পালিয়ে গেল। পরিস্থিতি শান্ত হতেই ১ জুন সকালে প্রথমেই শুরু হলো শহীদ রাষ্ট্রপতির মৃতদেহের খোঁজ। কর্নেল হান্নান শাহের নেতৃত্বে সেনাদল কিছুক্ষণের মধ্যেই রাঙ্গুনিয়ায় বাংলাদেশ টোব্যাকো কোম্পানির পেছনের পাহাড়ের ঢালের অগভীর গর্ত থেকে উদ্ধার করল রাষ্ট্রপতির মৃতদেহ। সেটি নেওয়া হলো চট্টগ্রাম সেনানিবাসে, মৃতদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করলেন সেনাবাহিনীর প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ লে. কর্নেল ডা. তোফায়েল আহমেদ। ময়নাতদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ড্রেসিং করে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন, ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ এদের তত্ত্বাবধানে বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমানে পাঠানো হলো ঢাকায়। পুরোনো বিমানবন্দরে সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সেই হৃদয়বিদারক মুহূর্তের মুখোমুখি হলেন বেগম খালেদা জিয়া আর তার দুই কিশোর পুত্র। সামরিক অভিবাদনে শেষ বিদায় সম্পন্ন হলো বিউগলের লাস্ট পোস্টে। মানিক মিয়া এভিনিউয়ে তখন লাখ লাখ শোকার্ত মানুষের প্রতীক্ষা, তাদের প্রিয় মানুষের জন্য ইতিহাসের বৃহত্তম জানাজায় অংশগ্রহণের আকাঙ্ক্ষায়। সে এক অবিস্মরণীয় শোকাবহ দৃশ্য। ঢাকা আর আশপাশের শহরের কোনো সক্ষম ব্যক্তি সেদিন ঘরে বসে ছিল না। এদিকে ১ জুন বিকালে একইসঙ্গে বিশাল জনসমুদ্রে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত হলো গায়েবানা জানাজা। চট্টগ্রামের ইতিহাসে কোনো জানাজা দূরে থাক, কোনো জনসভাতেও লালদীঘির ময়দান এত জনসমাগম হয়নি। এর আগে ঢাকা স্টেডিয়ামেও এক অবিস্মরণীয় গায়েবানা জানাজা অনিুষ্ঠিত হয়েছে ৩১ মে। বিশ্ববাসী সেদিন সেই জনসমুদ্র দেখে উপলব্ধি করলেন শহীদ জিয়া কতটা জনপ্রিয় দেশবাসীর কাছে। আর গৃহকোণে স্বজন হারানোর শোকে অশ্রুসজল সারা দেশের অগণিত মা-বোনেরা, স্তব্ধ সমগ্র বাংলাদেশ। সারা দেশে ৪০ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষিত হলো।

জিয়া হত্যাকাণ্ডে কিছু সামরিক কর্মকর্তা অংশ নিলেও একজন সাধারণ সৈনিকও এ অপকর্মে অংশ নিতে রাজি হয়নি। দেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে স্বজন হারানোর ব্যথা একেকটি অধ্যায়ের মতো সেদিন প্রতিফলিত হচ্ছিল স্মৃতির পাতায়।

রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতায় এক তরুণ মেজরের স্বাধীনতার ঘোষণা, ১৯৭১-এর ২৬ মার্চে জেড ফোর্সের অধিনায়কত্ব, ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর দিশাহীন জাতির সামনে আশার আলোকবর্তিকা হয়ে আবির্ভাব, তলাবিহীন দুর্ভিক্ষকবলিত বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এনে দেওয়া, একদলীয় বাকশালের শৃঙ্খল থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রে উত্তরণ, শৃঙ্খলিত গণমাধ্যমকে অবারিত মুক্তির আস্বাদ দেওয়া, মুসলিম বিশ্বে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, পূর্ব আর পশ্চিমের বিশ্বকে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ করা, খাল খননে সারা বছরের ফসলের সম্ভাবনা সৃষ্টি, আঞ্চলিক সহযোগিতায় সার্কের ধারণার জন্ম দেওয়া, তৈরি পোশাক আর মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারের সম্ভাবনায় অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন, সততা, দেশপ্রেম আর স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে এক প্রকৃত জনবান্ধব রাষ্ট্রপতির দেখা পাওয়া, উষর আরাফাতের মরুভূমিতে জিয়া-ট্রি’র সুশীতল ছায়ায় চিরস্থায়ী সম্মানের আসনে বাংলাদেশকে পৌঁছে দেওয়া, আত্মার আত্মীয় এ মানুষটি আর নেই। এ শোকাবহ সত্যের মুখোমুখি হওয়ার বেদনা সেদিন দেশের সব মানুষের হৃদয়ে।

সবাইকে কাঁদিয়ে এ প্রিয় মানুষটির শেষ ঠিকানা আজ সংসদ ভবনের উত্তরে জিয়া উদ্যানের সবুজ শয্যায়, মানুষের ভালোবাসায় যা আজও ভাস্বর আর শুভকামনায় সিক্ত।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ৪৫ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনের প্রতিটি ছত্র পরিপূর্ণ সফলতার সোনালি গাঁথায়। তবে তার শাহাদত প্রশ্ন রেখে গেছে অজস্র, যার উত্তর আজও অজানা আমাদের! অসম্ভব জনপ্রিয় এ রাষ্ট্রনায়ককে কেন ঘাতকের বুলেটে প্রাণ দিতে হলো? তার হত্যার সঙ্গে ‘তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের সংশ্লিষ্টতা কতটা?’ সেই সত্য কেন উদ্ঘাটিত হলো না? কেন ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটনের গভীরে যাওয়ার যোগসূত্র ‘জেনারেল মঞ্জুরকে’ পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হলো? বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের প্রতীক রাষ্ট্রপতি জিয়াকে নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমে সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগীদের সংশ্লিষ্টতা কেন সামনে এলো না? আওয়ামী নেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ১৩ দিনের মাথায় জিয়ার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো, বিষয়টি কি নিছকই কাকতালীয়? মুসলিম বিশ্বে ক্রমবর্ধমানভাবে জনপ্রিয় আর বাংলাদেশকে স্থিতিশীল সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ায় যাদের গাত্রদাহ, সেসব বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার সত্য কেন আজও উদ্ঘাটিত হলো না? ৩০ মে সংঘটিত ঘটনায় শুধু সেনা বিদ্রোহের বিচার, শহীদ জিয়া হত্যার বিচার হয়েছে কি?

ইতিহাসের কাছে এসব প্রশ্নের জবাবের প্রতীক্ষায় রইল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের আকাশে যতদিন লাল-সবুজের পতাকা উড্ডীন থাকবে, ততদিনই প্রশ্নহীনভাবে একজনের নাম গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হবে-জিয়াউর রহমান।

অধ্যাপক ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল : আহ্বায়ক, বিএনপি মিডিয়া সেল



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews