নিজের বাড়িতে থেকে, নিজের বাড়িতে খেয়ে বিপুলসংখ্যক তরুণ-যুবক আজকাল মফস্বলে মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা রোজগার করছে।

নানা ধরনের কাজে তারা নিয়োজিত। নতুন নতুন কাজ (জব)। পুরনো কাজের জায়গায় এসব কাজ এখন গ্রামাঞ্চলে দেখা যাচ্ছে। নদী নেই, তাই মাঝি নেই, জেলেও নেই।

কামারের কাজে কমতি- চীনা পণ্য তার কাজ কমিয়ে দিয়েছে। কুমারের কাজ প্লাস্টিক ও সিলভারের তৈজসপত্র গ্রাস করে নিয়েছে। তাঁতিরা পেশা বদল করছে। পোশাক শিল্পের রফতানির কাপড় বাজারে আসছে।

এর সঙ্গে তাঁতিরা কুলিয়ে উঠতে পারেন না। এভাবে শত শত বা হাজার হাজার মানুষ কর্মচ্যুত হচ্ছে। টেকনোলজি- ছোট-মাঝারি টেকনোলজি- মানুষকে বেকার করছে।

কৃষকের কাজ যন্ত্রায়িত হচ্ছে। জমি চাষ হয় ট্রাক্টরে, ফসল লাগানো হয় যন্ত্রে, কীটনাশক ছিটানো হয় যন্ত্রে, আগাছা দূর করা হয় যন্ত্রে। ফসল কাটা, ফসল বাড়িতে তোলা, ধান গাছ থেকে ধান বিচ্ছিন্নকরণ, ধান থেকে চাল করা, ধান শুকানো- সব কাজে এখন যন্ত্র। ধীরে ধীরে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। বাকি কাজে শ্রমিক, যার পারিশ্রমিক মজুরি বেশি- কৃষকরা পোষাতে পারছেন না।

দেখা যাচ্ছে, এভাবে গ্রামের মানুষ তাদের চিরায়ত কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। এর থেকে বাঁচার জন্য মানুষ শহরে আসছে, রিকশা ধরছে, হকারি করছে, ভাঙারির কাজ করছে, সবজি বিক্রি করছে, মাছ বিক্রি করছে। সবই রোজগারের কাজ- ভালো রোজগার।

দেখা যাচ্ছে, এভাবে গ্রামের মানুষ তাদের চিরায়ত কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। এর থেকে বাঁচার জন্য মানুষ শহরে আসছে, রিকশা ধরছে, হকারি করছে, ভাঙারির কাজ করছে, সবজি বিক্রি করছে, মাছ বিক্রি করছে। সবই রোজগারের কাজ- ভালো রোজগার।

তাহলে গ্রামের লোক কী করছে? যারা গ্রামের তরুণ-যুবক, কর্মক্ষম লোক, তারা কী করছে? এই প্রশ্ন অনেকদিন ধরেই আমার মনে। উত্তর পাই, উত্তর পাই না- মনকে বুঝ দিতে পারি না। কয়েকদিন আগে দেশের বাড়িতে গিয়ে এ সম্পর্কে একটা ধারণা পেলাম। দেশের বাড়ি মানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের জেলা- কিশোরগঞ্জ।

এর একটি উপজেলা কটিয়াদি, পাটের বাজারের জন্য বিখ্যাত। এখনও তাই। দেখলাম উপজেলার প্রচুর তরুণ-যুবক ‘সিএনজি’ চালাচ্ছে, ব্যাটারিচালিত গাড়ি চালাচ্ছে, মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ার করছে, মোটরচালিত রিকশা চালাচ্ছে।

সংখ্যায় কত? শত শত বা কয়েক হাজার। তারা কৃষিকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি চালাচ্ছে। মালামাল পরিবহনের জন্য মোটরচালিত ভ্যানগাড়ি চালাচ্ছে। এসবকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে প্রচুর গ্যারেজ, মেকানিক্যাল শপ। বিদ্যুতের কাজ, টেলিভিশনের কাজ, ফ্রিজ, মেরামত, ওস্তাগারগিরির কাজে যুক্ত হয়েছে অনেক তরুণ। আর ‘ট্রেডিংয়ের’ কোনো হিসাব নেই।

সংখ্যায় কত? শত শত বা কয়েক হাজার। তারা কৃষিকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি চালাচ্ছে। মালামাল পরিবহনের জন্য মোটরচালিত ভ্যানগাড়ি চালাচ্ছে। এসবকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে প্রচুর গ্যারেজ, মেকানিক্যাল শপ। বিদ্যুতের কাজ, টেলিভিশনের কাজ, ফ্রিজ, মেরামত, ওস্তাগারগিরির কাজে যুক্ত হয়েছে অনেক তরুণ। আর ‘ট্রেডিংয়ের’ কোনো হিসাব নেই।

আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগে কটিয়াদি উপজেলা বাজারে কয়েকটা মনিহারি দোকান, কাপড়ের দোকান এবং ওষুধের দোকান ছিল। আর ছিল পাটের গুদাম- বিশাল বিশাল গুদাম। নদীর পাড় ঘেঁষেই ছিল এসব দোকান। দোকানিরা বাকিতে (ট্রেড ক্রেডিট) পণ্য আনত ভৈরব বাজার ও ঢাকা থেকে। এতে ব্যবহৃত হতো বিশাল বিশাল পানসি নৌকা। পণ্য ধরত একেকটায় ৪০০-৫০০ মণ। আজ? আজকের দিনে কটিয়াদি উপজেলা এক মিউনিসিপ্যালিটি শহর। নদী বিলীন হয়েছে। নদীতে মানুষ দোকানপাট করেছে, বাঁধ দিয়েছে, ঘরবাড়ি করেছে।

জায়গায় জায়গায় মাছ চাষ হচ্ছে। বাজার চলে গেছে আন্তঃজেলা বড় রাস্তার পাশে, যেখানে এখন সরকারি নানা অফিস, নতুন নতুন অফিস। হাসপাতাল, থানা, ডাকঘর, সাবরেজিস্ট্রি অফিস রয়ে গেছে বিলুপ্ত নদীর তীরে। দোকানের সংখ্যা? শত শত। কিসের দোকান নেই? ইলেকট্রনিক্সের দোকান, মোবাইলের দোকান, জামা-কাপড়, জুতা, কসমেটিক্স, ফিশফিড, মিষ্টির দোকান থেকে শুরু করে রয়েছে বড় বড় কনফেকশনারির দোকান। তৈজসপত্রের দোকান অনেক। বড় বড় ওষুধের দোকান। রয়েছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার। বেশ কয়েকজন ডাক্তার আছেন। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে অলংকারের দোকানের খবর। পাকিস্তান আমলের শেষে এই ‘উপজেলা’ বাজারে মাত্র দু-তিনজন ছিলেন, যারা সোনার অলংকারের কাজ করতেন। অবশ্যই পুরনো সোনার অলংকারের কাজ। গ্রাহক খুবই সীমিত। বিয়ে-শাদির সময় তারা ব্যস্ত থাকতেন। আজকের অবস্থা কী? ডজন ডজন দোকান। সুসজ্জিত দোকান। বিদ্যুতের ঝলকানি চারদিকে। গ্রাহক সংখ্যা প্রচুর। সোনার দোকানে নতুন নতুন অলংকার। বোরকা পরিহিত, হিজাব পরিহিত মেয়েরা রাত ৮-৯টায় দোকানে দোকানে দলবেঁধে সওদা করছে, অলংকার কিনছে। এ এক অভাবনীয় দৃশ্য। পাকিস্তান আমলে বাজারে কোনোদিন কোনো নারীকে আমি অন্তত দেখিনি। এরা কারা? সবার ধারণা এরা উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারী, যারা মাসে মাসে ভালো পরিমাণ রেমিটেন্স পান বিদেশ থেকে। স্বামীরা মধ্যপ্রাচ্যে, মালয়েশিয়ায় কাজ করেন। টাকা পাঠান স্ত্রীর নামে, বাপ-মা অথবা ভাই-বোনের নামে কম। এটা অভিজ্ঞতার ফসল। তাই মেয়েরা আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল-স্বাধীন। তারা ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করাচ্ছে। কিন্ডারগার্টেনজাতীয় স্কুল আছে। ‘টিউশন’ একটি ভালো পেশা। উদীয়মান মধ্যবিত্ত এর সেবা নেয়। মেয়েরা স্কুল-কলেজে যাচ্ছে।

আমাদের সময়ে কলেজ ছিল না, হাইস্কুল ছিল একটা। সেখানে ক্লাসে ক্লাসে ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী থাকত ৩-৪ জন। তাও অনিয়মিত। আজকের দিনের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। কটিয়াদি স্কুলে ছেলে-মেয়ে সমান সমান। রয়েছে মেয়েদের জন্য আলাদা স্কুল। কলেজের চিত্র বিপরীত। একশ’ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬০-৭০ জনই এখন ছাত্রী। সিংহভাগ হিজাব পরিহিত। ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই পরীক্ষায় ভালো করে বলে জানালেন কলেজের প্রিন্সিপাল সবিতা দেবী। ছেলেরা ব্যস্ত মোবাইল নিয়ে, ফেসবুক নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে। তারা লেখাপড়ার চেয়ে ব্যস্ত ‘অন্য কাজে’। আবার সপ্তম-অষ্টম শ্রেণীর পরই ছেলেরা লেখাপড়ায় নিরুৎসাহী হয়ে ওঠে। তারা স্বপ্ন দেখে কবে বিদেশ যাবে- সৌদি যাবে। তাদের ধারণা ধন-সম্পদ সব ওইসব দেশে। সেসব দেশে কয়েক বছর থেকে আসতে পারলে অবস্থার উন্নতি হবে। বাড়িঘর পাকা করা যাবে, সোনা-দানা কেনা যাবে, জমিজমা কেনা যাবে। ভালো জীবনযাপন করা যাবে। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা কাজও করতে চায় না, স্কুলেও যেতে চায় না। জমির কাজে তাদের অনাগ্রহ, মনে করে এটা অসম্মানের কাজ! খেত খামারে কাজের লোক থেকেও নেই। আজকের তরুণরা কৃষিতে যুক্ত হতে চায় না। আত্মীয়-স্বজন, ভাই-চাচাতো ভাইদের অনেকের থাকে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি, দুবাই ইত্যাদি দেশে। এ কারণেই কটিয়াদিতে আসছে প্রচুর ‘রেমিটেন্স’। সরকারি প্রায় সব ব্যাংকেরই একটা করে শাখা আছে। চারটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা। ভাবা যায়? এত ব্যাংকের ব্যবসা কী? প্রতিটিতে কোটি কোটি টাকার আমানত। ব্যবসায়ীরা কিছু কিছু ঋণ নেয় তাদের কাছ থেকে। প্রধান ব্যবসা রেমিটেন্স। ব্যাংকার রঞ্জন বর্মন জানালেন, সরকারিভাবেই আনুমানিক ১৫-২০ কোটি টাকার ‘রেমিটেন্স’ আসে প্রতি মাসে। এর বেনিফিশিয়ারি হাজার হাজার মানুষ, শত শত পরিবার। এসব পরিবার এবং নতুন নতুন ‘জবে’ নিয়োজিত তরুণ-যুবকরাই এখন কটিয়াদির অর্থনীতির প্রাণভোমরা।

কটিয়াদিতে মুষ্টিমেয় লোকে ব্যবসা জানত, সেই জায়গায় এখন শত শত লোক ব্যবসায় জড়িত। ব্যবসা এখন সহজ। পণ্যের জন্য ভৈরব বা ঢাকায় আসতে হয় না। পাইকাররা জামা-কাপড়, ইলেকট্রনিক্স, মোবাইল থেকে শুরু করে প্রায় সব জিনিসই দোকানে দোকানে পৌঁছে দেয় তাদের পরিবহন দ্বারা। টাকা পরিশোধ হয় ‘বিকাশে’। ঝুঁকি নেই। নগদের ব্যবসাই বেশি। মানুষের হাতে ‘ক্যাশ’ আছে। আগের দিনের মতো মানুষ ততটা ‘ক্যাশের’ অভাবে ভোগে না। ছোটবেলায় আমরা ১০ টাকার ওপরে নোট দেখিনি। এখন শুধু টাকা নয়, ডলারের নোট অনেকের কাছে। এ এক নতুন কটিয়াদি! ভোগ-বিলাস-প্রাচুর্য বিপুলসংখ্যক লোকের মধ্যে। উপজেলা সদরের বাড়িঘর দেখলে মনে হয় একটা ছোটখাটো ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে। বাড়ির দেয়ালে পর্যন্ত টাইলস।

প্রাচুর্য অনেক অশান্তিও দেয়। এ ক্ষেত্রেও তাই। মানুষের রোগ-শোক বাড়ছে। মেদবহুলতা বাড়ছে। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ বাড়ছে। মাদকাসক্তি বাড়ছে। রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। পরের ধন দখল করার প্রবণতা বাড়ছে। সবাই সরকারি দলের দাবিদার। মধ্যবিত্ত নারীদের কাজ কমছে। মুড়ি, চিড়া ইত্যাদি এখন মেশিনে তৈরি হয়। কৃষিকাজ মেশিনে। অতএব অনেক মধ্যবিত্ত, নিুমধ্যবিত্ত নারীর কোনো কাজ নেই। নতুন সুখ! ঘর মোছা, ঘর ধোয়ার কাজ নেই। টিনের বাড়ি নেই তাই। উঠান নেই। বাড়িঘর পাকা। পয়ঃপ্রণালি আছে। তবে কটিয়াদি উপজেলা শহরের রাস্তাঘাট দেখলে মনে হয় এ অঞ্চলের কোনো অভিভাবক নেই। থাকলে রাস্তাঘাটের এ অবস্থা হতো না। আড়িয়াল খাঁ নদী এভাবে লোকেরা দখল করে বাড়িঘর, দোকানপাট করতে পারত না, মাছের চাষ করতে পারত না। বোঝাই যায় ভালো-মন্দে কটিয়াদি এগিয়ে চলেছে।

দেশের সব উপজেলার অবস্থাই কি তাই? আমার জানা নেই। তবে বোঝাই যায় ‘রেমিটেন্স’ অঞ্চলে অঞ্চলে পার্থক্য তৈরি করে। ‘রেমিটেন্স’ যেখানে নেই, সেখানে অর্থনীতি ততটা সজীব না হওয়ারই কথা। এরই মধ্যে সমাজ, অর্থনীতি, কৃষি এগিয়ে চলেছে- একদিকে ভাঙছে, অন্যদিকে গড়ে উঠছে। টেকনোলজি, ক্যাশ, শিক্ষা, যাতায়াত ব্যবস্থা সবকিছুকে বদলে দিচ্ছে। সত্তরোর্ধ্ব বয়স্কদের জন্য এ এক নতুন বাংলাদেশ।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews