ছবির ক্যাপশান,
বড় গরুতে আগ্রহ কম ক্রেতাদের
৪৭ মিনিট আগে
রাত পোহালেই মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আযহা। আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করবেন সামর্থবান মুসলিমরা। বাংলাদেশের কোরবানির পশুর হাটগুলোতে চলছে শেষ মুহূর্তের বেচাকেনা।
শেষ মুহূর্তে এসে দর কষাকষিতে ব্যস্ত সময় কাটছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের।
এবছর ছোট ও মাঝারি সাইজের গরুর চাহিদা বেশি থাকলেও অপেক্ষাকৃত বড় গরুর চাহিদা অনেকটাই কম।
রাজধানীর অন্তত তিনটি হাট ঘুরে দেখা গেছে, ছোট গরুর চাহিদা যেমন বেশি তেমনি শেষ বেলায় দামও বেশি চাইছেন বিক্রেতারা। অথচ চাহিদার পাশাপাশি দামেও অকেটা ভাটা পড়েছে অপেক্ষাকৃত বড় গরুর ক্ষেত্রে।
বিক্রেতারা বলছেন, ছোট গরু বিক্রি করে লাভের মুখ দেখলেও বড় গরু নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন তারা।
কোরবানির পশু হাটে বড় গরুর চাহিদা কম থাকার কারণ হিসেবে "দুর্নীতির টাকা না থাকাকে" দায়ী করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
যদিও এর পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিকেও দুষছেন অর্থনীতিবিদরা।
ছবির ক্যাপশান,
উট দেখতে ভীড় করছেন অনেকে কিন্তু ক্রেতা কম
সরেজমিনে ঢাকার তেজগাঁও পশুর হাট ঘুরে দেখা যায়, এক সপ্তাহ আগে হাটে তোলা হলেও শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ক্রেতা মেলেনি পাবনা থেকে আসা বেশ বড় আকৃতির একটি গরুর। "পাবনার ডন" নামের এই গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে ১২ লাখ টাকা। বিক্রেতার দাবি, এটির ওজন ১২০০ কেজি।
গাবতলী হাটে তিনটি পাকিস্তানি উট নিয়ে যশোর থেকে এসেছেন মোহাম্মদ আশিকুর। এক সপ্তাহের চেষ্টায় এখনো একটি উটও বিক্রি করতে পারেননি তিনি।
শুরুতে একটি উটের দাম ৩৪ লাখ টাকা হাঁকালেও এখন ৩০ লাখের নিচেই বিক্রি করতে চান মি. আশিকুর।
তিনি বলছিলেন, "অনেকেই ছবি তুলতিছেন, দাম শুনতিছেন, কিন্তু কিনতিছেন না।"
গাবতলী পশুর হাটে ভীড় থাকলেও ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা দামের গরুর কিনতেই বেশি আগ্রহ ক্রেতাদের।
রাজধানীর পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়ক সংলগ্ন পশুর হাটেও বেশিরভাগ বড় গরু অবিক্রিত থেকে গেছে। অন্যান্য হাটের মতো সেখানেও ছোট ও মাঝারি আকারের গরুর দাম নিয়ে অসন্তোষ জানালেন অনেক ক্রেতা।
ছবির ক্যাপশান,
তেজগাঁও হাটেও ছোট গরুর চাহিদা বেশি ছিল
ঢাকার হাটগুলোতে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ছোট বা মাঝারি গরু বিক্রি হলেও, অবিক্রিত থেকে গেছে বেশিরভাগ বড় গরু।
এমনকি বেচাকেনার শেষ দিনেও বড় সাইজের পশু কিনতে খুব একটা আগ্রহ দেখা যায়নি ক্রেতাদের মধ্যে।
তেজগাঁও হাটে গরু নিয়ে আসা সুমন মিয়া বিবিসি বাংলাকে জানান, "বেশি দাম পাবো বলে পাঁচটি গরু নিয়ে পাবনার গ্রাম থেকে ঢাকায় আসছিলাম। ছোট গরুগুলো বিক্রি করছি। কিন্তু বড়টার কেউ দাম করে না।"
শুরুতে ১২ লাখ দাম চাইলেও এখন পাঁচ লাখ টাকায় গরুটি বিক্রি করতে রাজি তিনি।
"এটা বিক্রি করে বাড়ি যেতে হবে তাড়াতাড়ি। পরিবারের সাথে ঈদ কাটাবো, লস হলে আর কী করা। ফিরায় নিলে লস আরও বেশি," বলছিলেন মি. সুমন।
গাবতলী পশুর হাটে অনেকটা অলস সময় কাটছে বড় গরু নিয়ে আসা বিক্রেতাদের।
ক্রেতাদের আগ্রহ না থাকায় হতাশা প্রকাশ করেন ব্যবসায়ী আফসার ব্যাপারি। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, "বড় গরু পালতে খরচ অনেক বেশি। কিন্তু কিনতে আইসা (ক্রেতারা) দাম কয় না।মানুষ খালি কম দামেরটা খুঁজে।"
ছবির ক্যাপশান,
সামর্থ অনুযায়ী গরু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন ক্রেতারা
বড় গরু কম বিক্রির কারণ হিসেবে, দুর্নীতির টাকা না থাকার কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার গাবতলী পশুর হাট পরিদর্শনে গিয়ে এই উপদেষ্টা বলেন, "আগে দুর্নীতির টাকা ভরা ছিল পকেটে। এখন তো দুর্নীতির টাকা নাই। এখন এজন্য বড় গরু কিনতে পারতেছে না।"
"যাদের কাছে কালো টাকা ছিল তারা বড় বড় গরু কিনতো" বলেও মন্তব্য করেন উপদেষ্টা।
যদিও দুর্নীতি বা কালো টাকার পাশাপাশি অধীক মূল্যস্ফীতিসহ দেশের বর্তমান অর্থনীতির পরিস্থিতিকেও কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, সিপিডি'র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, দেশের সার্বিক অর্থনীতির প্রভাবও কিছুটা পড়েছে কোরবানির হাটে।
মি. খান বলছেন, "বিষয়টি আসলে কমনসেন্সের, এখানে কোনো স্টাডি নাই। আগে যারা বড় গরু কিনতেন এখন অনেকে ছোট গরুতে গেছেন। দেশের অর্থনীতি নিয়ে কিছু কাজ হচ্ছে, কিন্তু ওভারঅল একটা চাপের মধ্যে আছে, এটা নিয়ে সন্দেহ নাই।"
ছবির ক্যাপশান,
দর কষাকষিতে ব্যস্ত ক্রেতা-বিক্রেতারা
ঈদের আগের দিন, শুক্রবার সকালে অনেকটাই ফাঁকা ছিল তেজগাঁও কোরবানির পশুর হাট।
অল্প সংখ্যক গরু নিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় বিক্রেতারা, যার অধিকাংশই বড় গরু।
তারা বলছেন, ভালো দাম পেয়ে ছোট ও মাঝারি সাইজের গরুগুলো আগেভাগেই বিক্রি হয়ে গেছে।
আবার এই হাটে এসে পছন্দ অনুযায়ী ছোট গরু না পেয়ে অন্য হাটে চলে যাচ্ছেন অনেক ক্রেতা।
তেমনই একজন ঢাকার মগবাজারের বাসিন্দা পারভেজ হোসেন। ভাইদের সঙ্গে তেজগাঁও হাটে কোরবানির পশু কিনতে আসলেও পরে অন্য হাটে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বিবিসি বাংলাকে মি. পারভেজ বলছিলেন, "দেড় লাখ টাকার মধ্যেই গরু কিনতে চাই আমরা। কিন্তু এই হাটে মনমতো পাচ্ছি না। আর যা আছে একটু বেশিই দাম চাচ্ছে। এখন অন্য হাটে যাবো।"
আগেভাগেই গরু বিক্রি হয়ে যাওয়ায় খুশি তেজগাঁও হাটের হাসিল কমিটি। তবে শেষ রাতের বেচাকেনা ধরতে আরও গরু আনার চেষ্টা করছেন তারা।
ছবির ক্যাপশান,
হাসিলের পরিমাণ আরও কমানোর কথা বলেছেন অনেক ক্রেতা
হাট কমিটির সদস্য মোহাম্মদ বাবুল বলেন, "এবছর তেজগাঁও হাটে রেকর্ড সংখ্যক গরু আসছে, প্রায় আট হাজার। বৃহস্পতিবার রাতের মধ্যেই বেশিরভাগ সেল হয়ে গেছে। এখনো তিন-চারশো গরু আছে। দুই লাখ দামের মধ্যে থাকা গরুর চাহিদাই বেশি," জানান মি. বাবুল।
পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়ক সংলগ্ন পশুর হাটে ছোট ও মাঝারি আকারের গরু থাকলেও দাম নিয়ে অভিযোগ ক্রেতাদের।
বিক্রেতারা অতিরিক্ত দাম হাঁকছেন বলে অভিযোগ করেন গরু কিনতে আসা ক্রেতা স্বপন হক। তিনি বলছেন, অন্যান্য যেকোনো বছরের তুলনায় ছোট গরুর দাম এবার অনেক বেশি।
একই অভিযোগ গাবতলী হাটে গরু কিনতে আসা মি. রাফি ও তার স্ত্রীর। তারা অবশ্য গরুর দাম কমার অপেক্ষায় আছেন।
মি. রাফি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "আজ রেট এখনো নামে নাই, গতকালকের দামই এখনো রয়ে গেছে।"
গরুর তুলনায় দাম অনেক বেশি চাচ্ছে, তাই বাজেট মেলাতে পারছেন না বলেও দাবি করেন এই দম্পতি।
ছবির ক্যাপশান,
শেষ বেলায় ঢাকার আশপাশের অনেক ব্যাপারী গরু নিয়ে হাটে আসছেন
প্রতিবছরই শেষ মুহূর্তে কোরবানির পশুর হাটে ক্রেতার ভীড় বাড়ে। আর তাই শেষ বেলায় ঢাকার আশপাশের অনেক ব্যাপারী গরু নিয়ে হাটে আসছেন। বিভিন্ন হাটে দাম যাচাই করে পশু আনছেন তারা।
গাবতলি হাটের পাশেই তুরাগ নদীর তীরে গরু-ছাগল ভর্তি ট্রলার নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন ব্যাপারি আকমল হোসেন ও তার সঙ্গীরা। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, গাবতলি হাটের থেকে বেশি দামের আশায় গরু নিয়ে আশুলিয়ার হাটে চলে যাচ্ছেন তিনি।
বিবিসি বাংলাকে মি. আকমল বলেন, গত এক সপ্তাহে ছোট-বড় ২৭টি গরু বিক্রি করেছেন। এখন তার ১৩টি গরু গাবতলি হাটে বিক্রির অপেক্ষায় আছে। তাই এই হাটে না এসে আশুলিয়া হাটে নতুন করে ১০টি গরু নিয়ে যাচ্ছেন।
ছবির ক্যাপশান,
ছোট গরু বিক্রি করে বেশ লাভ করেছেন বলে জানান অনেক বিক্রেতা
শুক্রবার দুপুরে গাবতলি হাটেও গরু এনেছেন সাভার ও মানিকগঞ্জের অনেক ব্যবসায়ী। মানিকগঞ্জের একজন ব্যাপারি জানান, "ঈদের আগের দু'দিনই বেশিরভাগ বিক্রি হয়। তাই শেষ মুহূর্তে গরুগুলো হাটে আনলাম।"
এবছর আগেভাগেই ফাঁকা হয়েছে তেজগাঁও পশুর হাট। ক্রেতাদের আনাগোনা থাকলেও শেষ বেলার কেনাবেচায় তেমন একটা ভীড় দেখা যায়নি এখানে। তাই গরু আনার জন্য ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন খামারি কিংবা ব্যবসায়ী সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন হাটের ইজারাদার।
হাট কর্তৃপক্ষ বলছেন, "এবার ক্রেতাদের ভালো সাড়া মিলেছে। আমাদের হাটে আরও গরু আসার কথা আছে। যদি বিকেল পর্যন্ত আসে তাইলে হয়তো বা ক্রেতার আরও গরু পাবে।"