নানামত ও বিশ্লেষণ
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মেয়েরা এগোচ্ছে, ছেলেদের পিছিয়ে থাকলে চলবে না । নানা কারণে এইচএসসির এবারের ফল আলোচনার দাবি রাখে। জিপিএ-৫ পাওয়া বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের ফল বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহ বৃদ্ধির প্রতিফলন কিনা ভেবে দেখার অবকাশ আছে। যেখানে যশোরের ১০০ কলেজ গত বছর বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী পায়নি, সেখানে বিজ্ঞানে এবারের এইচএসসির ফল চমকে দেয়ারই মতো। সেই সঙ্গে পরীক্ষার ফল শিক্ষার গুণগত মান কতটুকু নিশ্চিত করে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তবে শহর ও মফস্বলের ফল ব্যবধান নিয়ে আলোচনা যেমন আছে, এর ব্যতিক্রমও লক্ষ করা যায়। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় এবার পৌর এলাকার কলেজের চেয়ে গ্রামের কলেজগুলো এগিয়ে। উপজেলার ছয়টি কলেজ থেকে ১৩ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। এদের মধ্যে পৌর শহরের দুটি কলেজ থেকে পাঁচজন এবং গ্রামের চারটি কলেজ থেকে আট শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। এছাড়া পাসের হারের দিক থেকেও গ্রামের কলেজগুলো এগিয়ে। এতদিন ট্রান্সক্রিপ্টে বিষয়ের বিপরীতে কেবল গ্রেড পয়েন্ট উল্লেখ করা হতো। বিষয়ভিত্তিক বা মোট নম্বর জানার সুযোগ ছিল না মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের। আদালতে একজন শিক্ষার্থীর একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ ১৩ বছর পর উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা এবার জিপিএর সঙ্গে সব বিষয়ের নম্বর জানার সুযোগ পাচ্ছে। চলতি বছর যারা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করেছে তারা নম্বর জানার এ সুযোগ পাবে না। তবে এরপর থেকে এসএসসি ও এইচএসসির সব পরীক্ষার নম্বর জানা যাবে। অবশ্য গ্রেডিং পদ্ধতি বহাল রেখে নম্বর জানানোর ভালো-মন্দ নিয়েও অনেকে কথা বলতে পারেন।
এবারের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, মানবিক শাখার অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে। ফলাফলের দিক দিয়ে বিজ্ঞান প্রথম। তারপর ব্যবসায় শিক্ষা। মানবিকের অবস্থান সব শেষে। ফলাফল ভালো হলেও ইংরেজির দক্ষতা কতটা বেড়েছে? শিক্ষামন্ত্রীর অভিমত, ভালো ফলের জন্য পাসের হার, জিপিএ-৫ প্রাপ্তিসহ যে ক’টি সূচক বিবেচনা করা হয়, তার সব ক’টিই এবার ইতিবাচক। গত বছর প্রথমবারের মতো আইসিটি বিষয় ছিল। তাতে শিক্ষার্থীরা গতবার খারাপ করলেও এবার ভালো করেছে। গত বছর ১২ বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন হয়েছিল। এবার তা বাড়িয়ে ১৯ বিষয়ে নতুন এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। শিক্ষার্থীরা এতেও ভালো করেছে। শিক্ষার্থীদের কিছু বিষয়ে দুর্বলতা আছে, বিশেষ করে বিজ্ঞান, ইংরেজি ও গণিতে। এ দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য একটি প্রকল্পের মাধ্যমে মফস্বলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কঠিন বিষয়ে বাড়তি ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। আগামীতে হয়তো শিক্ষার্থীরা আরও ভালো করবে। যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের মতে, দেশে রাজনৈতিক স্থিরতা, শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী হওয়া, মূল বই পাঠ ও অনুসরণ, শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার তৈরির মানসিকতা, সর্বোপরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরাসরি মোটিভেশনের কারণে এবার যশোর বোর্ড দেশের আটটি সাধারণ বোর্ডে পাসের দিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে। গত বছর যশোর শিক্ষা বোর্ডের ফল বিপর্যয়ের বিষয়টি তারা সিরিয়াসলি নেন। এরপর বোর্ড কর্তৃপক্ষ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। সেখানে অষ্টম, দশম ও দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। এতে শিক্ষার্থীরা উদ্বুদ্ধ হয়েছে বলেই এবার জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসির ফল বেশ ভালো। তিনি আরও মনে করেন, এবার পরীক্ষায় প্রশ্নও ভালো হয়েছে।
পরীক্ষায় ফেল থাকবে কেন?
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছর ফেল করা প্রায় সোয়া ৩ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার ৮০৪। মাদ্রাসা বোর্ডে ৮ হাজার ৯৭, কারিগরিতে ১৪ হাজার ১৭১ জন গত বছর ফেল করে। কিন্তু এবার অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীসহ মাদ্রাসা বোর্ডে ৮ হাজার ২৮৩ ও কারিগরিতে ১৩ হাজার ৩৯১ জন পরীক্ষা দেয়। এছাড়া ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত ডিআইবিএস পরীক্ষায় গত বছর ১ হাজার ৮৫ জন ফেল করে। তাদের মধ্যে ৮৬৩ জন এবার পরীক্ষা দিয়েছে। এ বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১০টি বোর্ডে মোট ফেল করেছে ৩ লাখ ৪ হাজার ৪৯০ জন, যা শতকরা হিসাবে মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ২৫ ভাগ। দেশের শিক্ষা বোর্ডগুলোর সার্বিক কার্যাবলী পরীক্ষা করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ১৯৯৭ সালে যে টাস্কফোর্স গঠিত হয় আমি তার সদস্য এবং একাডেমিক কমিটির আহ্বায়ক ছিলাম। ওই বছর ২৮ আগস্ট যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় তাতে ছিল : ‘যদি বলা হয় যে, পরীক্ষায় ফেল বলে কোনো শব্দ থাকবে না, তাহলে সবাই চমকে উঠবে। কিন্তু ... ফেল শব্দটি মুছে দিতে হবে। ...গরিব দেশের গরিব অভিভাবকদের সন্তানরা একবার ফেল করলে পরের বার আর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এতে অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অকালে ঝরে পড়ে।’ টাস্কফোর্স তার প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করে : ‘যারা কোচিং সেন্টার ও গাইড বইয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকবেন, পরীক্ষার কোনো পর্যায়ে তারা সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন না।’ সেই সঙ্গে টাস্কফোর্স সুপারিশ করে, ‘পূর্ববর্তী বছরের প্রশ্নপত্রের ভাষারও পুনরাবৃত্তি করা যাবে না।’
ভর্তির জন্য উৎকণ্ঠা ও উচ্চশিক্ষা
আমাদের মিডিয়া প্রতি বছরের মতো এবারও একটি বিষয়ে সোচ্চার। তাদের আশংকা, হাজার হাজার এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে না। এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের ভর্তির বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে অতীতে কোনোকালেই আসন সংকট হয়নি। এবারও হবে না। তবে উচ্চ ডিগ্রি অর্জনের জন্য সারা বিশ্বেই শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। পর্যাপ্ত আসন আছে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই নিয়মিত কোনো না কোনো নতুন বিভাগ চালু হচ্ছে। এতে আসন সংখ্যাও বাড়ছে। তাছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজে প্রতিবারই অসংখ্য আসন শূন্য থাকে। তাই আসন সংকটের কোনো আশংকা নেই বলেও শিক্ষামন্ত্রী জানান।
আমারও জানা নেই পৃথিবীর কোনো দেশ আছে কিনা, যেখানে সবাই পছন্দসই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে। আবার সবাই উচ্চশিক্ষায় যায় কিনা অথবা উচ্চশিক্ষার সংজ্ঞা কী? অতি সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর স্যার ক্রিস্টোফার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বলেছেন, উচ্চশিক্ষার পুরনো মডেল অকার্যকর হয়ে গেছে। সেখানে ইতিমধ্যে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী নতুন ভাবনা ও কর্মসূচি এসেছে, যা বাংলাদেশের মতো দেশের শিক্ষা উন্নয়ন ভাবনায় কাজে আসতে পারে। গবেষণার অপরিহার্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও এর প্রধান উপজীব্য হল লক্ষ্যহীন জ্ঞানচর্চার পরিবর্তে উন্নত জীবনের জন্য দক্ষতা সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ এবং দেশাত্মবোধ ও নৈতিক মূল্যবোধের জাগরণ। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার সব স্তর ও পর্যায়ে পরিবর্তনের এ ঢেউ আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হবে।
কুদরাত-এ-খুদা রিপোর্টের প্রাসঙ্গিকতা
১৯৭৪ সালেই ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় : শিক্ষার মাধ্যমিক স্তর বিস্তৃত হওয়া দরকার দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত। তবে কর্মজীবনে প্রবেশে ইচ্ছুকদের জন্য একাদশ শ্রেণী যথাযথ হতে পারে। এতে বলা হয়, ‘আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থার কথা বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদের পরিবেশ, জীবনযাত্রা, স্থানীয় অর্থনীতির কর্মধারা ও কর্মজীবনে প্রবেশের ভবিষ্যৎ কর্মসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির সুষ্ঠু প্রতিফলন মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যসূচিতে বাঞ্ছনীয়। কারণ নবম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর মধ্যে (অর্থাৎ বয়সসীমা ১৪ বছরের মধ্যে) প্রতি বছর গড়ে প্রায় সাড়ে চার লাখের মতো ছাত্রছাত্রী নানা কারণে স্কুলের পড়াশোনা ত্যাগ করে এবং পুরোপুরিভাবে সমাজজীবনে ফিরে আসতে বাধ্য হয়, অথচ জীবিকা অর্জনে সহায়ক তেমন কোনো প্রশিক্ষণ তারা পায় না। ফলে তাদের অধিকাংশই ব্যর্থতার গ্লানি ভোগ করে এবং বিক্ষুব্ধ মন নিয়ে সমাজের জীবনধারায় আপন সংকীর্ণ ভূমিকা পালন করে যায়। যে কোনো দেশের পক্ষে এ অবস্থা অত্যন্ত ক্ষতিকর। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জন্য প্রান্তিক শিক্ষা ও স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রান্তিক বৃত্তিমূলক শিক্ষা মোটামুটি একাদশ শ্রেণী এবং সাধারণ শিক্ষা দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে। এ উদ্দেশ্যে নবম শ্রেণী থেকে শিক্ষা কার্যক্রম মূলত দ্বিধাবিভক্ত হবে : (ক) বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও (খ) সাধারণ শিক্ষা। ...প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকালে আমাদের লক্ষ্য হবে অষ্টম শ্রেণী উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের শতকরা বিশ ভাগকে প্রস্তাবিত বৃত্তিমূলক শিক্ষাক্রমে নিয়ে আসা। পরবর্তী পরিকল্পনায় এ হারকে অন্তত শতকরা পঞ্চাশ ভাগে উন্নীত করতে হবে।’
এবারের এইচএসসি উত্তীর্ণরা যে সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে না অথবা স্নাতক/স্নাতকোত্তর প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর খাতায় নাম লেখাবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো কর্মমুখী শিক্ষা কার্যক্রমে তারা কতজন যুক্ত হতে পারে? সিঙ্গাপুরে ৬৪ শতাংশ এবং মালয়েশিয়ায় ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তরেই কর্মমুখী শিক্ষা বাছাই করে। কুদরাত-এ-খুদা রিপোর্টে ১৯৭৪ সালেই কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ২০ শতাংশ হওয়া উচিত বলে উল্লেখ করা হলেও ২০১৬ সালে এসেও তা অর্জন করা যায়নি। অথচ প্রতি বছর বিদেশ থেকে আসা দক্ষ কর্মীরা বছরে শুধু বেতন বাবদ ৪ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যায়। আমাদের দেশের বেকার জনগোষ্ঠীর একটা অংশ মালয়েশিয়ায় মশা ও সাপের কামড় খেয়ে আরব দেশগুলোতে অসহ্য গরমের মধ্যে পিচগলা রাস্তা পরিষ্কারের কাজ করে। দেশের ভেতরে কর্মবাজার তাদের কতটুকু আকর্ষণ করে? এ নিয়ে তাদের কতটুকু ধারণা আছে? প্রতি বছর ২০ লাখ তরুণের কর্মবাজারে প্রবেশের আপ্রাণ চেষ্টার কথা আমরা জানলেও আমাদের সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তারা এ দিকটা কতটুকু দেখেন? ইতিমধ্যে জানা যায়, কর্মদক্ষতা না থাকায় আমাদের দেশের তরুণরা ফিলিপাইন, ভারত, ভিয়েতনামের তুলনায় অনেক কম উপার্জন করে। আমাদের প্রবাসী মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন জেলায় প্রবাসী শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ট নয়। দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক এসব কর্মসূচিতে সমন্বয়েরও প্রয়োজন আছে।
পরীক্ষার ফল ও জীবনে সাফল্য
এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল সব দিক থেকেই ইতিবাচক বলতে হবে। শিক্ষার্থীর শ্রম, অভিভাবকের বিনিয়োগ, রাষ্ট্রের আনুকূল্য, সর্বোপরি শিক্ষকের পাঠদান ও নির্দেশনা এক্ষেত্রে কতটুকু অবদান রেখেছে এবং আরও রাখার সুযোগ আছে তা মূল্যায়নের সময় এসেছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞান মূল্যায়নের বিষয়কে খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে সামগ্রিক বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা দরকার বলে মনে করি। দেশ-বিদেশের উদাহরণ, ব্রিটিশ আমল থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন ও জরিপের প্রতিবেদন মূল্যায়ন, মিডিয়ার সহায়তা নিয়ে সব স্তর ও পর্যায়ে, বিশেষ করে তৃণমূলের শিক্ষক ও অভিভাবকদের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনার ভিত্তিতে প্রচলিত পাবলিক পরীক্ষার উপযোগিতা যাচাই করে একটি যুগোপযোগী জাতীয় পরীক্ষানীতি প্রণয়নের আবশ্যকতার দিকে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে আশা করব, এইচএসসির ফল তাদের কর্মজীবন তথা জীবনের পরীক্ষায়ও কাক্সিক্ষত সাফল্য এনে দেবে।
অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : শিক্ষক আন্দোলনের প্রবীণ নেতা। চেয়ারম্যান, ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (আইএইচডি)
[email protected]




১৮ আগস্ট এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বের হয়েছে। দেশের ১০টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি, আলিম ও এইচএসসি ভোকেশনাল পরীক্ষার ফলের প্রায় সব সূচকই ইতিবাচক। জিপিএতে শীর্ষে ঢাকা, পাসে যশোর। ৮৪৮ কলেজে সবাই পাস। ২৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করেনি। বিদেশ কেন্দ্রের পাসের হার ৯৩.৫০ শতাংশ। এ বছর মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ৩ হাজার ৬৪০। পাস করেছে ৮ লাখ ৯৯ হাজার ১৫০। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫৮ হাজার ২৭৬। পাসের হার গত বছরের তুলনায় বেড়েছে ৫.১০ শতাংশ। জিপিএ-৫ বেড়েছে ১৫ হাজার ৩৮২টি। বিজ্ঞান গ্রুপের ফল সবচেয়ে ভালো। পাসের হার ৮৩.০৪, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪১ হাজার ৪৬৮। ব্যবসায় শিক্ষায় পাসের হার ৭৪.৪৩, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ৭৩১। মানবিকে পাসের হার ৬৭.৩৭, জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ হাজার ৭৫১। নরসিংদীর আবদুল কাদির মোল্লা সিটি কলেজ এবারও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে নিজেদের সফলতা ধরে রেখেছে। এ নিয়ে টানা নয়বার শতভাগ পাসের সাফল্য দেখিয়েছে এ কলেজটি।নানামত ও বিশ্লেষণপ্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মেয়েরা এগোচ্ছে, ছেলেদের পিছিয়ে থাকলে চলবে না । নানা কারণে এইচএসসির এবারের ফল আলোচনার দাবি রাখে। জিপিএ-৫ পাওয়া বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের ফল বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহ বৃদ্ধির প্রতিফলন কিনা ভেবে দেখার অবকাশ আছে। যেখানে যশোরের ১০০ কলেজ গত বছর বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী পায়নি, সেখানে বিজ্ঞানে এবারের এইচএসসির ফল চমকে দেয়ারই মতো। সেই সঙ্গে পরীক্ষার ফল শিক্ষার গুণগত মান কতটুকু নিশ্চিত করে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তবে শহর ও মফস্বলের ফল ব্যবধান নিয়ে আলোচনা যেমন আছে, এর ব্যতিক্রমও লক্ষ করা যায়। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় এবার পৌর এলাকার কলেজের চেয়ে গ্রামের কলেজগুলো এগিয়ে। উপজেলার ছয়টি কলেজ থেকে ১৩ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। এদের মধ্যে পৌর শহরের দুটি কলেজ থেকে পাঁচজন এবং গ্রামের চারটি কলেজ থেকে আট শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। এছাড়া পাসের হারের দিক থেকেও গ্রামের কলেজগুলো এগিয়ে। এতদিন ট্রান্সক্রিপ্টে বিষয়ের বিপরীতে কেবল গ্রেড পয়েন্ট উল্লেখ করা হতো। বিষয়ভিত্তিক বা মোট নম্বর জানার সুযোগ ছিল না মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের। আদালতে একজন শিক্ষার্থীর একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ ১৩ বছর পর উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা এবার জিপিএর সঙ্গে সব বিষয়ের নম্বর জানার সুযোগ পাচ্ছে। চলতি বছর যারা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করেছে তারা নম্বর জানার এ সুযোগ পাবে না। তবে এরপর থেকে এসএসসি ও এইচএসসির সব পরীক্ষার নম্বর জানা যাবে। অবশ্য গ্রেডিং পদ্ধতি বহাল রেখে নম্বর জানানোর ভালো-মন্দ নিয়েও অনেকে কথা বলতে পারেন।এবারের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, মানবিক শাখার অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে। ফলাফলের দিক দিয়ে বিজ্ঞান প্রথম। তারপর ব্যবসায় শিক্ষা। মানবিকের অবস্থান সব শেষে। ফলাফল ভালো হলেও ইংরেজির দক্ষতা কতটা বেড়েছে? শিক্ষামন্ত্রীর অভিমত, ভালো ফলের জন্য পাসের হার, জিপিএ-৫ প্রাপ্তিসহ যে ক’টি সূচক বিবেচনা করা হয়, তার সব ক’টিই এবার ইতিবাচক। গত বছর প্রথমবারের মতো আইসিটি বিষয় ছিল। তাতে শিক্ষার্থীরা গতবার খারাপ করলেও এবার ভালো করেছে। গত বছর ১২ বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন হয়েছিল। এবার তা বাড়িয়ে ১৯ বিষয়ে নতুন এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। শিক্ষার্থীরা এতেও ভালো করেছে। শিক্ষার্থীদের কিছু বিষয়ে দুর্বলতা আছে, বিশেষ করে বিজ্ঞান, ইংরেজি ও গণিতে। এ দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য একটি প্রকল্পের মাধ্যমে মফস্বলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কঠিন বিষয়ে বাড়তি ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। আগামীতে হয়তো শিক্ষার্থীরা আরও ভালো করবে। যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের মতে, দেশে রাজনৈতিক স্থিরতা, শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী হওয়া, মূল বই পাঠ ও অনুসরণ, শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার তৈরির মানসিকতা, সর্বোপরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরাসরি মোটিভেশনের কারণে এবার যশোর বোর্ড দেশের আটটি সাধারণ বোর্ডে পাসের দিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে। গত বছর যশোর শিক্ষা বোর্ডের ফল বিপর্যয়ের বিষয়টি তারা সিরিয়াসলি নেন। এরপর বোর্ড কর্তৃপক্ষ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। সেখানে অষ্টম, দশম ও দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। এতে শিক্ষার্থীরা উদ্বুদ্ধ হয়েছে বলেই এবার জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসির ফল বেশ ভালো। তিনি আরও মনে করেন, এবার পরীক্ষায় প্রশ্নও ভালো হয়েছে।পরীক্ষায় ফেল থাকবে কেন?পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছর ফেল করা প্রায় সোয়া ৩ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার ৮০৪। মাদ্রাসা বোর্ডে ৮ হাজার ৯৭, কারিগরিতে ১৪ হাজার ১৭১ জন গত বছর ফেল করে। কিন্তু এবার অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীসহ মাদ্রাসা বোর্ডে ৮ হাজার ২৮৩ ও কারিগরিতে ১৩ হাজার ৩৯১ জন পরীক্ষা দেয়। এছাড়া ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত ডিআইবিএস পরীক্ষায় গত বছর ১ হাজার ৮৫ জন ফেল করে। তাদের মধ্যে ৮৬৩ জন এবার পরীক্ষা দিয়েছে। এ বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১০টি বোর্ডে মোট ফেল করেছে ৩ লাখ ৪ হাজার ৪৯০ জন, যা শতকরা হিসাবে মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ২৫ ভাগ। দেশের শিক্ষা বোর্ডগুলোর সার্বিক কার্যাবলী পরীক্ষা করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ১৯৯৭ সালে যে টাস্কফোর্স গঠিত হয় আমি তার সদস্য এবং একাডেমিক কমিটির আহ্বায়ক ছিলাম। ওই বছর ২৮ আগস্ট যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় তাতে ছিল : ‘যদি বলা হয় যে, পরীক্ষায় ফেল বলে কোনো শব্দ থাকবে না, তাহলে সবাই চমকে উঠবে। কিন্তু ... ফেল শব্দটি মুছে দিতে হবে। ...গরিব দেশের গরিব অভিভাবকদের সন্তানরা একবার ফেল করলে পরের বার আর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এতে অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অকালে ঝরে পড়ে।’ টাস্কফোর্স তার প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করে : ‘যারা কোচিং সেন্টার ও গাইড বইয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকবেন, পরীক্ষার কোনো পর্যায়ে তারা সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন না।’ সেই সঙ্গে টাস্কফোর্স সুপারিশ করে, ‘পূর্ববর্তী বছরের প্রশ্নপত্রের ভাষারও পুনরাবৃত্তি করা যাবে না।’ভর্তির জন্য উৎকণ্ঠা ও উচ্চশিক্ষাআমাদের মিডিয়া প্রতি বছরের মতো এবারও একটি বিষয়ে সোচ্চার। তাদের আশংকা, হাজার হাজার এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে না। এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের ভর্তির বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে অতীতে কোনোকালেই আসন সংকট হয়নি। এবারও হবে না। তবে উচ্চ ডিগ্রি অর্জনের জন্য সারা বিশ্বেই শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। পর্যাপ্ত আসন আছে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই নিয়মিত কোনো না কোনো নতুন বিভাগ চালু হচ্ছে। এতে আসন সংখ্যাও বাড়ছে। তাছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজে প্রতিবারই অসংখ্য আসন শূন্য থাকে। তাই আসন সংকটের কোনো আশংকা নেই বলেও শিক্ষামন্ত্রী জানান।আমারও জানা নেই পৃথিবীর কোনো দেশ আছে কিনা, যেখানে সবাই পছন্দসই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে। আবার সবাই উচ্চশিক্ষায় যায় কিনা অথবা উচ্চশিক্ষার সংজ্ঞা কী? অতি সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর স্যার ক্রিস্টোফার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বলেছেন, উচ্চশিক্ষার পুরনো মডেল অকার্যকর হয়ে গেছে। সেখানে ইতিমধ্যে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী নতুন ভাবনা ও কর্মসূচি এসেছে, যা বাংলাদেশের মতো দেশের শিক্ষা উন্নয়ন ভাবনায় কাজে আসতে পারে। গবেষণার অপরিহার্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও এর প্রধান উপজীব্য হল লক্ষ্যহীন জ্ঞানচর্চার পরিবর্তে উন্নত জীবনের জন্য দক্ষতা সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ এবং দেশাত্মবোধ ও নৈতিক মূল্যবোধের জাগরণ। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার সব স্তর ও পর্যায়ে পরিবর্তনের এ ঢেউ আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হবে।কুদরাত-এ-খুদা রিপোর্টের প্রাসঙ্গিকতা১৯৭৪ সালেই ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় : শিক্ষার মাধ্যমিক স্তর বিস্তৃত হওয়া দরকার দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত। তবে কর্মজীবনে প্রবেশে ইচ্ছুকদের জন্য একাদশ শ্রেণী যথাযথ হতে পারে। এতে বলা হয়, ‘আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থার কথা বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদের পরিবেশ, জীবনযাত্রা, স্থানীয় অর্থনীতির কর্মধারা ও কর্মজীবনে প্রবেশের ভবিষ্যৎ কর্মসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির সুষ্ঠু প্রতিফলন মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যসূচিতে বাঞ্ছনীয়। কারণ নবম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর মধ্যে (অর্থাৎ বয়সসীমা ১৪ বছরের মধ্যে) প্রতি বছর গড়ে প্রায় সাড়ে চার লাখের মতো ছাত্রছাত্রী নানা কারণে স্কুলের পড়াশোনা ত্যাগ করে এবং পুরোপুরিভাবে সমাজজীবনে ফিরে আসতে বাধ্য হয়, অথচ জীবিকা অর্জনে সহায়ক তেমন কোনো প্রশিক্ষণ তারা পায় না। ফলে তাদের অধিকাংশই ব্যর্থতার গ্লানি ভোগ করে এবং বিক্ষুব্ধ মন নিয়ে সমাজের জীবনধারায় আপন সংকীর্ণ ভূমিকা পালন করে যায়। যে কোনো দেশের পক্ষে এ অবস্থা অত্যন্ত ক্ষতিকর। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জন্য প্রান্তিক শিক্ষা ও স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রান্তিক বৃত্তিমূলক শিক্ষা মোটামুটি একাদশ শ্রেণী এবং সাধারণ শিক্ষা দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে। এ উদ্দেশ্যে নবম শ্রেণী থেকে শিক্ষা কার্যক্রম মূলত দ্বিধাবিভক্ত হবে : (ক) বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও (খ) সাধারণ শিক্ষা। ...প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকালে আমাদের লক্ষ্য হবে অষ্টম শ্রেণী উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের শতকরা বিশ ভাগকে প্রস্তাবিত বৃত্তিমূলক শিক্ষাক্রমে নিয়ে আসা। পরবর্তী পরিকল্পনায় এ হারকে অন্তত শতকরা পঞ্চাশ ভাগে উন্নীত করতে হবে।’এবারের এইচএসসি উত্তীর্ণরা যে সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে না অথবা স্নাতক/স্নাতকোত্তর প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর খাতায় নাম লেখাবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো কর্মমুখী শিক্ষা কার্যক্রমে তারা কতজন যুক্ত হতে পারে? সিঙ্গাপুরে ৬৪ শতাংশ এবং মালয়েশিয়ায় ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তরেই কর্মমুখী শিক্ষা বাছাই করে। কুদরাত-এ-খুদা রিপোর্টে ১৯৭৪ সালেই কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ২০ শতাংশ হওয়া উচিত বলে উল্লেখ করা হলেও ২০১৬ সালে এসেও তা অর্জন করা যায়নি। অথচ প্রতি বছর বিদেশ থেকে আসা দক্ষ কর্মীরা বছরে শুধু বেতন বাবদ ৪ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যায়। আমাদের দেশের বেকার জনগোষ্ঠীর একটা অংশ মালয়েশিয়ায় মশা ও সাপের কামড় খেয়ে আরব দেশগুলোতে অসহ্য গরমের মধ্যে পিচগলা রাস্তা পরিষ্কারের কাজ করে। দেশের ভেতরে কর্মবাজার তাদের কতটুকু আকর্ষণ করে? এ নিয়ে তাদের কতটুকু ধারণা আছে? প্রতি বছর ২০ লাখ তরুণের কর্মবাজারে প্রবেশের আপ্রাণ চেষ্টার কথা আমরা জানলেও আমাদের সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তারা এ দিকটা কতটুকু দেখেন? ইতিমধ্যে জানা যায়, কর্মদক্ষতা না থাকায় আমাদের দেশের তরুণরা ফিলিপাইন, ভারত, ভিয়েতনামের তুলনায় অনেক কম উপার্জন করে। আমাদের প্রবাসী মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন জেলায় প্রবাসী শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ট নয়। দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক এসব কর্মসূচিতে সমন্বয়েরও প্রয়োজন আছে।পরীক্ষার ফল ও জীবনে সাফল্যএ বছরের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল সব দিক থেকেই ইতিবাচক বলতে হবে। শিক্ষার্থীর শ্রম, অভিভাবকের বিনিয়োগ, রাষ্ট্রের আনুকূল্য, সর্বোপরি শিক্ষকের পাঠদান ও নির্দেশনা এক্ষেত্রে কতটুকু অবদান রেখেছে এবং আরও রাখার সুযোগ আছে তা মূল্যায়নের সময় এসেছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞান মূল্যায়নের বিষয়কে খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে সামগ্রিক বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা দরকার বলে মনে করি। দেশ-বিদেশের উদাহরণ, ব্রিটিশ আমল থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন ও জরিপের প্রতিবেদন মূল্যায়ন, মিডিয়ার সহায়তা নিয়ে সব স্তর ও পর্যায়ে, বিশেষ করে তৃণমূলের শিক্ষক ও অভিভাবকদের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনার ভিত্তিতে প্রচলিত পাবলিক পরীক্ষার উপযোগিতা যাচাই করে একটি যুগোপযোগী জাতীয় পরীক্ষানীতি প্রণয়নের আবশ্যকতার দিকে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে আশা করব, এইচএসসির ফল তাদের কর্মজীবন তথা জীবনের পরীক্ষায়ও কাক্সিক্ষত সাফল্য এনে দেবে।অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : শিক্ষক আন্দোলনের প্রবীণ নেতা। চেয়ারম্যান, ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (আইএইচডি)



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews