ছাত্র ইউনিয়ন। বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির আঁতুরঘর। বামপন্থী এই ছাত্রসংগঠনটির হাত ধরেই শোষণমুক্ত, সাম্যবাদী, সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির দীক্ষা পেয়েছেন হাজারও তরূণ যুবা। তাদের উদ্দীপ্ত তারুণ্যের হাত ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এসেছে বহু মানবিক পরিবর্তন। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে এ সংগঠনটি প্রগতিশীলতার ধারক বাহক। ছাত্র ইউনিয়নের অনেক নেতা-কর্মীই তাদের মেধা, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, আদর্শের প্রতি অবিচলতার কারণে ছাত্র রাজনীতির গন্ডি পেরিয়ে দৃঢ় অবস্থান গড়ে নিয়েছেন জাতীয় রাজনীতিতে। এছাড়াও রাজনীতির বাইরে যে যেখানেই আছেন স্বীয় যোগ্যতা বলেই নিজস্ব অবস্থান গড়ে নিয়েছেন, নিজের নিজের সাধ্যমত পালটে দিচ্ছেন সমাজের কদর্যতা।
ছাত্র ইউনিয়নের নেতার-কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নাম বেগম মতিয়া চৌধুরী। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অগ্নিকন্যা নামে সুপরিচিত এই স্বাধীনতার আগে ও পরে দৃঢ় হস্তে নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্র ইউনিয়নকে, লড়েছেন বাঙালির স্বাধীনতার জন্য, ছিলেন ডাকসুর ভিপি। আওয়ামী লীগের টিকিটে দুইবারের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর সময়েই বাংলাদেশ প্রথম খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। তারই সময়কার আরেক জাঁদরেল নেতা রাশেদ খান মেন ১৯৬৫ সালে নেতৃত্বের দ্বন্দে সংগঠনটির একটি অংশ নিয়ে বিভক্ত হয়ে যান। দীর্ঘদিন বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির কান্ডারি থাকলেও ২০০৮ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে জোট বেধে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী।
১৯৭০-১৯৭২ সাল পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন নুরুল ইসলাম নাহিদ। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বাধীন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির স্টিয়ারিং কমিটির এ সদস্য ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে যোগ দেন সিপিবিতে। ১৯৯১ সালে তিনি সিপিবির সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৯৪ সালে কয়েকজন রাজনৈতিক সহকর্মীকে নিয়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ১৯৯৬ সালে তিনি সিলেট-৬ আসন থেকে আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৮ ও ২০১৪ নির্বাচনে এমপি হন তিনি। বর্তমান সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন তিনি। ১৯৭৩ থেকে ৭৬ সাল পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন নূহ-উল-আলম লেনিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করেন যোগ দেন সিপিবিতে। ১৯৯৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। এককালের এই তুখোড় ছাত্রনেতা কখনোই অংশ নেননি সংসদ নির্বাচনে।
১৯৮০ সালের শেষের দিকে ছাত্র ইউনিয়ের সভাপতির পদে আসেন আব্দুল মান্নান খান। পরবর্তীতে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। পেশায় আইনজীবী এই নেতা ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে গত সরকারের আমলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে একই আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল। পরবর্তীতে যোগ দেন বিএনপিতে। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে জামালপুর-৩ আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মির্জা আজমের কাছে হেরে যান।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতির পদে ছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনিও ডাকসুর ভিপি ছিলেন। ছাত্র রাজনীতি থেকে যোগ দেন সিপিবিতে। বর্তমানে সিপিবির কেন্দ্রীয় সভাপতি। ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি রুহিন হোসেন প্রিন্স খুলনা বিএল কলেজ থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন। বর্তমানে সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সালের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন বর্তমানে সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সেক্রেটারি তিনি। ১৯৯৬-১৯৯৭ কমিটির সভাপতি আসলাম খান সিপিবির সহযোগী সংগঠন ট্রেড ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা। ১৯৯৭-১৯৯৯ সেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল বর্তমানে সিপিবির সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সভাপতি। ২০০০ থেকে ২০০২ সালের সভাপতি হাসান তারিক চৌধুরী সোহেল বর্তমানে সিপিবির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। ২০০২-২০০৩ সালের ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি শরিফুজ্জামান শরিফ বর্তমানে সিপিবির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ২০০৩২০০৪ সালে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি লুনা নূর সিপিবির উইমেন সেল দেখভাল করেন।
২০০৪-২০০৬ সাল পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন বাকি বিল্লাহ। ২০০৬-২০০৮ সালের ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন শামছুল আলম সজ্জন। ২০০৯-২০১১ সালে কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন মানবেন্দ্র দেব। তিনি ১/১১-এর সময় অগাস্ট ছাত্রবিদ্রোহে কারাবন্দি হন। বর্তমানে সিপিবির সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা তিনি। ২০১১-২০১২ সালে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল। ২০১২-২০১৪ সালের সভাপতি এস এম শুভ। ২০১৪ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন হাসান তারেক। ছাত্র ইউনিয়নের সদ্য সাবেক কমিটির সভাপতি লাকি আক্তার। এরা সবাই গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় সংগঠক ছিলেন এবং বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সাথে জড়িত।