নয়া দিগন্ত ডেস্ক

কবি ও রাষ্ট্র চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেছেন, কিছু কিছু মহল থেকে সেনাপ্রধানের সমালোচনার আমরা ঘোর বিরোধী। আমাদের কাছে তা অন্তর্ঘাতমূলক মনে হয়েছে। কারণ সেনাবাহিনী একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান, তার সুরক্ষা নিশ্চিত করা জাতীয় স্বার্থেই আমাদের দরকার। করিডোর ও চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশী অপারেটরদের হাতে তুলে দেয়া এবং অন্যন্য বিষয়ে সেনাপ্রধানের উদ্বিগ্নতা ও আপত্তি খুবই যৌক্তিক। কিন্তু এই সব বিষয়ে সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি কোন বক্তব্য দিতে পারেন না- সেটি হবে তার এখতিয়ারবহির্ভূত।

গত শুক্রবার রাত ১২টা ৪ মিনিটে ফরহাদ মজহার তার ফেসবুক পেজে এ মন্তব্য করেন। ফরহাদ মজহারের ফেসবুক পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো : বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত এবং গণ-অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি হওয়ার কারণে রাজনৈতিকভাবে বৈধ এবং জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার। এই সরকারকে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনে শপথ নিতে বাধ্য করে সরকারের ক্ষমতাকে সঙ্কুচিত ও সংকীর্ণ করে রাখা হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানকে শুরু থেকেই নস্যাৎ করবার চেষ্টা চলছে। গণ-অভ্যুত্থানকে অস্বীকার করা এবং সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে দুর্বল করে রাখা আমাদের প্রধান রাজনৈতিক সঙ্কট। তার কুফল পরিকল্পিত ভাবে গণ-অভ্যুত্থান বিরোধী শক্তি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী শক্তির ওপর ক্রমাগত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে আসছে। এটি হচ্ছে আওয়ামী-ফ্যাসিস্ট শক্তিকে আবার ক্ষমতায় আনার পরিচিত কৌশল।

আমরা সবসময় প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের মধ্যে আন্তরিক ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দাবি ও প্রত্যাশা করে এসেছি। কিছু কিছু মহল থেকে সেনাপ্রধানকে ব্যক্তিগতভাবে সমালোচনার আমরা ঘোর বিরোধী এবং আমাদের কাছে তা অন্তর্ঘাতমূলক মনে হয়েছে। কারণ সেনাবাহিনী একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান, তার সুরক্ষা নিশ্চিত করা জাতীয় স্বার্থেই আমাদের দরকার। আমরা তাই সবসময় সেনাপ্রধানের সদিচ্ছায় আস্থা রেখেছি। করিডোর ও চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশী অপারেটরদের হাতে তুলে দেয়া এবং অন্যান্য বিষয়ে সেনাপ্রধানের উদ্বিগ্নতা ও আপত্তিকে আমরা খুবই যৌক্তিক মনে করি। সে বিষয়ে আমরা কথা বলে চলেছি। কিন্তু এই সব বিষয়ে সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে পারেন না। সেটি হবে তার এখতিয়ারবহির্ভূত। আইনি ও রাজনৈতিক বৈধতার বিচারে সেনাপ্রধানের নিজের এখতিয়ারবহির্ভূত বিষয়ে মন্তব্য সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী। তার বক্তব্য গভীর রাজনৈতিক সঙ্কটে দেশকে নিক্ষেপ করতে পারে। এ ব্যাপারে সেনাপ্রধানের কিছু বক্তব্যের সূত্র ধরে আমরা আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে রাখতে চাই। আমাদের আশা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তিনি তা বুঝবেন এবং প্রধান উপদেষ্টার সাথে তার দূরত্ব কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেবেন।

১. ‘আমার অভিভাবক নেই’ এই বক্তব্য গণ-অভ্যুত্থানবিরোধী অবস্থান।

সেনাপ্রধান বলেছেন

“আমি এমন এক অবস্থানে আছি, যেখানে আমার কোনো অভিভাবক নেই।” এই বক্তব্য রাষ্ট্রতাত্ত্বিকভাবে বিপজ্জনক, কারণ এটি popular sovereignty বা জনগণের সার্বভৌম কর্তৃত্ব অস্বীকার এবং “military exceptionalism”-এর দাবি। এর মধ্য দিয়ে তিনি বিদ্যমান রাষ্ট্র ও সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেছেন।

গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই পরবর্তী নির্বাচিত সরকার গঠিত হওয়া পর্যন্ত জনগণের সর্বোচ্চ অভিভাবক। সেই ক্ষেত্রে নিজেকে ‘অভিভাবকহীন’ বলা মানে সরকার ও জনগণের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করা। এটি গণসার্বভৌমত্বের বিরোধিতা এবং ডি ফ্যাক্টো সামরিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা।

২. ‘নির্বাচিত সরকার ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না’ এই বক্তব্য ব্যবস্থাগত স্বৈরতন্ত্রের ইঙ্গিত।

সেনাপ্রধান বলেন

“এসব সিদ্ধান্ত শুধু একটি নির্বাচিত সরকারই নিতে পারে।’

এই বক্তব্যের সমস্যা দু’টি

প্রথমত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর জনআস্থাভিত্তিক সরকার হয়, তবে ‘নির্বাচিত’ না হওয়া সত্ত্বেও সেই সরকার গণ-ক্ষমতার প্রতিনিধি হতে পারে, যেমন ছিল ১৯৭২ স্বাধীনিতা যুদ্ধ-পরবর্তী সরকার।

দ্বিতীয়ত, তিনি যেভাবে নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত ‘নেয়া যাবে না’ বলছেন, তা রাষ্ট্রচিন্তার ধারাবাহিকতা ভেঙে সেনাবাহিনীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাপকাঠি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। এটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত গণ-অভিপ্রায়ের ধারক অন্তর্বর্তী সরকারবিরোধী দাবি, এর মধ্য দিয়ে সেনাপ্রধান কার্যত সামরিক 'veto’ দেয়ার ক্ষমতার দাবি করছেন, যা তাকে জনগণের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

৩. ‘সেনাবাহিনী শেষ ভরসা’ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য ধ্বংসের প্রচেষ্টা

তিনি বলেন, “পুলিশ ও প্রশাসন ব্যর্থ, সেনাবাহিনীই শেষ ভরসা।”

রাষ্ট্রতত্ত্ব অনুযায়ী, পুলিশ, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন সব মিলেই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ক্ষমতার বিভাজন (separation of powers) গঠন করে। সেনাবাহিনীকে ‘শেষ ভরসা’ বলার অর্থ এই প্রতিষ্ঠানকে ‘সার্বিক নিয়ন্ত্রণকারী মহাশক্তি’ রূপে দাবি করা।

৪. নির্বাচনপূর্ব সময় নির্ধারণের দাবি : ‘২০২৬ সালের ১ জানুয়ারিতে নির্বাচিত সরকারকে বসতে হবে’

এটি জনগণের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সেনাবাহিনীর ‘সময়সূচি’ চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা।

গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসেছে, জনগণের ইচ্ছানুযায়ী এই সরকার নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করতে পারে। কিন্তু সেনাপ্রধান এই সময়সীমা চাপিয়ে দিয়ে একটি গণনির্দেশকে সামরিক আদেশে প্রতিস্থাপন করছেন। যা popular sovereignty বা গণসার্বভৌমত্বের বিরোধিতা।

৫. ‘অভ্যন্তরীণ সমালোচনার প্রতি দমনমূলক হুমকি’স্বৈরতন্ত্রের লক্ষণ

‘অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের তথ্য প্রকাশ করা হবে’; ‘দোষীদের শাস্তি হবে’; ‘কোনো মিথ্যা অভিযোগ সহ্য করা হবে না’।

এমন ভাষা বেসামরিক ও রাজনৈতিক পরিসরের মধ্যে প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনার জায়গা সঙ্কুচিত করে। রাষ্ট্র সেনাবাহিনীর সাংবিধানিক কর্তৃত্বের অধীন নয়। রাজনৈতিক বিরোধিতাকে ‘দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র’ রূপে চিহ্নিত করার ভাষা সঠিক নয়।

৬. ‘আমরা আরো কঠোর হবো’ রাষ্ট্রশক্তিকে জবরদস্তির দিকে ঠেলে দেয়া

এটি সরাসরি popular mobilization বা গণপ্রতিরোধকে ‘ব্যাধি’ রূপে চিহ্নিত করে দমনযোগ্য শৃঙ্খলাভঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করছে।

আমরা জনগণের কাছে সেনাপ্রধানের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হোক চাই না। আমরা গভীর সঙ্কটে রয়েছি। এই সঙ্কট থেকে উদ্ধার পেতে হলে আমাদের চাই বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞা। সর্বোপরি জনগণের অভিপ্রায়কে ধারণ করতে শেখা।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews